টিপাইমুখ নিয়ে অন্ধকারে সরকার-ড. আইনুন নিশাত, নদী, পানিবিশেষজ্ঞ ও উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

ব্দটা আমি ড্যাম ব্যবহার করছি, বাঁধ নয়। বাঁধের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ঊহনধহশসবহঃ। বাঁধ হচ্ছে নদীর সমান্তরাল একটা স্ট্রাকচার, আর ড্যাম হচ্ছে একটা নদীর আড়াআড়ি স্ট্রাকচার। ভারত যদি শুধু ড্যাম এবং রিজার্ভার নির্মাণ করে তাহলে ক্ষয়ক্ষতি হবে জলাবদ্ধতার কারণে। আর ড্যাম এবং রিজার্ভারের সঙ্গে যদি ভারত ব্যারাজ তৈরি করে, তবে ক্ষয়ক্ষতি হবে শুকিয়ে যাওয়ার কারণে। ভারত উপাত্ত পাঠালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ক্ষতির ধরনটা বোঝা


যাবে। সেটার জন্য দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে বসে তথ্যের আদান-প্রদান হওয়া উচিত; কিন্তু তা হচ্ছে না। এই ড্যাম ভারত তাদের পরিবেশের প্রভাবসংক্রান্ত সমীক্ষা চালিয়েই নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বলে মনে করি। আমার ধারণা, তা সম্পূর্ণভাবে হয়নি। কারণ যেকোনো ধরনের পরিবেশের প্রভাববিষয়ক সমীক্ষা করতে গেলে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া কত দূর গিয়ে পড়বে সে হিসাবটাও করতে হবে। সে হিসাব যদি সীমান্তে এসে থেমে যায় তাহলে তো হবে না। তাই পরিবেশের প্রভাবসংক্রান্ত সমীক্ষা আন্তর্জান্তিক মানসম্পন্ন হওয়া উচিত। আমরা যে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছি, সরকারের উচিত হবে বিশেষজ্ঞপর্যায়ে বসে তা নিরূপণ করা।
প্রত্যেকটা ড্যামের সঙ্গে একটা করে স্পিলওয়ে থাকে, যেমন আছে আমাদের কাপ্তাইয়ে। এটি হলো বর্ষায় যদি বেশি পানি আসে তা ছেড়ে দেওয়ার পদ্ধতি। আমাদের কাপ্তাইয়ে ড্যাম আছে_কর্ণফুলীর পানি ধরে রাখে। একইভাবে টিপাইমুখ ড্যাম কাপ্তাই থেকে বড় আকৃতির হলেও মূলত দেখতে একই রকম হবে, সামনে বিরাট একটা জলাধার থাকবে। এটি হলে তিনটি ঘটনা ঘটবে। প্রথমত, বর্ষার প্রথম দিকে পানির পরিমাণ কিছুটা কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, বর্ষার শেষের দিকে যখন জলাধারটা কানায় কানায় পূর্ণ, তখন যদি কোনো কারণে স্পিলওয়ে খুলতে হয়, তাহলে বর্ষার শেষে ভারী বন্যার প্রকোপ বাড়বে। তৃতীয়ত, শীতকালে পানির পরিমাণ বেড়ে যাবে। এখন শীতের মৌসুমে যে পরিমাণ পানি আছে, তার থেকে পানি বেশি হবে। কারণ বর্ষার অতিরিক্ত পানি সারা বছর সমানভাবে ছাড়তে গেলে দেখা যাবে, শীতকালে পানির স্তর বেড়ে গেছে। জলাধারে পানির স্তর বাড়লে নদীতেও পানির স্তর বাড়বে।
বাংলাদেশের জন্য এটা একটা ভয়ের কারণ, ক্ষতির কারণ। কারণ প্রথমত, ওই পাহাড়ি নদীটা এসে যখন আমাদের সুরমা কুশিয়ারা ভ্যালিতে প্রবেশ করবে, তখন হাওর অঞ্চলের পানি কমে যাবে, বোরো ধান উৎপাদন কমে যাবে, কমে যাবে ধানিজমির পরিমাণ, খাদ্য সংকট দেখা দেবে। এটা যদি শুধু ড্যাম, রিজার্ভার, জলাধার এবং স্পিলওয়ে অর্থাৎ জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজটা করে, তবেই এ ধরনের প্রতিক্রিয়া ঘটবে আমাদের দেশের। এগুলো সম্পন্ন হলে দ্বিতীয় যেটি হতে পারে তা হলো ব্যারাজ। ব্যারাজে জলাধার নির্মাণ হয় না। ব্যারাজের কাজ হচ্ছে শীতকালে যখন নদীর পানি নিচে নেমে যাচ্ছে, সেটাকে ওপরে তোলা। নদীর সেই পানি একটা ক্যানেলের মাধ্যমে ডাইভার্ট করা হয়। ওই ক্যানেলের ক্যাপাসিটির ওপর নির্ভর করে কতটা পানি ডাইভার্ট হচ্ছে। টিপাইমুখের এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য আমি জানি না। বাংলাদেশ সরকারকেই এ তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। যদি ভারতের প্রকৌশলী এমন ক্যাপাসিটির ক্যানেল তৈরি করে বরাকের পুরো পানিই তারা নিয়ে নেয়, তাহলে আমাদের সুরমা, কুশিয়ারা শুকিয়ে যাবে। এটি না করে যদি অর্ধেক পানি নেয়, তখন আমরা সমীক্ষা চালিয়ে দেখে বুঝতে পারব।

No comments

Powered by Blogger.