স্মরণ-তুমি রবে নীরবে...

তকাল ছিল ড. আবু ইউসুফ আলমের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। জগতের কোনো কিছুই তো থেমে নেই। সবই চলছে আগের মতো। অবিরাম আপন গতিতে। নেই শুধু তুমি। তোমার অমলিন হাসি। আমাদের সবচেয়ে কাছের, একান্ত নির্ভরতার ঠিকানাটুকু অগুনতি হৃদয়ের ভালোবাসার বিনি সুতোর বাঁধন ছিঁড়ে কোন অভিমানে না ফেরার দেশে চলে গেলে! দুর্বোধ্য সৃষ্টিকর্তা বুঝিবা তোমাকে আগেই কাছে পেতে চেয়েছিলেন! কিন্তু কেন এ অকাল মিলন?
কেন একজনের মিলনের কারণে সহস্রের বিরহ? এই 'কেন'র উত্তর জানি কখনোই পাব না। তবু গত একটি বছর বারবার মনকে প্রশ্ন করেছি। প্রবোধ দিতে চেয়েছি। কিছুতেই পোড়া মন মানে না। ছুটে যাই তোমার ছায়ার পরশ লাগা সবুজের গালিচায় ঢাকা প্রিয় ক্যাম্পাসে। হাতড়ে বেড়াই এখানে-সেখানে। তোমার আসনটি পড়ে আছে নিষ্প্রাণ, কিন্তু দ্রোহের স্পর্ধা নিয়ে, সতত আপসহীন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ আলম আর কোনো দিনই ফিরে আসবেন না। কেউ আসেনি। কেউ আসে না।
সেশনজটমুক্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর মনে-প্রাণে। এ জন্য উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই শুরু করেন অন্তহীন কর্মযজ্ঞ। সন্তানদের শিক্ষাজীবনের ব্যাপারে সচেতন করতে অভিভাবকদের কাছে পাঠানো হয়েছিল চিঠি। আর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোর্স সম্পন্ন করার তাগাদা দিয়ে শিক্ষকদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল অনুরোধপত্র। এমনকি কমানো হয়েছিল শিক্ষা ছুটিও। এ সিদ্ধান্তে শিক্ষকরা প্রথমে নাখোশ হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে ছাড় দিয়েছিলেন সবাই। তাঁর সুযোগ্য পরিচালনায় আর সবার সহযোগিতায় স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় বিদায় নিতে চলেছিল সেশনজট। আবাসিক হলগুলোতে আসন বণ্টনে তাঁর কাছে প্রাধান্য পেয়েছিল মেধা। এ জন্য বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের বিরাগভাজন হতে হয়েছিল তাঁকে। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে স্বাধীনতার স্মারক ভাস্কর্য প্রাঙ্গণে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা নিয়ে রূপ দেন 'স্বাধীনতার ম্যুরাল চিত্র'। সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ হিসেবে তিনি সব সময়ই চাইতেন ক্যাম্পাসে লেখাপড়া ও গবেষণার পাশাপাশি মুক্তবুদ্ধি ও সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা হোক। যেকোনো মূল্যে তিনি তা বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর সময়ে দুবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে স্মরণকালের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য তিন দিনব্যাপী বৈশাখী উৎসব উদ্যাপন করেছিলেন। যেখানে হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ ঐতিহ্যগুলো তুলে ধরা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো 'বিশ্ববিদ্যালয় দিবস' উদ্যাপন করেছিলেন তিনি। তিনি এ মর্ত্যে নেই_এ রিক্ততা কেবলই বেদনার। শূন্যতার বীণা বেজে ওঠে হৃদয়ের কোনো সূক্ষ্ম তন্ত্রীতে। তিনি আর কোনো দিন হাসিমুখে জানতে চাইবেন না_আটপৌরে জীবনের ধূসর পঞ্জি। নিজেকে আজ বড্ড বেশি অসহায় মনে হয় এ কারণে যে অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ আলম নামের মহীরুহের যে ছায়ায় খুঁজে পেতাম অনাগত জীবনের শঙ্খধ্বনি।
শিপক কৃষ্ণ দেবনাথ

No comments

Powered by Blogger.