কালীগঞ্জে বিচারের নামে নির্যাতন

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে গ্রাম্য সালিশের নামে এক গৃহবধূর ওপর বর্বর নির্যাতন চালানোর ঘটনায় জেলার মানবাধিকার ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। গৃহবধূ রোখসানার মাথার চুল কেটে মুখে পোড়া ইঞ্জিন অয়েল মাখিয়ে গ্রামে ঘোরানোর প্রতিবাদে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করছে সংগঠনগুলো। এরপরও ৮ আসামির মধ্যে মাত্র একজনকে ধরতে পেরেছে পুলিশ।

শনিবার সকাল ও দুপুরে বিহঙ্গ সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র ও ঝিনাইদহ মানবাধিকার বাস্তবাংন সংস্থা পৃথকভাবে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। ঘণ্টাব্যাপী এ কর্মসূচিতে সংস্কৃতি কর্মী, ছাত্র ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নারী-পুরুষ অংশ নেন।

মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের সময় ঝিনাইদহ সদর উপজেলা মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সভাপতি আমিনুর রহমান টুকু বাংলানিউজকে জানান, এই জঘন্যতম ঘটনার বিচার না হলে সমাজে অহরহ ঘটতেই থাকবে।
বিহঙ্গ সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্রের পরিচালক শাহিনুল আলম জানান, তারা দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন। কিন্তু, কালীগঞ্জের পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে একেবারেই চুপচাপ বলে তিনি অভিযোগ করেন।

ঘটনা যে ভাবে
ঘটনা- রোববার বিকেল ৪টা। পথে দেখা হয়ে যায় তালাক দেওয়া স্ত্রী রোখসানার সাবেক স্বামী সাদ্দাম হোসেনের। দেখা হওয়ার পর পর দুজনেই লজ্জা ও আড়ষ্টতা ভেঙে কিছু কথা ও আলাপ করেন। আর এতেই ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ভোলপাড়া গ্রামের কিছু মানুষ এই বর্বরোচিত কাণ্ড ঘটিয়ে বসেন।

তালাক দেওয়া স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর কথা বলার অপরাধে রাতেই বসে বিচার। এরপর মেয়েটির মাথার চুল কেটে মুখসহ শরীরে পোড়া ইঞ্জিন অয়েল, চুন ও কালি মাখিয়ে বর্বর কায়দায় নির্যাতন করা হয়।

সাদ্দাম হোসেন কালীগঞ্জ উপজেলার তালিয়ান গ্রামের মনিরুল ইসলামের ছেলে ও নির্যাতিত রোখসানা খাতুন ভোলপাড়া গ্রামের মতলেব খাঁনের মেয়ে।

গ্রামবাসী আব্দুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, ৩ মাস আগে সাদ্দাম হোসেন বিয়ে করেন বিধবা রোখসানা খাতুনকে। কিন্তু দাম্পত্য কলহের কারণে তাদের ঠিকমতো সংসার হয়নি। গত ২১ নভেম্বর তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।

গ্রামবাসীরা জানান, ছাড়াছাড়ি হওয়ার পরও তারা মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন স্থানে দেখা করতেন। গত রোববার বিকেল ৪টার দিকে তারা ভোলপাড়া গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। এমন সময় গ্রামের কয়েক ব্যক্তি তাদের ওপর চড়াও হয়। এরপর স্থানীয় নিয়ামতপুর ইউনিয়নের মেম্বর হাফিজুর রহমানের বাড়িতে নিয়ে তাদের বেঁধে রাখা হয়।

রাত ১০টায় মেম্বরের বাড়িতে সালিশ বসে। কয়েকশ গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে এ সালিশে মেম্বর রায় দেন তাদের দু’জনের চুল কেটে চুন-কালি দিয়ে গ্রাম ঘোরাতে হবে। রায় অনুযায়ী তাদের চুল কাটা হয়। এরপর চুন, কালি ও পোড়া ইঞ্জিন অয়েল লাগানো হয় তাদের। স্বামী সাদ্দামের চেয়ে স্ত্রী রোখসানার শরীরে পোড়া ইঞ্জিন অয়েল বেশি ঢালা হয়।

এলাকাটি প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় ঘটনাটি গোপন থাকে। একপর্যায়ে জানাজানি হলে সংবাদকর্মীরা ভোলপাড়া গ্রামে গিয়ে খবরের সত্যতা পান। 

ভোলপাড়া গ্রামের তরুণ রাসেল বাংলানিউজকে জানান, এ ধরনের বিচার করার অধিকার গ্রামবাসী রাখে না। আইনগতভাবে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল।

তিনি বলেন, ‘এ ভাবে যারা চুল কেটেছে, তাদের বিচার হওয়া উচিত।’

এ ব্যাপারে শনিবার দুপুরে অভিযুক্ত ইউপি মেম্বর হাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, গ্রামবাসীর সবার সিদ্ধান্তে তার বাড়িতে এই সালিশ হয়। সবার সিদ্ধান্ত মোতাবেক মেয়েটির চুল কেটে, মুখে পোড়া ইঞ্জিন অয়েল মাখানো হয়। এ জন্য তিনি একা দায়ী নন। তবে ঘটনার জন্য তিনি অনুতপ্ত বলে স্বীকার করেন।

এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইন-চার্জ সৈয়দ কামরুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, এটা একটি বর্বর ঘটনা। একটা স্বাধীন দেশে এমন বর্বর ঘটনা ঘটতে পারে না। এ ভাবে শত শত মানুষের সামনে একটি মেয়ের মাথার চুল কেটে, চুন-কালি লাগিয়ে দেওয়া খুবই দুঃখজনক।

তিনি আরও জানান, এ ব্যাপারে ৮ জনকে আসামি করে থানায় একটি নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

তিনি জানান, ভোলপাড়া গ্রামের ইউপি মেম্বর হাফিজুর রহমান এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তিনি এজাহার নামীয় আসামি না হলেও তদন্তে তার নাম পাওয়া যাচ্ছে। অচিরেই সব আসামিকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে ওসি জানান।

No comments

Powered by Blogger.