সহজ-সরল-দুঃস্বপ্ন? জেগে জেগেই দেখি! by কনকচাঁপা

স্বপ্ন সুন্দর একটি অনুভূতির নাম। জীবন থেকে পাওয়া ছোট্ট, কিন্তু অনবদ্য উপহার। স্বপ্ন তৈরির কারখানায় দেখা যায় সেটা তৈরির দুটো পর্যায় আছে। প্রথমটি হলো র‌্যাপিড আই মুভমেন্ট বা REM স্লিপ। এ পর্যায়ে চোখ দ্রুত নড়াচড়া করে, মানে 'কম্পাক্ষি নিদ্রা'। এরপর ঘুম চলে যায় নন-রেম বা 'স্থিরাক্ষি নিদ্রায়'। একটা মানুষ তার ঘুমের একটি সেশনে REM-NREM এভাবে পাঁচ-ছয়বার সময় পার করে। ঘুমের কম্পাক্ষি নিদ্রায়ই মানুষ স্বপ্ন দেখে।


মন তার চেতন ঘর থেকে অচেতনের ঘরে যাওয়ার আগে অবচেতন করিডর পার করে। তখনই সে স্বপ্ন দেখে। বৈজ্ঞানিক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, অতৃপ্ত যৌনাকাঙ্ক্ষা বা জাগতিক পাওয়া-না পাওয়াগুলোই স্বপ্নে বেশি ঘোরে। কেউ কেউ নাকি মৃত্যুবাড়ি থেকেও ঘুরে আসে। আসলে ঘুম মানে তো মোটামুটি মৃত্যুই। দেহ থেকে মনোবিচ্ছেদ।
তাই ঘুমানোর আগে মুসলিমরা বলি 'আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া', হে আল্লাহ তোমার হাতে জীবন সোপর্দ করে মৃত্যুর কাছে যাই, তুমি আবার মৃত্যু থেকে আমাকে জীবনের কাছে ফিরিয়ে এনো। সেই স্বপ্ন একটি সুন্দর উপহার এ জন্য বললাম যে আমরা সাধারণ মানুষ দূরে থাক বৈজ্ঞানিকরাও খালি হাতে, মানে যন্ত্র ছাড়া উড়তে পারেননি। প্রাণান্তকর চেষ্টায়ও শেষে কিছু একটা যন্ত্র তাঁদের ব্যবহার করতে হয়ই। পাখির ডানায় ওড়া? স্বপ্ন ছাড়া সম্ভব নয়। তাই স্বপ্ন আমার কাছে ঘুমের মাধ্যমে জীবনের কাছ থেকে পাওয়া সুন্দর উপহার। কোথায় কোথায় না স্বপ্নে উড়ে যাই, উড়ছি তো উড়ছি। বাতাসের মতো হালকা আমার দেহ। নিচের সবাই আশ্চর্য ও ঈর্ষান্বিত। কিন্তু আমি উড়ছি! এমতাবস্থায় স্বপ্ন ভেঙে গেলে মন খারাপ হয়। আবার স্বপ্ন দেখি প্রাণপ্রিয় বাবা আমার পাশে বসে হাসছেন, আদর করছেন, নামাজ পড়ছেন। সে যে কী পাওয়া!
