তৃতীয় বিশ্বের পরগাছা নেতৃত্ব by মোহাম্মদ নুরাল হক

ত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্র আফগান যুদ্ধে কোনো সফলতা পায়নি। পক্ষান্তরে তালেবানরা আরও শক্তিশালী হয়েছে।' উক্তিটি আমাদের মতো নির্বোধদের উদ্দেশে মহা দয়াপরবশ হয়ে আজ উৎসর্গ করছেন পশ্চিমা সমরবিদরা ও তথাকথিত বোদ্ধারা। যাক, তবু যে দেরিতে হলেও ওদের বোধোদয় হচ্ছে, এটা আপাতত সন্তুষ্টির বিষয়। এহেন বিষয়ে ভিয়েতনামের শতবর্ষী বিজয়ী সেনাপতি জেনারেল গিয়াপ তো বোধকরি বেশ কয়েক বছর আগেই ইরাকের ভবিষ্যৎ


প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেই দিয়েছিলেন, 'ওহ ঃযরং ড়িৎষফ, হড় নড়ফু পধহ বাবৎ রিহ ভরমযঃরহম ধমধরহংঃ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ঃযব ষধহফ.' অর্থাৎ 'এই পৃথিবীতে কেউ কখনোই দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করতে পারে না।' ষাট-সত্তরের দশকে অশিক্ষিত, গেঁয়ো ও ল্যাংটাপুটো ভিয়েতকংদের নেতৃত্ব দিয়ে এ কথাই তখনও প্রমাণ করেছিলেন, এই বিজয়ী বীর সেনানায়ক জেনারেল গিয়াপ, যা পৃথিবীর ইতিহাসে এখনও জাজ্বল্যমান।
মধ্যপ্রাচ্যসহ বাংলাদেশ ও এর আশপাশের দেশগুলোতে পশ্চিমা দেশগুলোর নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী ওপনিবেশবাদ নীতির স্পষ্ট উদ্দেশ্য মূলত দুটি। প্রথমত, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও নারীর ক্ষমতায়ন নামক নানা মন ভুলানো উচ্চকিত বুলি আওড়িয়ে এবং 'ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি'র গানের আবেশ ছড়িয়ে একক শক্তি হিসেবে নিজেকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করা। দ্বিতীয়ত, মুক্তবাজার অর্থনীতির ভাঁওতাবাজি ও শুভঙ্করের ফাঁকির আড়ালে এই দেশগুলোর মাটির ওপরের ও মাটির নিচের সমুদয় সম্পদ লুট করা। এভাবেই মধ্যপ্রাচ্যসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়াই হলো আজ বারাক হুসেইন ওবামার নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের এক নম্বরের এজেন্ডা।
বারাক ওবামাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হলো এই যে, ওদের সুন্দর চকচকে অবয়বের পেছনে আসল চেহারা হলো ভয়ঙ্কর দানবীয়। হাজার বছরের ঐতিহ্যে আমরা সবসময়ই অতিথিপরায়ণ জাতি হিসেবেই পরিচিত। আজও যে কোনো মানেই নন্দিত। আমরা বারবার ক্ষমা করি। আমরা অতীতকে সহজেই ভুলে যাই। তারপরও আজ একুশ শতকে বিশ্বজুড়ে যখন চারদিকে স্বাধীনতার গণজোয়ার অপ্রতিরোধ্য, তখন বারাক ওবামারা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার নীতি নিয়েই অগ্রসর হচ্ছেন। তাই বারাক ওবামার দম্ভপূর্ণ উক্তি হলো, 'চীন ও ভারতের উত্থান হলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতত্বে পশ্চিমা দেশগুলোই বিশ্বের নেতৃত্ব দেবে।' এখানে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলোর কোনো পাত্তাই নেই। তথাকথিত ক্ষমতা ওদের, ওরা শাসক। আমরা শাসিত, তাই শোষিত হতেই হবে।
আমার প্রশ্ন হলো, পশ্চিমা দেশগুলোর নেতৃত্বে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই কেন বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে? কোনো ইতিহাস, কোনো ঐতিহ্য অথবা কোনো মাধুর্য এখানে নিহিত আছে? শ্রমিক থেকে শুরু করে পৃথিবী বিখ্যাত গবেষকদের সংখ্যা পশ্চিমা বিশ্বের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রেই কি বেশি? পরিসংখ্যান কী বলে? ওদের গালভরা বুলি গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও নারীর ক্ষমতায়নের যে বাস্তবিক চিত্র আজ বিশেষভাবে লক্ষণীয়, তা কি পরিসংখ্যানগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে? বাস্তবতার নিরিখে মোটেই নয়। তাহলে তৃতীয় বিশ্বের কাছে, আজ এই বিষয়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের আপাত জয়জয়কার মনে হয় কেন?
কারণ, মুসলিম উম্মাহসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো আজ নেতৃত্ববিহীন, আত্মোপলব্ধিহীন তথা পরগাছা নেতৃত্ব দ্বারা নামেমাত্র পরিচালিত হচ্ছে। যেখানে ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠীস্বার্থে ক্ষমতা আর সম্পদ কুক্ষিগত করাই প্রধান বিবেচ্য বিষয়, সেখানে দেশ ও দেশের মানুষ গৌণ।
তবে বাস্তবতা হলো, দেশের মানুষের কাছে যেসব নেতা নিন্দিত, সময়ের ব্যবধানে তাদের অবস্থা স্বভাবতই হবে মিসরের হোসনি মোবারক, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন অথবা লিবিয়ার গাদ্দাফির মতো। এটাই স্বাভাবিক। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়।
সবচেয়ে দুঃখজনক ও নিকৃষ্টতম বিষয়টি হলো, মুসলিম উম্মাহসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নেতা-নেত্রীরা বিদেশি প্রভুদের দ্বারা অপমানিত-অপদস্থ হলেও কিছু আসে-যায় না। বিদেশি প্রভুদের দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যায় বোধহয় তারা গৌরবান্বিত। কিন্তু নিজ দেশের মানুষের সামনে সামান্য ভুল স্বীকার করায় অথবা জবাবদিহিতায় এদের যত আপত্তি ও কার্পণ্য। এখন ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে দেখার বিষয়, সময় কার পক্ষে ঘণ্টা বাজায়।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) মোহাম্মদ নুরাল হক : পিএসসি, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.