শনিবারের সুসংবাদ-জমি বিক্রি করে শিক্ষার আলো ছড়ান বোরহান উদ্দিন by জাহেদুল আলম,

মন মানুষ বিরল না হলেও আজকের দিনে একেবারে যত্রতত্র খুঁজে পাওয়ার মতোও নয়। অতি বাস্তববাদীরা ফোড়ন কাটতে পারেন_নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছেন লোকটা। কিন্তু নিজের জমি বেচে দিনের পর দিন শিক্ষার আলো ছড়ানোর কাজে নিবেদিত এই মানুষটি পরিচিতজনদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র। রাউজানের সবাই তাঁকে চেনে 'শিক্ষাপাগল' মানুষ হিসেবে। নাম বোরহান উদ্দিন। বয়স ৮৫ বছর।


শিক্ষাই ধ্যান-জ্ঞান বোরহান উদ্দিনের। অনেক দিন আগেই নিজের ধানিজমি দান করে দুটি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছেন। ৮৫ বছর বয়সে এসে আবারও তিনি জমি বিক্রি করে প্রতিষ্ঠা করেছেন শিক্ষা তহবিল ও মরণোত্তর সামাজিক ট্রাস্ট। রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের পাঁচখাইন মাঝিপাড়া এলাকার বাসিন্দা বোরহান উদ্দিন ভবিষ্যতে আরো কিছু জমি বেচে আরো কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন।
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীরেও শিক্ষার প্রতি এত দরদ দেখে এলাকার মানুষ শ্রদ্ধায় অবনত হয় বোরহান উদ্দিনকে দেখলে। প্রতিবাদী ও নির্লোভ মানুষ হিসেবে তাঁর রয়েছে আলাদা পরিচিতি। এর বাইরে একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ হিসেবেও রয়েছে তাঁর বিশেষ খ্যাতি। একসময়ের কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের তুখোড় নেতা হিসেবে সক্রিয় ছিলেন তিনি। পরে ন্যাপ বিভক্ত হয়ে গেলে তিনি বাংলাদেশ কৃষক সমিতির রাউজান শাখার সভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সহসভাপতি হন। এখনো ওই পদে বহাল রয়েছেন।
সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত বোরহান উদ্দিনের পরনে সাদা পায়জামা ও পাঞ্জাবি ছাড়া আর কোনো পোশাক কখনো দেখা যায়নি। বই পড়া তাঁর বড় শখ। বই কেনাও তাঁর নেশা। বেশি পড়েন ইতিহাস ও রাজনীতির বই। বই পড়ে আদর্শ রাজনীতিবিদ হওয়ার লক্ষ্য ছিল প্রথম জীবনে। এখন কেবল পড়ার আনন্দেই পড়া।
বোরহান উদ্দিনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয় গত ১৫ অক্টোবর। সে সময় তিনি জানান, অনেক বছর আগে দেওয়ানপুর এস কে সেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা করার জন্যে তিন গণ্ডা (এক গণ্ডা সমান দুই শতক) জমি দান করেন। এরপর পাঁচখাইন সম্মিলনী উচ্চ বিদ্যালয় নির্মাণেও দান করেন আড়াই গণ্ডা জমি। শুধু তাই নয়, মাঝিপাড়া আল আমিনী জুমা মসজিদে দিয়েছেন চার গণ্ডা জমি। সম্প্রতি শিক্ষাবৃত্তি ও সামাজিক কাজ করার জন্যে গঠন করেছেন ১০ লাখ টাকার দুটি ট্রাস্ট। এর একটির নাম 'বোরহান উদ্দিন শিক্ষা তহবিল'।
বোরহান উদ্দিনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, শিক্ষা ট্রাস্ট থেকে প্রতিবছর তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি দেওয়া হবে। এর জন্য নোয়াপাড়া পথেরহাটের রূপালী ব্যাংকে পাঁচ লাখ টাকার একটি স্থায়ী আমানত (ফিঙ্ড ডিপোজিট) খোলা হয়েছে। এই ডিপোজিটের বিপরীতে প্রতিবছর যে ৫০ হাজার টাকা আয় হবে, তার মধ্যে এস কে সেন স্কুল অ্যান্ড কলেজকে প্রতিবছর ২০ হাজার টাকা, গশ্চি উচ্চ বিদ্যালয়কে ১৩ হাজার টাকা ও পাঁচখাইন সম্মিলনী উচ্চ বিদ্যালয়ে ১২ হাজার টাকা শিক্ষাবৃত্তি দেওয়ার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। বোরহান উদ্দিন শিক্ষা তহবিলের আওতায় এই বৃত্তি তাঁর জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরও চালু রাখার জন্য এস এইচ সরোয়ার উদ্দিনকে সভাপতি ও সন্তোষ বড়ুয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া একই ব্যাংকে আরো পাঁচ লাখ টাকা স্থায়ী আমানত করেছেন সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার লক্ষ্যে। এই তহবিলের অর্থে প্রতিবছর পালন করা হবে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মৃত্যুবার্ষিকী। আয়োজন করা হবে স্মরণসভা। গঠিত শিক্ষা তহবিলের কমিটিই পালন করবে ওই দায়িত্ব।
বোরহান উদ্দিন জানান, গত ২৯ অক্টোবর পাঁচখাইন সম্মিলনী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথম শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, আরো কিছু জমি বেচার চিন্তা করছেন। সেগুলো বেচতে পারলে আরো কয়েকটি স্কুলে একই রকম বৃত্তি দেওয়া হবে।
পরোপকারী আর নীতির প্রশ্নে আপসহীন এই কমরেড বলেন, 'আমার আরো দুটি বড় ইচ্ছার একটি হলো গণপাঠাগার করা। কেউ যদি এগিয়ে আসে, তাহলে আমি আমার অর্থ দিয়ে এই পাঠাগার করে যেতে চাই। আরেকটি ইচ্ছা হচ্ছে, রাজনীতিবিদদের নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার করার। কিন্তু পারব বলে মনে হয় না।'
বোরহান উদ্দিন আরো বলেন 'নিজের জন্য কিছু চাই না। শিক্ষা ও সমাজ পরিবর্তন হোক, সেটাই আমার চাওয়া। বর্তমান সমাজ যেভাবে চলছে, এভাবে পরিবর্তন সম্ভব নয়। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হলে ব্যক্তি উদ্যোগ কোনো কাজে আসবে না। আমি ছেয়েছিলাম শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক পরিবর্তন। কিন্তু যা শুরু করেছি, তার ফল হয়তো দেখে যেতে পারব না।' বোরহান উদ্দিন শিক্ষা তহবিলের সদস্য দেওয়ানপুর এস কে সেন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীন বলেন, 'এ বৃত্তি বিদ্যালয় তথা সর্বস্তরের শিক্ষার্থীর মধ্যে উৎসাহ বাড়াবে। এ জন্য বোরহান উদ্দিনকে আমরা অভিনন্দন জানাই। এটি অবশ্যই জননন্দিত একটি কাজ।'
আলাপে জানা যায়, বোরহান উদ্দিন চন্দ্রঘোনা নারায়ণ গিরি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য ১৯৭২ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতিতে নিজেকে একনিষ্ঠ করে তোলেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি ৯ সন্তানের জনক। তাঁর বাবা মৃত হাজি আমিন শরীফ।
 

No comments

Powered by Blogger.