অনুবাদ-বুদ্ধিজীবীদের দায়বদ্ধতা-নোয়াম চমস্কি

নোয়াম চমস্কি এ সময়ের একজন বিখ্যাত লেখক, দার্শনিক এবং ভাষাতত্ত্ববিদ। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে 'বোস্টন রিভিউ'য়ে বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর এই প্রবন্ধটির ভাষান্তর করেছেন অনিন্দ্য আরিফ। ধারাবাহিক এই প্রবন্ধটির আজ শেষ পর্ব প্রকাশিত হলো পূর্ব প্রকাশের পরআমরা, বুদ্ধিজীবীরা, ৯/১১ সম্পর্কে কী চিন্তা করি?বোঝা যায়, ৯/১১-র 'বিশ্বকে পরিবর্তন করা' সম্পর্কিত যে অভিমত আছে তার বিস্তৃত মর্মবস্তু
রয়েছে। ওই দিনকার ঘটনার বৃহৎ পরিণতি রয়েছে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে। তার মধ্যে একটি হলো রাষ্ট্রপতি বুশের রোনাল্ড রিগ্যানের 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে'র পূর্ণ ঘোষণা, যাকে অদৃশ্য করে রাখা হয়েছে। আরেকটি পরিণতি হলো আফগানিস্তান, ইরাক এবং অতিসম্প্রতি আরো কয়েকটি দেশে সামরিক আগ্রাসন ও ইরানের প্রতি নিয়মিত হুমকি। এর মূল্য প্রচুরভাবে দিতে হয়েছে। এটি একটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, সেটিও নতুন নয়। এর কোনো বিকল্প ছিল না?
অনেক বিশ্লেষক পর্যবেক্ষণ করে দেখিয়েছেন, বিন লাদেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধে বৃহৎ সাফল্য লাভ করেছেন। সাংবাদিক ইরিক মার্গালোইস লিখেছেন, 'তিনি বারবার ঘোষণা করেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মুসলিম বিশ্ব থেকে বিতাড়িত করবেন এবং এই বলে তাদের কিছু ছোট অথচ ব্যয়বহুল যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেছেন, যা তাদের সর্বস্বান্ত করেছে।' তিনি আরো লিখেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, প্রথমে জর্জ ডাবি্লউ বুশ এবং পরবর্তী সময়ে বারাক ওবামা বিন লাদেনের ফাঁদে পা দিয়েছেন সামঞ্জস্যহীনভাবে প্রচুর সামরিক খরচে এবং ঋণের নেশায় জড়িয়ে পড়েছেন।...সম্ভবত সবচেয়ে ক্ষতিকর মানুষ যিনি চিন্তা করেছিলেন তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করতে পারবেন।
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের আন্তর্জাতিক অধ্যয়নের যুদ্ধ প্রকল্প সংক্রান্ত গবেষণার একটি প্রতিবেদন বলেছে যে এই যুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যয় হলো ৩.২ থেকে ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। বিন লাদেনের চিত্তাকর্ষক অর্জন।
ওয়াশিংটন যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিন লাদেনের ফাঁদে পা দিয়েছে, তার অনেক প্রমাণ রয়েছে। মাইকেল স্কুয়ার একজন সিআইএ বিশেষজ্ঞ, যিনি ১৯৯৬-৯৯ পর্যন্ত বিন লাদেনকে অনুসরণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, 'বিন লাদেন আমেরিকাকে যুদ্ধে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করেছে।' স্কুয়ার আরো লিখেছেন, 'আকস্মিকভাবে মুসলিম বিশ্বের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা নীতিকে পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছেন।'
স্কুয়ার ব্যাখ্যা করেছেন বিন লাদেন বিশালভাবে সাফল্য লাভ করেছেন, 'মার্কিন বাহিনী এবং নীতি ইসলামিক বিশ্বের রাডিক্যালাইজেশনকে সম্পন্ন করতে সাহায্য করেছে। এ ক্ষেত্রে ওসামা বিন লাদেন ১৯৯০-এর শুরুর দিকে পর্যাপ্ত কিন্তু অসম্পূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছেন। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর অপরিহার্য মিত্রতা এখানে সাহায্য করেছিল।'
এটা ভাবার যুক্তিসংগত কারণ আছে যে ৯/১১-এর আক্রমণের ফলে জিহাদি আন্দোলন ভেঙে টুকরো টুকরো এবং দুর্বল হয়ে গেছে। কিন্তু এটি করতে গিয়ে 'মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ' সংঘটিত করতে হয়েছে।
