কল্পকথার গল্প-নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গ! by আলী হাবিব

বানরের পিঠা ভাগের গল্পটা অনেকেই জানেন। একটা পিঠা ভাগ করতে গিয়ে বানর নিজেই সবটা খেয়ে ফেলেছিল। কিন্তু ভাগ করতে গিয়ে ভবিষ্যৎ খেয়ে ফেলার আশঙ্কা কি থাকে?আজকাল রিয়ালিটি শো নামে একধরনের অনুষ্ঠান চালু হয়েছে। সেখানে ভাগাভাগি নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন করা হয়। দুজন মানুষের মধ্যে পাঁচটা বল কেমন করে ভাগ করা হবে কিংবা ৯ জনের মধ্যে ছয়টা বল কি ভাগ করা যাবে_এসব প্রশ্ন করে অংশগ্রহণকারীদের বুদ্ধি পরখ করে দেখা
যায়। কিন্তু একটা শহরকে কেমন করে দুই ভাগ করা যায়_এমন প্রশ্ন কি হয় সেখানে? হলে মন্দ হতো না। শোনা যাচ্ছে, ঢাকা সিটি করপোরেশন নাকি উত্তর-দক্ষিণ_এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। কাজটা ভালো হচ্ছে, নাকি খারাপ হচ্ছে; সঠিক হচ্ছে, নাকি ভুল হচ্ছে_সেটা এখনই সম্যক বলে দেওয়া সম্ভব নয়। যেমন বলা সম্ভব নয় এখনই ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করার সঠিক সময় কি না। সময়ই সেটা বলে দেবে। আপাতত সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করার একটি গল্প বলা যাক। গল্পটি মোটেই আনকোরা বা নতুন নয়। পুরনো।
এক ভদ্রলোক সব সময় স্ত্রীর কাছে গালমন্দ খান। ভালো বাজার করতে না পারলে, এটাই স্বাভাবিক। স্ত্রী নিয়মিত গালমন্দ না করলে অনেকে আবার মনে করেন স্ত্রীর মেজাজ ঠিক নেই। সেই যে ভদ্রলোক, যিনি সব সময় স্ত্রীর গালমন্দ খেতে অভ্যস্ত ছিলেন, সে গল্প তো আমাদের সবারই জানা। তিনি বাড়ি থেকে ফ্রিজ কিনতে বেরিয়ে কথা বলতে পারে এমন এক কুকুর কিনে বাড়িতে ফিরেছিলেন। স্ত্রী যখন কুকুরটির পরীক্ষা নিতে গেলেন, তখনই বিপত্তি। কুকুরটি আর কথা বলে না। ভদ্রলোকের স্ত্রী প্রচণ্ড রেগে কুকুরসহ ভদ্রলোককে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। ভদ্রলোক আবার কুকুরের হাত ধরে পার্কে গিয়ে বসলেন। এবার কুকুরটি বলে উঠল, 'আমার জন্য তোমাকে অনেক হেনস্তা হতে হলো।' ভদ্রলোক প্রচণ্ড খেপে গিয়ে বললেন, 'আরে, এ কথাটুকু বললেও তো আমি বেঁচে যেতাম।' কুকুরটি বলল, 'এই একই কারণে আগের মালিকও আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে। আই অ্যাম রিয়েলি ভেরি স্যরি। আমি আসলে সঠিক সময়ে আসল কাজটি করতে পারি না।'
সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করা সবার দ্বারা সম্ভব হয় না। সিদ্ধান্ত নিতে অনেকে ভুল করে বসেন। অনেকের জন্য অনেক সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হয়ে যায়। কেউ নিজের পায়ে কুড়াল মারলে তো কারো কিছু করার নেই। ঘোরের মধ্যে এমন কাজ অনেকেই করে ফেলতে পারেন। ও নিয়ে আমাদের না ভাবলেও চলবে। আমরা ভাগাভাগিতে যাই। ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করা নিয়ে সরকারের বক্তব্য হচ্ছে, ক্রমবর্ধমান এ মহানগরীর ভালো করার জন্য ভাগ করা হচ্ছে ঢাকা সিটি করপোরেশন। সরকারের এ যুক্তি মেনে তাহলে বলা চলে, যাঁরা এখন সিটি করপোরেশনের বিভক্তি চাইছেন না, তাঁরা এ মহানগরীর উন্নতি চান না, ভালো চান না। একটা পুরনো গল্প এখানে বলা যাক। এক শিশুসন্তানকে নিয়ে দুই নারীর মধ্যে বচসা। দুজনেরই দাবি সন্তানটি তার। বিচার গেল বাদশাহর কাছে। ভরা দরবারে বাদশাহ ডাকলেন জল্লাদকে। বললেন, শিশুটিকে কেটে দুভাগ করে দাবিদার দুই মায়ের হাতে তুলে দিতে। তার আগে জানতে চাইলেন, বিচারপ্রার্থীরা এ বিচারে খুশি কি না। এক নারী এ বিচার মেনে নিলেন। অন্য নারী বললেন, 'বাদশাহ নামদার, শিশুটিকে ওই মহিলার হাতে তুলে দিন। ওকে দুই টুকরো করার প্রয়োজন নেই।'
