অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে আপস নয় - শিক্ষক দিবস by কাজী ফারুক আহমেদ

জ ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। দিবসটির এবারের মূল প্রতিপাদ্য :'জেন্ডার সমতার পক্ষে শিক্ষক সমাজ', যা আগের বছরগুলো থেকে কিছুটা ব্যতিক্রমী। ইউনেস্কো, গ্গ্নোবাল ক্যাম্পেইন ফর এডুকেশন ও এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালের যেসব তথ্য পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে নির্ধারিত প্রতিপাদ্য যথেষ্ট শক্তিশালী। বাংলাদেশে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা দিবসটি যখন পালন করছেন সে সময় শিক্ষকদের একটি ক্ষুদ্রাংশের বিরুদ্ধে অনৈতিক আচরণ এবং


সাধারণভাবে অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে পাঠদানে অদক্ষতা ও শিক্ষার্থীকে শারীরিক শাস্তিদানের মতো অভিযোগ অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে বর্তমান সরকারের আমলে প্রণীত শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নিরলস প্রচেষ্টায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় স্তরে শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের শুরুতে বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক পেঁৗছে দেওয়া, প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তি প্রায় শতভাগে উন্নীতকরণসহ বিভিন্ন অর্জন সত্ত্ব্ওে শিক্ষক-কর্মচারীদের পেশাগত দীর্ঘদিনের বিভিন্ন দাবি পূরণ না হওয়ায় তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দুটিই লক্ষণীয়। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবস নতুন তাৎপর্য নিয়েও এসেছে বলা চলে।
ইউনেস্কো পরিবেশিত তথ্যে জানা যায়, বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫ ভাগের ৩ ভাগই নারী। বিশ্বব্যাপী তিনজন নারীর মধ্যে একজন শারীরিক প্রহার, বাধ্যতামূলক ও কোনো না কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার। আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলে এইডস আক্রান্তদের মধ্যে ৫৯ শতাংশই নারী, যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে। পুরুষের তুলনায় নারীর এইডসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তিন গুণ। পৃথিবীর ৭৭৪ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক যারা পড়তে জানে না, তার তিন ভাগের দু'ভাগই নারী। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন গবেষণাকর্মে নারীর অংশগ্রহণ চার ভাগের এক ভাগ মাত্র। এ প্রেক্ষাপটে ইউনেস্কো জেন্ডার সমতার পক্ষে যে অবস্থান নিয়েছে তার মূলকথা হলো, সমান অধিকার ও করণীয়ের ভিত্তিতে নারী ও পুরুষের জ্ঞান অর্জন, ক্ষমতায়ন। আর নারীর ক্ষমতায়নের অর্থ আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরতার মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করে নিজের জীবন সম্পর্কে নিজস্ব কর্মসূচি বাস্তবায়ন। শিশু অধিকার নিয়ে সক্রিয় বিভিন্ন সংগঠন, শিক্ষক সংগঠন, সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন এনজিও সমন্বয়ে ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত গ্গ্নোবাল ক্যাম্পেইন ফর এডুকেশন (জিসিই) বর্তমানে শতাধিক দেশে অবৈতনিক ও মানসম্মত পাবলিক শিক্ষার জন্য কাজ করছে। সংস্থাটি এ বছর ফেব্রুয়ারিতে প্যারিসে অনুষ্ঠিত চতুর্থ সাধারণ অধিবেশনে সর্বসম্মত আহ্বান জানায় :'নারী ও কন্যাশিশুর শিক্ষার জন্য এখনই কর্মসূচি নিয়ে প্রতিটি পর্যায়ে প্রতিটি প্রতিবন্ধক দূর করতে হবে।' উল্লেখ্য, ২০০৮ সালেই জিসিই সব দেশের সরকারগুলোকে আহ্বান জানায় বেশি সংখ্যায় নারী শিক্ষক নিয়োগ ও তাদেরকে শিক্ষকতায় ধরে রাখার জন্য। ২০০৯ ও ২০১০ দুই বছর ধরে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সদস্য শিক্ষক সংগঠন, শিক্ষা ব্যবস্থা ও সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে যে জরিপ চালায় তার প্রতিবেদনে দেখা যায়, শিক্ষক সংগঠনগুলো জেন্ডার সমতার কথা বললেও সাংগঠনিক নেতৃত্বে নারীর অবস্থান অনুল্লেখযোগ্য। অনেক দেশের পাঠ্যক্রমে জেন্ডার সমতার উল্লেখ থাকলেও বিষয় নির্বাচন ও শিক্ষা উপকরণে গতানুগতিকতার ধারা অব্যাহত। শ্রমবাজারে নারীর সমঅধিকার আইনসিদ্ধ হলেও নিয়োগ, পদোন্নতি ও মজুরির ক্ষেত্রে নারীরা চরম বৈষম্যের শিকার।
