ইসরায়েল 'গোঁফ' নামাবে?-কণ্ঠস্বর by রাহাত খান

৯৪৮ সালের আগে ইহুদিদের কোনো রাষ্ট্র ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির শোচনীয় পরাজয়ের পর রাশিয়া, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইহুদি রাষ্ট্রের পত্তন ঘটায়। আরব অধ্যুষিত ফিলিস্তিনকে দুই অসমান খণ্ডে ভাগ করা হয়। জর্ডান নদীর পশ্চিমপাড়ে ছোট অংশটি দেওয়া হয় ফিলিস্তিনি আরবদের। আর আটলান্টিক তীরবর্তী বড় অংশে পত্তন করা হয় ইহুদি রাষ্ট্রের। যার বর্তমান নাম ইসরায়েল।


ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল পত্তনের একটা মর্মান্তিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অবশ্য ছিল। বিংশ শতাব্দীর চলি্লশ দশকের মধ্যে জাতীয়তাবাদী নেতা এডলফ হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানি বিশাল সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জার্মানির এই অর্জনে বিশ্বের অন্য কোনো রাষ্ট্রেরই বলার কিছু ছিল না। কিন্তু গোল বাধিয়েছিলেন হিটলার নিজেই।
তিনি ছিলেন চরম ইহুদিবিদ্বেষী। নিজেদের দেশ না থাকলেও সারাবিশ্বে বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইহুদি জনগোষ্ঠী শিক্ষা-দীক্ষা, বিজ্ঞান ও তথ্য গবেষণায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে ছিল খুবই অগ্রসর। ইউরোপ ও আমেরিকায় তাদের প্রভাবও ছিল যথেষ্ট। ইহুদিদের এই অবস্থানকে মোটেও সহ্য করতে পারছিলেন না জার্মানির চ্যান্সেলর এডলফ হিটলার। ইহুদিদের প্রতি তার এই ভয়াবহ ঘৃণা ও বিদ্বেষের কী কারণ ছিল, তা সঠিক জানা যায় না। তবে চ্যান্সেলর হিটলার বাহুবল ও ইহুদি ঘৃণায় মত্ত হয়ে স্থির করেন, ইহুদি জাতটাকে তিনি ধ্বংস করে দেবেন। শুধু জার্মানিতে নয়, সারাবিশ্বের কোথাও কোনো ইহুদিকে বেঁচে থাকতে দেওয়া হবে না।
উন্মাদ ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-বিদ্বেষে জর্জর কোনো ব্যক্তি ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারেন না। তবে ইতিহাসের এমন কিছু ব্যক্তি ছিলেন বৈকি যারা ক্ষমতার শীর্ষে থাকাকালে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-বিদ্বেষ ও হত্যার নেশায় উন্মত্ত হয়ে বর্বর পশুসুলভ আচরণে লিপ্ত হয়েছেন। উদাহরণ ক্রমে সত্তর দশকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান এবং পাকিস্তানের ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলি ভুট্টোর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। হিটলার, ইয়াহিয়া খান এবং জুলফিকার ভুট্টোর জন্ম একই বংশে। হিটলার ও তার নাৎসি বাহিনী প্রায় ৪০ লাখ ইহুদিকে নিছক ইহুদি হওয়ার 'অপরাধে' হিংস্র উপায়ে হত্যা করেছিলেন। আর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর জামায়াতে ইসলামীর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী ৩০ লাখ বাঙালি হত্যা এবং ২ লাখ বাঙালি নারীকে লাঞ্ছিত করেছিল শুধু বাঙালি হওয়ার 'কারণে'। দুইয়ের মধ্যে মিল আছে যথেষ্টই।
এসব পুরনো ইতিহাসের পৃষ্ঠা নতুন করে কেন আবার উল্টানো_ এর কারণ একটু পরই বিবৃত করছি। আগে এটুকু বলে নিই, অক্ষশক্তি জার্মানি, ইতালি ও জাপানের বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির জয়ের পর বিশ্বব্যাপী বিশাল সহানুভূতির পথ ধরেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল। এটা ইহুদিদের জন্য বিশাল এক পুরস্কার। কিন্তু ইহুদি দলনে বিন্দুমাত্র জড়িত না থাকা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনের আরবরা কেন 'উদ্বাস্তু রাষ্ট্রে' পরিণত হলো, পশ্চিমা রাজনীতি কোনোদিন এর জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। বরং ফিলিস্তিনি আরবদের ভূমি গ্রাসে পশ্চিম তীরে গত ৬৩ বছর ধরে নতুন নতুন ইহুদি বসতি স্থাপনে, কোনো দিন তারা ইসরায়েলের বিপক্ষে লিপ সার্ভিসের বেশি কিছু কখনও দেয়নি।