কেন ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করার কথা আসছে? ঢাকার ভালো করার জন্য। এত বড় একটা নগরী। মহানগরী ঢাকা। এর রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমতো করার জন্য ঢাকাকে দুই ভাগে ভাগ করা দরকার হয়ে পড়েছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। যেমন_সংসার বড় হয়ে গেলে পৃথক হয়ে যাওয়ার একটা প্রচলন বাংলাদেশে আছে, যে সূত্র ধরে ভেঙে যাচ্ছে যৌথ পরিবার প্রথা। অনেকটা সে রকমই একটা যুক্তি দেখানো হচ্ছে। সেই যুক্তি মানতে রাজি নয় আরেক পক্ষ। সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আরেক পক্ষ বলছে, ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনেই সরকারপক্ষ ঢাকাকে দুই ভাগে ভাগ করতে চায়। বর্তমান মেয়র তো ঢাকা সিটি করপোরেশনের খণ্ডতা রক্ষার আবেদন জানিয়ে নিজের প্রার্থিতাই প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর এই ঘোষণার পর ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভাজনের কোনো বিকল্প বোধ হয় সরকারের হাতে থাকল না। কারণ তিনি এককভাবে নিজেকে সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিলেন। ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভাজন রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, নাকি বোকামি_এটা কিন্তু এখন রাজধানীবাসীকে ভাবতে হচ্ছে। আমরা এখন একটা বোকামির গল্প বলি। বীরবলের গল্প।
সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভার বীরবলের কথা অনেকেই জানেন। তিনি হাস্য-কৌতুকের আবরণে কোনো ব্যক্তি বা ঘটনার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতেন। একবার সম্রাট আকবর বীরবলকে আদেশ দিলেন, তাঁর রাজ্যের সবচেয়ে বোকা চার লোককে ধরে নিয়ে যেতে হবে। সম্রাটের হুকুম বলে কথা! বীরবল সময় চেয়ে বোকা লোক খুঁজতে দরবার থেকে বেরিয়ে গেলেন। রাস্তায় বীরবল দেখলেন, একজন লোক বিরাট কাঁসার বাসনে করে কিছু ঝলমলে কাপড়-চোপড়, পান ও মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছে। কৌতূহলী মনে বীরবল লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তুমি এসব জিনিস নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?' লোকটি বলল, 'আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে অন্য একজনকে বিয়ে করেছে। তাদের একটা সন্তানও হয়েছে। তাদের জন্য এই উপহার নিয়ে যাচ্ছি।' বীরবল ভাবলেন, এই হতভাগাটার মতো দ্বিতীয় কোনো বোকা লোক এই রাজ্যে বোধ হয় আর নেই। বীরবল তার নাম-ঠিকানা রেখে পথ চলতে লাগলেন।
কিছুটা পথ পেরিয়ে বীরবল দেখলেন, এক লোক মোষের পিঠে চড়ে যাচ্ছে এবং লোকটার মাথায় বিরাট একটা ঘাসের বোঝা। বীরবল জিজ্ঞেস করলেন, 'তুমি মোষের পিঠে যাচ্ছ, কিন্তু ঘাসের বোঝা নিজের মাথায় বইছ কেন?' লোকটা বলল, 'আজ্ঞে মহাশয়, আমার মোষটা গর্ভবতী। তার পিঠে বেশি ওজন দেওয়া ঠিক হবে না। আমাকে পিঠে নিয়ে হাঁটতেই মোষটার কষ্ট হচ্ছে। তাই ঘাসের বোঝা মোষের পিঠে না দিয়ে আমার মাথায় করে নিচ্ছি।' বীরবল ভাবলেন, এই মোষঅলা আরেক বোকা। তার নাম-ঠিকানা নিয়ে বীরবল চলে গেলেন।