দেশের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের জাতীয় পর্যায়ের ১১টি সংগঠন নিয়ে গঠিত জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্ট এ উপলক্ষে ৫ দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে প্রত্যাশা ও প্রতিজ্ঞা দুটিই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ বছরের কর্মসূচিতে নতুন সংযোজন হলো শিক্ষক সংগঠনগুলোর সঙ্গে মহিলা পরিষদ, নারী প্রগতি সংঘের মতো নারী-পুরুষের সমঅধিকারে বিশ্বাসী সংগঠন, গণসাক্ষরতা অভিযানের মতো বেসরকারি সংস্থা-সংগঠনের ঐক্যবদ্ধভাবে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন। দিবসের যেসব প্রত্যাশা উচ্চারিত হবে তার মধ্যে রয়েছে :১. পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্রের নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় সম্মিলিত উদ্যোগ; ২. নারী-পুরুষের সমঅধিকার অর্জনে শিক্ষক, অভিভাবক, রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, সংস্কৃতিসেবীদের যৌথ প্রয়াস; ৩. বাধাহীন অনুকূল পরিবেশে শিক্ষকদের পাঠদানের সুযোগ ও যুগোপযোগী মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক প্রাপ্তি; ৪. শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা গবেষণায় কর্মসূচি; ৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় দলীয়করণ ও অবৈধ হস্তক্ষেপ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ; ৬. শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন গঠন; ৭. প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নারী-পুরুষ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের প্রতিনিধিত্ব ও নিয়মিত পদোন্নতি নিশ্চিতকরণ; ৮. প্রচলিত খণ্ডিতের পরিবর্তে সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অনুরূপ পূর্ণ উৎসব ভাতা ও পূর্ণ পেনশন; ৯. ১৯৯১-এর পরিবর্তে বর্তমান জাতীয় স্কেলে চিকিৎসা ভাতা, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ও বর্তমানের ১০০ টাকা বাড়ি ভাড়ার পরিবর্তে সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অনুরূপ বাড়ি ভাড়া অথবা সম্মানজনক আবাসন সুবিধা; ১০. বন্ধকৃত টাইম স্কেল অবিলম্বে চালু; ১১. কর্মচারীদের চাকরিবিধি প্রবর্তন; ১২. শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রবর্তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা ও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়ন; ১৩. ইউনেস্কো-আইএলও প্রণীত ও অনুমোদিত ১৯৬৬ ও ১৯৯৭ সালের শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সনদের বাস্তবায়ন।
উলি্লখিত প্রত্যাশাগুলোর সঙ্গে শিক্ষকরা বিশ্ব শিক্ষক দিবসের কর্মসূচিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবেন :১. মানসম্মত পাঠদান; ২. শিক্ষার্থীদের মধ্যে জানার আগ্রহ ও ঔৎসুক্য উৎসাহিত করতে তাদের প্রশ্ন করার সুযোগদান; ৩. শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তিদান থেকে বিরত থাকা; ৪. প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী উত্ত্যক্তর নামে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ; ৫. শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চা পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমিত না রেখে সহ-পাঠক্রমিক কার্যক্রম, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিচর্চায় অংশগ্রহণে উৎসাহদান; ৬. তরুণ সমাজের মধ্যে মাদকাসক্তি প্রতিরোধে শিক্ষক, অভিভাবক, সমাজপতি সবার সমবেত উদ্যোগ।
এসব প্রত্যাশা ও প্রতিজ্ঞাকে ধারণ করে বাংলাদেশের শিক্ষক সংগঠন ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবাই মানবসম্পদ উন্নয়ন তথা জাতীয় প্রগতিতে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখলে এবং এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মূল প্রতিপাদ্যকে অনুধাবন ও আত্মস্থ করতে পারলে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি_ সবকিছুতে যে গুণগত পরিবর্তন সূচিত হবে। কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা প্রতিরোধে মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির বিকাশে তা সুদূরপ্রসারী অবদান রাখবে। 'বিশ্ব শিক্ষক দিবস' অমর হোক।

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ :শিক্ষা ও
শিক্ষক আন্দোলনের নেতা
principalqfahmed@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.