বরং পশ্চিমা শক্তির হৃদয়ের পার্ট খুললে দেখা যায়, ইসরায়েলের প্রতি ভালোবাসা তাদের অন্তহীন এবং আঞ্চলিক শান্তির চেয়েও ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিয়ে তারা বেশি উদ্বিগ্ন। তারা উদ্বিগ্ন ইসরায়েলে হামাসের বোমাবর্ষণে। কিন্তু পিএলও থাকতেও কেন আরবদের মধ্যে হামাসের মতো যুদ্ধবাদী দলের জন্ম হয়, তা পশ্চিমা বিশ্ব বোঝে না, তা ঠিক নয়। ফিলিস্তিনি তরুণ ও যুবকরা কেন তাদের দেশ অবরোধ করে রাখা ইসরায়েলি সৈন্যের ওপর ইটপাটকেল ছোড়ে। কেন হামাস ইসরায়েলের গাজা আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে মিসাইল নিক্ষেপ করে সীমান্তের ওপারে। এর প্রেক্ষাপট তারা, পশ্চিমারা বোঝে ঠিকই, তবে বুঝেও না বোঝার ভান করে।
ফিলিস্তিনিরা কেন ইসরায়েলের বিপক্ষে প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা ভাবে? কেন তাদের জান-কবুল ইন্তিফাদা আন্দোলন গড়ে ওঠে ইসরায়েলের বিপক্ষে? কেন তারা ইসরায়েলের ২০-৩০ মাইলের ভেতর ছুড়ে মারে মিসাইল? কেন কখনও কখনও দু'চারজন বন্দুকধারী ইসরায়েলি সেনা নিহত হয় ক্ষ্যাপা আরব যুবক বাহিনী কিংবা হামাসের হাতে?
খুবই সহজ এসব প্রশ্নের উত্তর। নিজের দেশের অর্ধেকটা হারিয়েও ফিলিস্তিনিদের আজ ইসরায়েলি সেনা অবরোধের মধ্যে বাস করতে হচ্ছে। পশ্চিম তীরে মাইলের পর মাইলজুড়ে ইসরায়েলের নতুন নতুন বসতি স্থাপন করা চলছেই। জেরুজালেম বরাবর ফিলিস্তিনি আরবদের রাজধানী ছিল। কয়েক লাখ ফিলিস্তিনি সেখানে নানা ধরনের কাজে লিপ্ত ছিল। সেই শহরটিও দখল করে নিয়েছে ইসরায়েল। এখন ইসরায়েলের ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে আশ্রয়চ্যুত ফিলিস্তিনিদের কাজ করতে যেতে হয় জেরুজালেমে প্রতিদিন।
ইসরায়েল তার নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের অতীত সম্পূর্ণ ভুলে গেছে। তাই ছুটকো কারণের অজুহাত দেখিয়ে গাজার স্কুলে বোমা ফেলে শত শত নিষ্পাপ শিশু হত্যা করতে তাদের কোনো দ্বিধা হয় না। ভাইয়ের সামনে বোনকে মারছে তারা। বাবার সামনে মারছে ভীতসন্ত্রস্ত সন্তানকে। হাজার হাজার মা ও গৃহবধূ ইসরায়েলি বাহিনীর হত্যার শিকার হয়েছে। ইসরায়েল অতীতকে স্মরণ করে না। হিটলারই যেন এখন তাদের সমর ও রাজনীতির আদর্শ।
এসব নিষ্ঠুর ও অসহনীয় কাজের বিপক্ষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হওয়াই তো স্বাভাবিক। স্বাভাবিক সন্ত্রাসের বিপক্ষে সন্ত্রাস এবং অস্ত্রের বিপক্ষে অস্ত্রের ব্যবহার। তবে সন্ত্রাস ও অস্ত্রের ব্যবহারে ইসরায়েল-আরবদের শক্তির মাত্রা ৯০-১০-এর বেশি নয়। ধনী আরব বিশ্ব ফিলিস্তিনি আরবদের এহেন বিপদ ও মানবতা-সংকটে তাদের অর্থ ও কূটনীতি নিয়ে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে এগিয়ে আসতে পারত। কিন্তু আরব জাতীয়তাবাদী নেতা জামাল আবদুল নাসেরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর এক সিরিয়ার প্রয়াত নেতা প্রেসিডেন্ট আসাদ ছাড়া সৌদি আরব, মিসর, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, জর্ডান, মরক্কো, লেবানন, ইয়েমেন ও ওমানে তথা আরব বিশ্বে যারাই ক্ষমতাসীন ছিলেন এবং আছেন, সবাই তারা পশ্চিমাদের চাপে ও পরামর্শে ইসরায়েলের হাতের পুতুল বৈ আর কিছু নয়। সৌদি আরব, লিবিয়া প্রভৃতি দেশ প্রতি বছর ফিলিস্তিনিদের কিছু অর্থ সাহায্য