ফিরে দেখা ২০১১-বিশ্বকাপ আর সাকিবের বছর by তারেক মাহমুদ

মুশফিকুর রহিমের কথাটার পর আর কোনো কথা থাকে না। বছরের শেষ সিরিজ শেষে অধিনায়কের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে অকপট স্বীকারোক্তি, ‘আমরা প্রত্যাশিত উন্নতি করতে পারিনি।’ টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর প্রায় এক যুগেও যে বাংলাদেশের ক্রিকেট খুব বেশি এগোয়নি, সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন মুশফিক। কিন্তু বছর শেষে ওই কথাটাই ক্রিকেটের সালতামামির মূলভাব হয়ে যাচ্ছে! বাংলাদেশের ক্রিকেটে ২০১১ সাল বিশ্বকাপের বছর হয়ে


থাকবে। বিশ্বকাপ উপলক্ষে বাংলাদেশ নতুন কোনো ক্রিকেট স্থাপনা না পেলেও সাফল্য আছে বিশ্বকাপ আয়োজনে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সঙ্গে আটটি ম্যাচ আয়োজন করে বিসিবি সাংগঠনিক সামর্থ্যের পরিচয় দিয়েছে। বিসিবির সাংগঠনিক দক্ষতা যে দারুণ, তার উদাহরণ মহিলা বিশ্বকাপ ২০১৩ বাছাইপর্ব আয়োজনও। চূড়ান্ত পর্বের টিকিট না পেলেও বাংলাদেশ মহিলা দল অর্জন করেছে ওয়ানডে মর্যাদা।
সে তুলনায় ছেলেদের বিশ্বকাপ হতাশারই। ছয় ম্যাচ খেলে তিনটিতে জয়, তিনটিতে হার। সাফল্য-ব্যর্থতা ফিফটি-ফিফটি। তবে গভীর বিশ্লেষণে সাফল্য আসলে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়টাই। র‌্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে থাকা আয়ারল্যান্ড ও হল্যান্ডের বিপক্ষে জয় প্রাপ্যই ছিল। ফিফটি-ফিফটিতে সান্ত্বনা খোঁজা তাই অর্থহীন। বরং ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৫৮, ৭৮-এ অলআউটের লজ্জা বছরজুড়েই পুড়িয়েছে ক্রিকেটামোদীদের।
বিশ্বকাপের পর পর দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজেও হার। তবে বাংলাদেশের জন্য এ বছর সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ছিল জিম্বাবুয়ে সফর। ছয় বছর পর টেস্টে ফেরা জিম্বাবুয়ের কাছে একমাত্র টেস্টে হেরে ওই পরীক্ষায় ব্যর্থ বাংলাদেশ। পাঁচ ওয়ানডের সিরিজে ৩-২ হারে ব্যর্থতার ষোলোকলা হয়েছে পূর্ণ।
৫৮-৭৮-কেও হারিয়ে দিয়েছে জিম্বাবুয়ের এই ব্যর্থতা। ২০০৮-এর আইসিএল-কাণ্ডের পর দেশের ক্রিকেট আরও একবার টালমাটাল হলো এই সময়ে। দলের ভেতরে পুনরাবিষ্কৃত অনেক রন্ধ্র দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল অন্তঃকলহের বিষবাষ্প। সমস্যার গভীরে যাওয়ার অক্ষমতায় সাকিব আল হাসান-তামিম ইকবালের নেতৃত্ব কেড়ে ‘জনপ্রিয়’ সিদ্ধান্ত নিল বোর্ড। তবে নিন্দুকেরা বলেন, এই দুই ক্রিকেটারের ওপর কোনো কোনো বোর্ড কর্মকর্তার ব্যক্তিগত আক্রোশেরই নাকি বহিঃপ্রকাশ নেতৃত্ব কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের কী লাভ হলো কে জানে, অধিনায়কত্ব হারিয়ে সাকিবের ঔজ্জ্বল্য কমেনি। বছরের শেষ টেস্টে একসঙ্গে সেঞ্চুরি আর ৫ উইকেট পেয়ে সাকিব আবারও জানিয়েছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আসলে কী দিচ্ছেন তিনি। বছর শুরু করেছিলেন ওয়ানডের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে। শেষ করছেন ওয়ানডে-টেস্ট দুই ধরনের ক্রিকেটেরই শীর্ষ অলরাউন্ডারের মুকুট পরে। ২০১১ সালে বাংলাদেশের আসাল অর্জন তো এটাই!
তামিম অবশ্য বছরের শেষ দিকে এসে হতাশই করেছেন। দলীয় ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে পাকিস্তান সিরিজে নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন এই বাঁহাতি ওপেনার। ২০১০ সালে উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালম্যানাকের পাঁচ বর্ষসেরার একজন হয়ে যে রঙিন ভবিষ্যতের আভাস দিয়েছিলেন, ২০১১ সালটাকে অন্তত সেভাবে রাঙাতে পারেননি তামিম। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে এ বছরও গোলাপ ফুটেছে একটা—নাসির হোসেন। আকরাম খানের নেতৃত্বে নতুন নির্বাচক কমিটি, নতুন কোচ স্টুয়ার্ট ল-র সঙ্গে পারফরম্যান্স দিয়ে বছর শেষের খেরোখাতায় নিজের নামটাও উঠিয়ে নিয়েছেন রংপুরের তরুণ ক্রিকেটার নাসির।
বছরটা নতুন রঙে ধরা দিয়েছে মুশফিকুর রহিমের কাছেও। কিছুদিন আগে বিসিবির দৃষ্টিতে সহ-অধিনায়ক হওয়ারও যোগ্য ছিলেন না। ‘সাকিব হটাও’ কর্মসূচি বাস্তবায়নের পর সেই বিসিবিই অধিনায়কের মালা পরিয়েছে মুশফিকের গলায়। শুরু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি জিতিয়ে। এরপর চট্টগ্রামে ওয়ানডে জয়, বৃষ্টিবিঘ্নিত টেস্টে জয়ের সম্ভাবনা জাগানো—সব মিলিয়ে খারাপ হয়নি মুশফিকের অধিনায়কত্বের অভিষেক।
বছর শেষে তাঁকেই বলতেই হয়েছে, ‘আমরা প্রত্যাশিত উন্নতি করতে পারিনি।’ টেস্ট ক্রিকেট শুধু নয়, বাংলাদেশের সার্বিক ক্রিকেটের ক্ষেত্রেই এটা সত্য। ২০১২ সাল বিপিএলের ঢোলে গরম হচ্ছে। নইলে এ দেশের মূল ঘরোয়া ক্রিকেট তো এখনো ঢাকা লিগ আর জাতীয় লিগেই সীমাবদ্ধ। মানসম্পন্ন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের জন্য হাহাকার এ বছরও থামেনি। আরেকটি বছর হারিয়ে গেছে শুধু এটাকে ঢেলে সাজানোর প্রতিশ্রুতি শুনেই। জাতীয় লিগের চার দিনের ম্যাচের চ্যাম্পিয়ন-রানার্সআপ রাজশাহী-ঢাকা, মোহামেডানকে রানার্সআপ বানিয়ে প্রিমিয়ারের শিরোপা আবাহনীর—সালতামামিতে প্রসঙ্গগুলো শুধু লিখতে হয় বলেই লেখা।

No comments

Powered by Blogger.