আমি এ ক্ষেত্রে রবার্ট ফিস্কের উপসংহারকে উল্লেখ করতে চাই, যেখানে তিনি বলেছেন, ৯/১১-এর ভয়ংকর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে 'অন্যায় এবং ত্রাসোদ্দীপক নিষ্ঠুরতার' সঙ্গে। এটি একটি সঠিক বিশ্লেষণ। এই অপরাধ আরো খারাপ হতো। চিন্তা করুন, যদি ফ্লাইট ৯৩ পেনিসিলভিনিয়ায় তার সাহসী যাত্রীদের নিয়ে বিধ্বস্ত হতো, কিংবা যদি হোয়াইট হাউসে বোমা ফেলা হতো; যদি এই অপরাধ সংঘটনকারীরা একটি সামরিক একনায়কত্ব স্থাপন করত, যা হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করত এবং লাখ লাখ মানুষকে নিযার্তন করত। ভাবুন, সামরিক একনায়কত্ব স্থাপিত হয়ে গেছে। অপরাধীদের সমর্থনে তারা একটি নির্যাতনকারী এবং সন্ত্রাসী রাষ্ট্র কায়েম করেছে। তারা এক দল অর্থনীতিবিদ জোগাড় করেছে, যাদের 'কান্দাহার বালক' বলে অভিহিত করা হচ্ছে, যারা অর্থনীতিকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মন্দায় নিমজ্জিত করছে। তাহলে তা ৯/১১-এর চেয়েও জঘন্য হতো।
আমরা সবাই জানি, এটি শুধু চিন্তার পরীক্ষা নয়। এটি ঘটেছিল, আমি উল্লেখ করতে চাই, লাতিন আমেরিকার সেই ঘটনা, যাকে প্রথম ৯/১১ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব সফলতার সঙ্গে চিলির সালভাদের আলেন্দের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করেছিল এবং পিনোচেটের নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকারকে ক্ষমতায় এনেছিল। এই সামরিক একনায়কত্বকে মদদ জুগিয়েছিল শিকাগো বালকরা_একদল অর্থনীতিবিদ, যারা শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষিত হয়েছিল। এরা চিলির অর্থনীতিকে নতুন চেহারা দিয়েছিল। চিলিতে যে অর্থনৈতিক ধ্বংসযজ্ঞ চলেছিল, যে অপহরণ এবং নির্যাতন হয়েছিল তা থেকে প্রমাণিত হয়েছে প্রথম ৯/১১ কত ভয়ংকর ছিল।
উৎখাত করার লক্ষ্য_যা নিঙ্ন প্রশাসন থেকে ব্যবহৃত হচ্ছিল_তার অর্থ হলো, সেসব ভাইরাসকে হত্যা করা, যেসব বিদেশি তাদের মান্য করতে বিরোধিতা করবেন। যাঁরা তাঁদের নিজস্ব সম্পদ তাদের হাতে তুলে দিতে বাধা দেবেন এবং ওয়াশিংটনের অপছন্দ স্বাধীন উন্নয়নের নীতি গ্রহণ করবেন। নিঙ্নের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের এই পশ্চাৎপট ছিল এই জন্য যে তারা মনে করত যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকানদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে বিশ্বের অন্যত্র তাদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারবে না।
প্রথম ৯/১১ দ্বিতীয়টির মতো বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারেনি। এটি কোনো বৃহৎ পরিণতি তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু এর একটি ক্ষুদ্র তাৎপর্য রয়েছে।
এই ছোট পরিণতির ঘটনাটি শুধু সামরিক অভ্যুত্থান, যা চিলিয়ান গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; ইতিমধ্যে তা আলোচিত হয়েছে। মূলত প্রথম ৯/১১ ছিল একটি নাটকের অংশ, যা ১৯৬২ সালে কেনেডি প্রশাসন লাতিন আমেরিকায় সামরিক বাহিনীদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত করতে গিয়ে শুরু করেছিল।
এটি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে স্বস্তিদায়ক বুদ্ধিজীবীরা, যাঁরা রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক লক্ষ্য সমর্থন করেন এবং রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক অপরাধকে অবজ্ঞা করেন, তাঁরা তাঁদের সমাজে সম্মানিত হন ও অগ্রাধিকার পান এবং অর্থবহ বুদ্ধিজীবীরা কোনো না কোনোভাবে শাস্তিপ্রাপ্ত হন।

No comments

Powered by Blogger.