বিশিষ্টজনদের কথা-উল্টো পথে হাঁটছে সরকার by পার্থ সারথি দাস

রকার বলেছে, সেবার মান বাড়ানোর জন্যই ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ করা হচ্ছে। কিন্তু বিশিষ্টজনরা বলছেন, এটি একটি খোঁড়া যুক্তি। জনগণের মতামত নিয়ে কিংবা তাদের চাহিদা অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না। তাঁরা এই সিদ্ধান্তকে উল্টোপথে হাঁটার সঙ্গে তুলনা করেছেন। কেউ বলছেন, এটা একটা তুঘলকি সিদ্ধান্ত। এতে নগরবাসীর সমস্যার সমাধান হবে না, বরং সমন্বয়হীনতাসহ বিভিন্ন সমস্যা আরো প্রকট হবে। গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে এ মতামত তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা।


তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, 'ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করার পক্ষে কোনো যৌক্তিক কারণ আমি দেখি না। ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করা হলে প্রশাসনিক ব্যয় বেড়ে যাবে। সমন্বয়হীনতা প্রকট রূপ নেবে। আর্থিক সংকট দেখা দেবে। জনবল নিয়োগ নিয়েও সমস্যা দেখা দেবে। এ ছাড়া বৈদেশিক সাহায্য, বাণিজ্যিক ঋণ, দেনা নির্ধারণে সমস্যা দেখা দেবে।' এই অর্থনীতিবিদ অনেক প্রশ্ন তুলে ধরে বলেন, 'বলা হচ্ছে, জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সেবা বাড়ানোর জন্য সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করা হচ্ছে। তাহলে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও ওয়াসার মতো প্রতিষ্ঠানকেও কেন ভাগ করা হচ্ছে না? এগুলো ভাগ না করে সিটি করপোরেশনকে কেন ভাগ করা হচ্ছে? সিটি করপোরেশনের রাস্তাঘাট নাজুক অবস্থায় আছে। একটির জায়গায় দুটি সিটি করপোরেশন করা হলে, এই নাজুক অবস্থা থেকে কি পরিত্রাণ পাওয়া যাবে? এই সমস্যা তো বছরের পর বছর ধরেই চলছে। দুটি সিটি করপোরেশন করলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে? সারা দেশের সড়কের অবস্থাই তো খারাপ। তাহলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কি ভাগ করা হবে? হঠাৎ করে কেন সিটি করপোরেশন
ভাগ করার চিন্তা মাথায় এল?' তিনি বলেন, যে সিটি করপোরেশন আছে, তাকে ভাঙতে গেলেই সমস্যা হবে। সংবিধানে ঢাকাকে বাংলাদেশের রাজধানী বলা হয়েছে। সিটি করপোরেশন ভাগ হলে এ ক্ষেত্রেও আইনগত জটিলতা দেখা দেবে। সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এ ছাড়া সরকারি অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে জটিলতাও দেখা দেবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, 'ঢাকায় দুটি সিটি করপোরেশন করার উদ্যোগের ক্ষেত্রে জনদাবির প্রতিফলন হচ্ছে না। এখানে সরকারের উদ্দেশ্য অস্পষ্ট। ঠিক একইভাবে ফলাফলও অস্পস্ট। কোথাও স্পষ্টতা নেই। সেবার মান উন্নত করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু দুটি সিটি করপোরেশন করলেই কি সেবার মান বেড়ে যাবে? এখন তো সেবার মান ভালো নয়। এই অবস্থা তো এক দিনে হয়নি। সেবার মান ভালো না হওয়ার কারণ সুশাসনের অভাব, দক্ষতার অভাব, জনবলের অভাব এবং আমলাতন্ত্রসহ বিভিন্ন কারণ। প্রশাসনের আকার মুখ্য কারণ নয়। কিন্তু এটিকেই মুখ্য কারণ ধরে নিয়ে সিটি করপোরেশন দুই ভাগ করার কথা বলা হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে এ ক্ষেত্রে উল্টো পথে হাঁটা শুরু হয়েছে। এতে সমস্যা বাড়বে, কমবে না।'
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করার সিদ্ধান্ত কী জন্য নেওয়া হলো, তা আমরা বুঝতে পারছি না। এটা একটা তুঘলকি সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তের কথা শোনার পর থেকেই আমরা আমাদের অবস্থান তুলে ধরছি। বলা হচ্ছে, সিটি করপোরেশনের সেবার মান ভালো নয়। এই যুক্তি ও কারণ দেখিয়ে ভাগ করার এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে সমাধান আসবে না। উল্টো সমস্যা বেড়েই যাবে। সিটি করপোরেশন থেকে সেবা পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। এটি এক দিনের ঘটনা নয়। কিন্তু এ জন্য কারণ অনুসন্ধান না করেই হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে অনেকে গবেষণা করেছেন। বহু গবেষণাপত্রও আছে আমাদের দেশে। কিন্তু এগুলো থেকেও কোনো সহায়তা নেওয়া হয়নি। কোনো কারণ বের করা হলো না। কারণ না বের করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। আমরা মনে করি সিটি করপোরেশনে সেবার মান না থাকার কারণ হলো অদক্ষতা ও দুর্নীতি। শুধু সিটি করপোরেশন নয়, গোটা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেই দুর্নীতি আছে। সরকার অদক্ষ। সিটি করপোরেশনও অদক্ষ। এ ক্ষেত্রে অনুসন্ধান করলেই কারণ বের হয়ে যাবে। কার মাথা থেকে বের হলো যে সিটি করপোরেশন দুটি করতে হবে?'
হাফিজউদ্দিন খান আরো বলেন, দুটি সিটি করপোরেশন হলে সমস্যা বেড়ে যাবে। সমন্বয়ের ক্ষেত্রে সিরিয়াস সমস্যা দেখা দেবে। দুনিয়ার কোনো শহর দুই ভাগ করে চালানো হচ্ছে কি? ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করার কোনো যুক্তি নেই।

No comments

Powered by Blogger.