মহড়া-গান্ধর্বলোকের ‘ঠাকুর ঠাকুর ঠাকুর...’ by আশীষ-উর-রহমান

‘চোখ বন্ধ করুন। গভীরভাবে প্রশান্তি অনুভব করুন। সব উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুর্ভাবনা পরিহার করে নিজেকে পরিপার্শ্ব থেকে বিযুক্ত করে ফেলুন। চিত্তকে স্থির করে আত্মনিমগ্ন হোন।’ থেমে থেকে মৃদু অথচ গভীর স্বরে বলছিলেন সুইডিস অবারিত। তাঁর নির্দেশনা অনুসরণ করছিলেন অন্যরা। মুদিত নেত্র। দুই হাত জোড় করে বুকের কাছে তুলে ধরা। আসনে মেরুদণ্ড টানটান করে বসে আত্মমগ্ন হয়ে আছেন গান্ধর্বলোক অর্কেস্ট্রার শিল্পীরা। গতকাল বুধবার, বেলা


তখন ১১টা। লালমাটিয়া বালিকা বিদ্যালয় মিলনায়তনের প্রবেশদ্বার ভেজিয়ে রাখা। ভেতরে পশ্চিম দিকের দেয়ালকে কেন্দ্র করে অর্ধবৃত্তাকারে চেয়ার ও বেঞ্চ সাজানো। তাতে গান্ধর্বলোকের শিল্পীরা করজোড়-মুদিত-নেত্রে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন। সামনে তাঁদের আধ্যাত্মিক গুরু চিন্ময়ের প্রতিকৃতির সামনে জ্বলছে মোমবাতি। ঘরে পিনপতন স্তব্ধতা।
গান্ধর্বলোকের শিল্পীদের সঙ্গে সুরের ধারার কিছু কিশোর-কিশোরীও ছিল। এরা অবশ্য ধ্যানস্থ নয়। ধ্যানে অভ্যস্তও নয় এরা। তাই খানিক বাদেই এদের মধ্যে একটু উসখুস ভাব। দু-একজন আসন থেকে উঠে পা টিপে টিপে বৃষ্টির দিনে পিচ্ছিল কর্দমাক্ত পথে যেমন করে চলতে হয়, তেমনি করে সন্তর্পণে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলেই দে ছুট।
একটা সময় খুব মৃদু এক সুরধ্বনি শোনা গেল ‘ওম...’। মৃদু থেকে ক্রমশ উচ্চ তারে উঠে গেল সেই দীর্ঘ সুরধ্বনি। পর পর তিনবার ‘ওম’ ধ্বনির পর চোখ বুজেই তারা গাইতে শুরু করলেন প্রার্থনাসংগীত। বাংলায়। ‘তোমার পানে চাহি আমি...’। প্রায় মিনিট পনেরো এই প্রস্তুতিপর্ব শেষে শুরু হলো গানের মহড়ার পালা। গানের আগে নিজেকে আত্মস্থ করে নেওয়া। গান্ধর্বলোকের রেওয়াজের এটাই নিয়ম।
সুরের ধারার শ্রুতি গীতবিতান প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত তিন দিনের রবীন্দ্র উৎসবের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার রাতে সংগীত পরিবেশন করবে গান্ধর্বলোক অর্কেস্ট্রা। বিশ্বের ১৭টি দেশের ৩৫ জন শিল্পীর সমন্বয়ে গান্ধর্বলোক অর্কেস্ট্রা ২৫ ডিসেম্বর ঢাকায় এসেই তাদের মহড়া শুরু করেছে। তাদের আধ্যাত্মিক গুরু চট্টগ্রামের ‘চিন্ময়’-এর সংগীতের চর্চা করেন তাঁরা। ঢাকায় দুই বছর আগে একটি অনুষ্ঠানে তাঁরা চিন্ময়ের গান শুনিয়েছিলেন সুরের ধারার সঙ্গে। তাতে রবীন্দ্রসংগীতও ছিল। এবার রবীন্দ্র উৎসবে পাশ্চাত্যের যন্ত্রানুষঙ্গে শুধুই রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করবেন। এই উৎসবে সুরের ধারার সঙ্গে সহযোগিতা করছে প্রথম আলো ও চ্যানেল আই।
গতাকল মহড়ায় গান্ধর্বের সংগীত পরিচালক কলম্বিয়ার হূদয়ানন্দ ‘স্টাফ নোটেশন’ নিয়ে দাঁড়ালেন যন্ত্রীদের সামনে। অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাটি বুঝিয়ে দিয়ে ‘ওয়ান-টু-থ্রি...’ বলে দুই হাত দুলিয়ে ইশারা দিতেই বেজে উঠল বেহালা, পিয়ানো, চেলো, স্যাক্সোফোন। বাজনার সঙ্গে ‘ঠাকুর, ঠাকুর’ সুরের মূর্ছনায় বাঙ্ময় হলো ঘরের স্তব্ধতা।