কিন্তু স্বপ্ন ভেঙে গেলে দেখি দুই গাল ভেজা। আমি আর সেই ছোট্ট খুকিটি নেই। ভয়ংকর এক অসহায় এতিম। বাবা তাঁর প্রসারিত হাতখানা গুটিয়ে অন্য অচিনপুরে চলে গেছেন। আমি ভয়ানক অথর্ব। তখন জীবনটা খুব ভারী মনে হয়। জগদ্দল পাথরের চেয়েও। তবু সেই স্বপ্নকে আমার দুঃস্বপ্ন মনে হয় না। মনে হয়, স্বপ্নেই হোক, তবু তো বাবাকে দেখলাম। মনে হয়, 'স্বপন যদি মধুর এমন_হোক সে নিঠুর কল্পনা জাগিও না, আমায় জাগিও না।' কিন্তু দুঃস্বপ্ন দেখি আমি জেগে জেগে। দুঃস্বপ্ন না বলে ভয়ংকর ভবিষ্যতের আশঙ্কা বলাই ভালো। আমি আমার বাংলাদেশের, আকাশ থেকে পাতাল, হাতি থেকে পিঁপড়া_সবই ভালোবাসি। প্রচণ্ড সে ভালোবাসা। কিন্তু এ দেশটার অবনতি, নৈতিক অবক্ষয়, শিক্ষাহীনতা দেখে লজ্জায়, ঘৃণায় আঁতকে ওঠি।
দেশের মানুষগুলো এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? আর কত পাপ করলে আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকবে! সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে ভালো কিছু পেতে হলে? তার আগে ফেরা কি সম্ভব নয়! এই চিন্তাগুলো দুঃস্বপ্ন হয়ে জাগ্রত অবস্থায়ই দেখি। দেখাতে চাই না। ভেসে ভেসে ওঠে। ছটফট করি_কটমট করি। কিন্তু আমি কীই-বা করতে পারি। না আমি জনগণের প্রতিনিধি, না আইনপ্রণেতা, না পরিবেশবিদ। গান গাওয়ার শিক্ষা ছাড়া আর কোনো শিক্ষাই আমার নেই। সামাজিক জীবনের যতগুলো শাখা আছে_খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, বাণিজ্য, পরিবহন, পরিবেশ, প্রতিবেশ_সবগুলো শাখার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে। মানবতা লুণ্ঠিত হয়ে, উলঙ্গ হয়ে, পথের নোংরায় পড়ে আছে। আমার চেয়ে চেয়ে দেখার বেশি কী করার আছে? আমরা যেমন স্রষ্টার ওপর অভিমান করে বলি, মৃত্যুই যদি দিবা তবে জীবন, প্রেম, মায়া, সন্তান, মা-বাবা, পৃথিবী কেন দিলা? তেমনই বলি এ রকম একটা দুর্নীতিগ্রস্ত জায়গায় বাস করতে দিলা, তবে বিবেক কেন দিলা-বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কেন করলা না? হে আল্লাহ, চোখের সামনে এত অরাজকতা সহ্য হয় না। মাঝেমধ্যে ভাবি, কত মানুষ_আমাদের দেশের মানুষই তো কত সাহসী ছিল। তারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছে। আমি তেমন আমার এই একটিমাত্র প্রাণ দেশের কোনো একটা ভালো কাজে উৎসর্গ করি। কত ঘুষ চাওয়া, দাপ্তরিক কাজের দুর্নীতিপরায়ণতা, ট্রাফিকের পয়সা খাওয়া, প্রতিবেশীর পরিচারিকার ওপর অত্যাচার করা, স্কুলশিক্ষকের দুশ্চরিত্রের ছাপের সুস্পষ্ট প্রমাণ দেখা_এই আমি দেখেছি ঘৃণাভরে। তাদের ধরিয়ে দেব, প্রমাণ দেব, তবে তো বাঁচতেই পারব না। খুন নয়, গুম হয়ে যাব_নয় দেশ ছাড়া হয়ে যাব। আমার একটি সংসার আছে। সেখানে পাখি, গাছ, আমার শিশুরা কিচির মিচির করে জীবনকে নাড়া দেয়। মায়ের মুখের হাসি আমার চোখের জ্যোতি বাড়ায়। স্বামীর পরিতৃপ্ত মুখ আমায় গর্বিত করে তোলে। সেগুলো ফেলে ছড়িয়ে ক্ষুদিরাম হয়ে ফাঁসিতে ঝোলা এত সহজ নয়। সুখ, স্বপ্ন, ঝরঝরে ঘুমের মতো জীবনটাও অনেক মূল্যবান। আমার জীবনকে আমি ভালোবাসি অনেক। কিন্তু দেশকেও তো ভালোবাসি, অনেক অনেক! যেমন করেই হোক আমার দেশকে দুঃস্বপ্নমুক্ত করতে চাই। কিন্তু কিভাবে_এই ছাপোষা কেরানির বুদ্ধিতে কিছুই কুলোয় না। দেশের প্রাণময় দীপ্তবান শিক্ষিত মানুষেরা_হে মানুষেরা, কিছু একটা করুন_আমি 'পিঁপড়া' আছি, থাকব আপনাদের সঙ্গে।
লেখক : সংগীতশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.