কয়েক দিন পরে বীরবল এই দুজনকে সম্রাট আকবরের দরবারে হাজির হলেন। বললেন, 'হুজুর আপনার রাজ্যে বাস করা বোকাদের দরবারে নিয়ে এলাম।' সম্রাট বললেন, 'এখানে তো মাত্র দুজন। আমি বলেছিলাম চারজন বোকা ধরে আনতে।' বীরবল করজোড়ে বললেন, 'জাঁহাপনা, বোকাদের খুঁজে খুঁজে ধরে এনে আমি হয়েছি তৃতীয় বোকা। আর বোকাদের ধরার আদেশ দিয়ে আপনি হলেন চতুর্থ বোকা। সব মিলে আমরা হলাম চার বোকা।'
তো নিন্দুকদের কথাতেই আসা যাক। নিন্দুকদের ধারণা, ঢাকা সিটি করপোরেশন দুই ভাগে ভাগ করা গেলে অন্তত একটির মেয়র পদ ক্ষমতাসীন দল পাবে। আর সে জন্যই ভাগ করা হচ্ছে ঢাকা সিটি করপোরেশন। এই ধারণা সঠিক হলে বলতে হবে, এটা হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের স্বপ্ন। আবার সরকার বলতে পারে, এটা নিন্দুকদের কল্পনা। এবার এই কল্পনা ও পরিকল্পনা নিয়ে একটি গল্প বলা যাক। গোপাল ভাঁড়ের গল্প।
গোপালের এক দরিদ্র প্রতিবেশী অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো করার চিন্তায় সব রকম দিবাস্বপ্নে বিভোর থাকত। একদিন সে তার স্ত্রীকে বলল, 'আমার কিছু টাকা হলে কয়েকটা গাভি কিনব।' স্ত্রী বলল, তাহলে তো ভালোই হয়। আমাদের অনেক দুধ থাকবে। দুধ দিয়ে ঘি ও মাখন বানাব।' স্বামী বলল, 'দুধ ও ঘি বিক্রি করে অনেক টাকা রোজগার করতে পারব।' স্ত্রী বলল, 'বেশি দুধ হলে আমার বোনকে কিছুটা দিতে পারব।' স্বামী বলল, 'সে কি কথা? তোমার বোনকে কোনো দুধ দেওয়া যাবে না। বরং অতিরিক্ত দুধ বিক্রি করে সংসারে আরো টাকা আনব।' এভাবে বাদানুবাদে স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। স্বামী একসময় ভীষণ রেগে গিয়ে বলল, 'আমি যখন বাড়িতে থাকব না তখন আমার অনুপস্থিতিতে যেন তোমার বোনকে চুপি চুপি দুধ দিতে না পারো তার ব্যবস্থা আমি করছি।' এই বলে সে বাড়ির হাঁড়িগুলো ভাঙতে লাগল। বলল, 'তোমার হাঁড়ি সব ভেঙে দিচ্ছি। হাঁড়ি না থাকলে তুমি তোমার বোনকে আর দুধ দিতে পারবে না।'
তখন ওই বাড়ির পাশ দিয়ে গোপাল যাচ্ছিলেন। লোকটিকে হাঁড়ি ভাঙতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন হাঁড়ি ভাঙার কারণ। সব শুনে গোপাল তাঁর হাতে থাকা বাঁশের লাঠিটা মাথার ওপর তুলে শূন্যে খোঁচা দেওয়ার মতো করতে লাগলেন। গোপালের ব্যবহার দেখে প্রতিবেশী জিজ্ঞেস করল, 'গোপাল বাবু, তুমি লাঠি দিয়ে শূন্যে খোঁচা দিচ্ছ কেন?' গোপাল উত্তর দিলেন, 'তোমার গরু তাড়িয়ে দিচ্ছি। তারা আমার সবজি বাগানের শসা খেয়েছে।' লোকটি অবাক হয়ে বলল, 'তোমার বাগানের শসা খেয়েছে? তোমার তো কোনো সবজি বাগানই নেই! শসা আসবে কোত্থেকে?' গোপাল বলল, 'একদিন আমার বাগান হবে। তখন বাগানে অনেক শসা ফলবে।' এ কথা বলে গোপাল আবার আকাশের দিকে লাঠি দিয়ে খোঁচা দিতে থাকলেন। এতক্ষণে প্রতিবেশী বুঝতে পারল, সে ভুলে নিজের বাড়ির হাঁড়ি ভেঙেছে। সে গোপালকে ধন্যবাদ দিল তার ভুল ভাঙানোর জন্য।
যেমন_কবি কালীদাস গাছের ডালের আগায় বসে সেই ডালেরই গোড়া কাটছিলেন, এই যুগে এসে তেমনটি কেউ করলে কী আর করার আছে? আবদার রশীদ তাঁর ছড়ায় লিখেছেন, 'ভিটেমাটি সবকিছু ভাগ করে নেব/আমি যদি ভিটে পাই তোকে মাটি দেব।' দেখা যাক, কার রাজনৈতিক ভিটে কতটা শক্ত হয়।

লেখক : সাংবাদিক
যধনরন.habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.