গান্ধর্বলোক সাতটি গান করবে। পরিবেশনার শুরু হবে কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁর নামের শেষাংশ ‘ঠাকুর’ শব্দটি ‘হামিং’য়ের মতো সুরে সুরে গেয়ে। এই ‘ঠাকুর ঠাকুর’ সুরধ্বনি কিছু কিছু গানের মাঝে এবং শেষেও পরিবেশিত হবে। গানগুলো হলো: ‘আনন্দলোকে’, ‘আমি কান পেতে রই’, ‘আমার মাথা নত করে’, ‘ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়’, ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’, ‘আলোকের এই ঝর্নাধারায়’ এবং ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’।
প্রথম চারটি গানেরই বারংবার অনুশীলন করা হলো এদিন। মঞ্চেই যন্ত্র বাদন করবেন তাঁরা। সে কারণে বাজনার সঙ্গে গানের সুর-তাল-লয়ের নিখুঁত সমন্বয়ের চেষ্টার কোনো ঘাটতি রাখতে তাঁরা নারাজ। পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে স্টেফান বাজাবেন চেলো, বিলুপ্তি বাজাবেন স্যাক্সোফোন, অমায়িক বাজাবেন ভিওলা, অভিনব বেইজ গিটার, পাঞ্চজন্য বুরি লিড গিটার, বাপুস্তারা পিয়ানো, ইরিনা বাঁশি, তাতিয়ানা ট্রাম্পেট ও বেহালা বাজাবেন নীল। এর সঙ্গে সুরের ধারার শিল্পীরা বাজাবেন তবলা ও হারমোনিয়াম।
সংগীত পরিচালক হূদয়ানন্দ অনুশীলনের সময় প্রতিটি শব্দের উচ্চারণ যত দূর সম্ভব শুদ্ধ করে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। যেমন, ‘ঠাকুর’ শব্দটি কেমন করে বাংলায় উচ্চারণ করা হয়, মৃদু না দৃঢ় স্বরে—এসব পুঙ্খানুপুঙ্খ শুনলেন। গানের বাণীর ইংরেজিতে লেখা উচ্চারণ, এর মর্মার্থ এবং সুরের স্বরলিপি পুস্তিকার মতো তৈরি করে গান্ধর্বের প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা সেটি অনুসরণ করছিলেন।
হূদয়ানন্দ প্রথম আলোকে বললেন, বাংলা উচ্চারণ খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। কারণ চিন্ময়ের গানগুলো বাংলাতেই লেখা বলে তাঁরা অনেকে শব্দের সঙ্গেই পরিচিত। রবীন্দ্রসংগীতের সুরের শুদ্ধতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে তাঁরা এ বিষয়ে খুব সতর্ক।
দলের সদস্য বিজন রায় চৌধুরী জানালেন, তাঁদের প্রত্যেকের চিন্ময়ের দেওয়া একটি বাংলা নাম রয়েছে। এই নামই তাঁরা ব্যবহার করেন। ঢাকায় আগেও তিনি এসেছেন। রবীন্দ্রসংগীত শুদ্ধ করে শেখার জন্য তাঁরা দীর্ঘ মেয়াদে সুরের ধারার সঙ্গে কাজ করবেন। কারণ তাঁদের আধ্যাত্মিক গুরু চিন্ময়ের গান ও রবীন্দ্রসংগীতের ভাবার্থ অনেকটা কাছাকাছি। তা ছাড়া চিন্ময় তাঁদের কিছু রবীন্দ্র ও নজরুলসংগীতও শিখিয়েছিলেন। গুনগুন করে গেয়ে শোনালেন ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে নাচিছে ঘূর্ণি বায়...’।
দলের প্রধান পাঞ্চজন্য বুরি প্রথম আলোকে বললেন, ‘ঢাকায় এসে বাড়িতে ফেরার অনুভূতি হচ্ছে। বাংলা গান নিয়েই আমাদের সাধনা ও সংগীতের চর্চা। বাংলা গান সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চাই আমরা।’ চিন্ময়ের গানের পাশাপাশি রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে আগামী ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় তাঁরা একটি বড় অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করছেন বলে জানালেন তিনি।
শুক্রবারের অনুষ্ঠানে গান্ধর্বলোকের ২৯ জন শিল্পীর সঙ্গে সুরের ধারার ৪০ জন অংশ নেবেন। সেদিন রাতে কবিগুরুর চেনা গান, চেনা সুরই এক নতুন রূপে শ্রবণের আনন্দ পাবে শ্রোতারা।

No comments

Powered by Blogger.