দক্ষিণ এশিয়া-আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামো সম্ভব? by সুভাষ সাহা

ফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার দক্ষিণ এশিয়ার সামনে নিজস্ব আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে ভারত পাকিস্তান-আফগানিস্তানের নেতৃত্ব কি এই ঐতিহাসিক সুযোগ কাজে লাগাবে? দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদ অনেকটা শরিকি। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, আফগানিস্তান ছাড়া এ অঞ্চলের অন্য সব দেশের সঙ্গেই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে ভারতের বিরোধ রয়েছে।


তারা ভারতকে ভয়ও পায়। দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রস্থলে ভারতের অবস্থান এবং সীমান্তের উভয় পারে একই জাতিগোষ্ঠী থাকার কারণে পারস্পরিক বিরোধটা অধিকাংশ সময় আস্থার সংকটের পর্যায়ে চলে যায়। ভৌগোলিকভাবে ভারত বিরাট আকৃতিসম্পন্ন এবং অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে এ অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। জ্ঞান-বিজ্ঞানেও দেশটি অন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে। বৈদেশিক সম্পর্কের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ভারতের। মোদ্দা কথা, কোনো বহির্শক্তিই ভারতকে বাদ রেখে এ অঞ্চলের নীতি-কৌশল গ্রহণ করে না। ভারতের অদ্বিতীয় ভৌগোলিক অবস্থান এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি ধর্ম-বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ভারতে দৃশ্যমান থাকায় একে বাদ দিয়ে এই অঞ্চলের কোনো দেশ তার নিরাপত্তা নীতি হোক আর অভ্যন্তরীণ নীতি হোক প্রণয়ন করতে পারে না। আবার ভারতও অন্যদের স্থিতিশীলতা ছাড়া নিজের স্থিতিশীলতা চিন্তা করতে পারে না। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল ইউরোপসহ বিশ্বের অপরাপর অঞ্চল থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বলতেই হবে। আবার দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র আফগানিস্তান ছাড়া আর কোনো দেশই জল হোক আর স্থল হোক ভারতের ভৌগোলিক অবস্থানের বাইরে নয়। সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্মীয় নৈকট্যের কারণে এবং এক সময় প্রায় অভিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুসরণ করত বলে ছোট দেশগুলো অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত হস্তক্ষেপ করতে পারে বলে সবসময় তাদের মধ্যে একটা নিরোধক ব্যবস্থা নেওয়ার মানসিকতা কাজ করে। এ কারণেই অপরাপর দেশ দ্বিমেরু বিশ্বের সুযোগে বাইরের শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে ডেকে এনে এই অঞ্চলে উত্তরের সঙ্গে শক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। আবার এই একই কারণে ভারত এসব দেশের ওপর সন্দেহ পোষণ করত। তবে ভারতের সিকিমকে ১৯৭৪ সালে নিজের ইউনিয়নভুক্ত করা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সহযোগিতা দেওয়ায় ভারতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অপরাপর দেশ বেশি মাত্রায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এতে ছোট দেশগুলোর মধ্যে ভীতি আরও বেড়ে যায়। পাকিস্তান ভারতকে মোকাবেলার উদ্দেশ্যে পারমাণবিক শক্তি গড়ে তোলে এবং তার মধ্যেই নিজের অস্তিত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা বজায় রাখার উপায় খোঁজে। এভাবেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। এই আস্থার সংকট সৃষ্টিতে ছোট দেশগুলোর চেয়েও ভারতের বিগ ব্রাদারসুলভ এতদিনকার নীতি বেশি দায়ী। তবে সার্ক গঠন এবং প্রতি বছর সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের বিধান থাকায় এই অঞ্চলে চোখ দেখাদেখি বন্ধের সম্ভাবনা কম।
সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের মধ্য দিয়ে দ্বিমেরু বিশ্বব্যবস্থার অবসানের পর দক্ষিণ এশিয়ার নতুন করে নিজেকে আবিষ্কারের মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিতি হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার এবং দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের সরব উপস্থিতি এই অঞ্চলে নতুন নিরাপত্তা ডাইমেশন সৃষ্টি করেছে। একদিকে ভারতভীতির অবসান, পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস দূর করা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপক আকারে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির অবসান, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, যুক্তরাষ্ট্রের চীনকে ঘিরে ধরার নীতি নিয়ে অগ্রসর হওয়া এবং তার সঙ্গে ভারতকে যুক্ত করার নিরন্তর চেষ্টা ইত্যাদি আঞ্চলিক নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি জড়িত বিষয়গুলোকে দক্ষিণ এশিয়া কী করে একক নিরাপত্তা ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে আনতে পারবে? আসলে এর উত্তর খুঁজে পাওয়ার ওপরই নির্ভর করছে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা সমস্যা ফয়সালার বিষয়টি।
আমরা যদি পেছনের দিকে খানিকটা ফিরে তাকাই তাহলে দেখব, এই অঞ্চলের মিয়ানমার (এখনও সার্ক সদস্য নয়) থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত অধিকাংশ দেশ এক সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির অধীন ছিল। অন্যদিকে, গোটা অঞ্চলে হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতি জড়াজড়ি করেছিল। বিশ্বের প্রতিটি প্রধান ধর্মই এখানে পল্লবিত হয়েছে প্রায় বিনা বাধায়। আবার প্রাকৃত ধর্মের মর্মবাণী সব ধর্মের মধ্যেই প্রবহমান ছিল বলে এখানে সব ধর্মই নিজের মধ্যে স্থানীয় আচার-আচরণ, বিশ্বাস ও রীতিনীতিকে অনেকটা জায়গা করে দিয়েছে। সর্বধর্ম সমন্ব্বয়ের এক সর্বজনীন ধারা দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতি ও ভাবধারায় প্রধান স্রোত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক আদান-প্রদানটাও নিজস্ব ধারায় পরিচালিত হতো। দক্ষিণ এশিয়া বহির্বাণিজ্যে গেলে এবং এক সময় বিরাট শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলেও তার অঞ্চলের বাইরে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে যায়নি বাহুবলে। নিজেকে নিয়েই গোটা ইতিহাসের কালপর্বে দক্ষিণ এশিয়াকে ব্যাপৃত থাকতে দেখা গেছে। ইউরাপে যেমনটা দেখা গেছে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে প্রবলভাবে এবং এখনও যেমনটা দেখা যায় মার্কিন নীতি-কৌশলে, সেভাবে পরের ধন হরণ করে নিজে বেড়ে ওঠা বা মাতবরি ফলানোর মানসিকতা কখনও আদি ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ায় দেখা যায়নি। অধিকাংশ সময়ই এই অঞ্চলকে শান্তি ও সমৃদ্ধির অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। হয়তো এ কারণেই যারা এ দেশে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে এসেছে তারা এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিজেদের ভবিষ্যৎকে চিনে নিয়েছে। একমাত্র ব্রিটিশই এখানে বাইরের শক্তি বিবেচিত হয় শেষ পর্যন্ত। তারা এখানে শাসন এবং শোষণ চালিয়ে এক পর্যায়ে বিদায় নেয়। ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে ব্রিটিশ দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বক্ষেত্রব্যাপী প্রভাব রেখে যায়। যোগাযোগ ও উৎপাদন পদ্ধতির ক্ষেত্রে তারা যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করে। একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করার মানসে তারা হাজার হাজার বছর ধরে পাশাপাশি শান্তি ও সৌহার্দ্যের মধ্যে বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী জাতিগোষ্ঠীকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগানোর তরিকা রপ্ত করে। এই উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়া ত্যাগ করে যাওয়ার সময় তারা দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক ইস্যুগুলোকে সমাধান করে যায়নি। পক্ষান্তরে তারা ভারতবর্ষকে এমনভাবে ভাগ করে রেখে যায় যাতে একই ভাষা, সম্প্রদায়, জাতি, ধর্মীয় গোষ্ঠী সীমান্তের উভয় পারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থায় রয়ে যায়। ব্রিটিশের এই হঠাৎ করে বিভাজনের ফলে প্রায় প্রতিটি দেশ তাদের পৃথক সত্তা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর থেকেই জাতিগত-ধর্মীয় নানা সমস্যায় জারিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এ কারণে ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের বিরোধ লেগেই আছে। এই শরিকি বিরোধ নিষ্পত্তি অসাধ্য নয়। পানি বণ্টন ও সীমান্ত বিরোধ (কাশ্মীর ছাড়া) নিষ্পত্তি রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। আর কাশ্মীর বিরোধের নিষ্পত্তিও ভারত ও পাকিস্তানের নেতৃত্ব বৈদেশিক হস্তক্ষেপমুক্ত অবস্থায় সমাধান করতে পারে। যেহেতু সব বিরোধের কেন্দ্রে ভারত রয়েছে সে কারণে ভারতীয় নেতৃত্বের সদিচ্ছা এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে। ভারতের নিজের অগ্রগতিকে বাধাহীন ও নিরুপদ্রব করার স্বার্থে এটা তাদের অবশ্যই করা উচিত এবং তারা সে লক্ষ্যেই এগোচ্ছে বলে বিশ্বাস। এই প্রক্রিয়ায় দক্ষিণ এশিয়া নিজস্ব নিরাপত্তা কাঠামো আবিষ্কার করতে পারলে মার্কিন হোক আর চীন হোক কারও খেয়োখেয়িতে আমাদের জড়ানো লাগবে না। তাদের চাপের কাছে দক্ষিণ এশিয়ার মাথা নোয়াতে হবে না। এভাবে দক্ষিণ এশিয়া আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে উদ্ভূত নিরাপত্তার শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে নিজের শক্তি বলেই। পাকিস্তানের মৌলবাদী ও জঙ্গি সমস্যা এবং ভারতের জায়মান হিন্দু উগ্রবাদের বিস্তারজনিত সমস্যাও অনেকাংশে কেটে যাবে। আসলে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার দক্ষিণ এশিয়ার সামনে নিজস্ব আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে ভারত পাকিস্তান-আফগানিস্তানের নেতৃত্ব কি এই ঐতিহাসিক সুযোগ কাজে লাগাবে?
তবে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পাস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস সহজে দূর হওয়ার নয় বলে মনে করেন অধিকাংশ রাজনৈতিক, সামরিক ও স্ট্র্যাটেজিক বিশ্লেষক। তাদের ধারনা এ ক্ষেত্রে বড় কোনো অর্জন অদূর ভবিষ্যতে। তারা নিরাপত্তা ইস্যুতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আস্থাবর্ধক পদক্ষেপের পক্ষে জোর সওয়াল করেন। তবে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়াতেও যে স্ট্র্যাটেজিক নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে ওঠা সম্ভব এবং সেটি দ্রুতই সম্ভব সে বিষয়টি বিশ্লেষকদের নজর এড়িয়ে যায়। তারা সমগ্রভাবে দক্ষিণ এশিয়াকে বিবেচনা না করে এই অঞ্চলের ভারতকেই কেবল বিশেষ অবস্থানে রাখতে চান। কিন্তু ভারত যে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছাড়া বেশি দূর এগোতে পারবে না, সেটি তারা হিসাবেই রাখেন না। পূর্বে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সহযোগিতা ছাড়া যেমন ভারত তার পূর্বমুখী যাত্রায় পুরোপুরি সফল হবে না তা তো বলাই বাহুল্য। আবার পশ্চিমে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সহযোগিতা ছাড়া তারা মধ্য এশিয়া ও পারস্যের সহযোগিতাকে নিষ্কণ্টক করতে পারবে না। এই অপরিহার্যতা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, নিরাপত্তা স্বাধীনতার বাস্তব শর্ত। দক্ষিণ এশিয়া এই ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করতে পারে না।

সুভাষ সাহা :সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.