দেয়। লিপ সার্ভিসও দেয় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে। তবে সেই লিপ সার্ভিস এটাই বরাবর প্রমাণ করেছে যে, ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবির পক্ষে কোনোদিনই তারা ইসরায়েল-বিরোধিতায় অবতীর্ণ হবে না। পশ্চিমা ও আরব বিশ্ব শুধু দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি আলোচনার পরামর্শ দেয়। কিন্তু ইসরায়েলের লেবার দলীয় প্রধানমন্ত্রী ইয়াদজিক রবিনকে বাদ দিলে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের যাবতীয় শান্তি আলোচনা এ পর্যন্ত প্রসব করেছে অশ্বডিম্ব। প্রধানমন্ত্রী রবিন শান্তি আলোচনায় বসে সমস্যার অনেক দূর মীমাংসায় পেঁৗছেছিলেন। ২০০২ সালেই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা ছিল ফিলিস্তিনের। কিন্তু তার কিছুকাল আগেই আরব জাতীয়তাবাদী নেতা জামাল আবদুল নাসেরের মতো আততায়ীর হাতে প্রাণ দিতে হয় রবিনকে। এরপর কিসের শান্তি আলোচনা। পশ্চিমা সমর্থনে ইসরায়েলের বাহুবলই শাসন করছে সমগ্র পশ্চিম তীর ও গাজা।
তবে প্রকৃতির নিয়মের ধারায়ই বোধ করি বসন্ত-বিপ্লবে আরব বিশ্বের বেশিরভাগ ইসরায়েল সমর্থক আরব নেতা তাদের গদি হারিয়েছেন। বাকি যারা আছেন তাদেরও ক্ষমতায় থাকার দিন ফুরিয়ে আসছে বলেই মনে হয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, আরব বিশ্বের নতুন নেতারা জনগণের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হবেন। আর আরব বিশ্বের পুরনো দালাল মার্কা ইসরায়েলি নীতিরও প্রভূত পরিবর্তন ঘটবে।
এখন পুরনো এসব প্রসঙ্গের আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া কেন, সেই বিষয়ে কথা বলা যেতে পারে। সম্প্রতি স্বয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন পেনেট্টা এক সাম্প্রতিক সফরে ইসরায়েলে পেঁৗছে খুব পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, আরবে হয়ে যাওয়া এবং এখনও হতে থাকা বসন্ত বিপ্লবে ইসরায়েল খুব দ্রুতই বিশাল চাপের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। ইসরায়েল হয়ে পড়বে ক্রমাগতভাবে বিচ্ছিন্ন ও একা।
পেনেট্টা বলেছেন, আরবদের চেয়ে ইসরায়েলের সমরশক্তি হয়তো বেশি। তবে শুধু বাড়তি সমর শক্তিই জেতার জন্য যথেষ্ট নয়। ইউরোপ, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকাজুড়ে এমন বহু রাষ্ট্র আছে, যাদের সমর্থন ও সহানুভূতি রয়েছে ফিলিস্তিনিদের প্রতি। বিশ্বের একটা বিশাল অংশ থেকে ইসরাইলের এই বিচ্ছিন্নতা দিন দিন বাড়ছে।
পেনেট্টা ফিলিস্তিনেও যাবেন মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে দেখা করতে এবং কথা বলতে। ইসরায়েলকে পরামর্শ দিয়েছেন মিসর ও তুরস্কের মতো দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের। বুঝতে বাকি থাকে না, পেনেট্টা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছেন ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে আরেকটা শান্তি আলোচনা শুরুর চেষ্টা করতে। যুদ্ধে তো শেষ পর্যন্ত কোনো পক্ষেরই জয় হবে না। সন্দেহ নেই, শান্তি আলোচনাই সমস্যা নিরসনের একমাত্র পথ। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, এবারের শান্তি আলোচনা শুধু অশ্বডিম্ব প্রসবের মধ্যে শেষ নাও হতে পারে। রবিন অনুসৃত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনার পথই ইসরায়েলকে সম্ভাব্য সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের হাত থাকে বাঁচাতে পারে। ইসরায়েল এটা যত বুঝবে তত তার মঙ্গল।

রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.