হুবহু-টিপাইমুখ বাঁধ কোনোভাবেই বাংলাদেশের উপকারে আসবে না

পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ জাহিদুল ইসলাম। পিএইচডি গবেষক (পানিসম্পদ কৌশল), ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টা, কানাডা এবং সাবেক শিক্ষক, পানিসম্পদ কৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। সম্প্রতি উভয় দেশের বিতর্কিত সমস্যা টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন আমাদের সঙ্গে_বন্যা আসলে কি কমবে?বরাক নদের ভাটির দিকের অঞ্চল সিলেটের হাওর এলাকায় বর্ষার শুরুতে আগাম বন্যা হয়, আবার বর্ষার শেষের দিকে পানি


কমে আসে। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পর বর্ষার শুরুতে রিজার্ভারে পানি ধরে রাখার প্রয়োজন পড়বে, আবার বর্ষার শেষের দিকে পানি ছেড়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। ফলে বর্ষার শুরুতে বন্যা কমে আসতে পারে আবার বর্ষার শেষে বন্যার প্রকোপ বাড়তে পারে। এর প্রভাব বাংলাদেশের ওপরেও পড়বে। অর্থাৎ বন্যামুক্ত হওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, তা পুরোপুরি সঠিক নয়; যেটি হতে পারে তা হলো বন্যার স্বাভাবিক সময় পরিবর্তিত হতে পারে।

তাহলে ভাটির দেশ বাংলাদেশের সমস্যাটি কোথায়?
এ ছাড়া বাঁধের কারণে এর উজানে জলাধারে সব পলি সঞ্চিত হবে, ফলে যে পানি ভাটিতে আসবে তাকে এককথায় বলা যায় 'রাক্ষুসে পানি'। এই পানি পলিমুক্ত বলে এর পলিধারণ ক্ষমতা অনেক বেশি আর তাই এটি বাঁধের ভাটিতে ১০০ থেকে ১৫০ কিলোমিটারব্যাপী ব্যাপক নদী ক্ষয়ের সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশ বাঁধের ২০০ কিলোমিটার ভাটিতে থাকায় এই বিপুল পরিমাণ পলি বরাক নদ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। কিন্তু পানির প্রবাহ তুলনামূলক কমে যাওয়ায় পলি বহন করার ক্ষমতা কমে যাবে এবং তা সুরমা ও কুশিয়ারার বুকে জমা হবে। এতে নদীর নাব্যতা ও গভীরতা হ্রাস পাবে। সে ক্ষেত্রে আগে যেটা স্বাভাবিক বর্ষাকালীন প্রবাহ ছিল প্রকারান্তরে তা বন্যা আকারে আসতে পারে এ এলাকায়।
আর যদি ধরেই নিই যে বাঁধের ফলে সিলেট আর মৌলভীবাজার এলাকা বন্যামুক্ত হবে, সেখানেও প্রশ্ন আসে, এই তথাকথিত বন্যামুক্ত হওয়া কতটা ইতিবাচক? এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞ ড. জহির উদ্দীন চৌধুরী বলেন, 'সাধারণভাবে আমরা ধরে নিই যে বন্যার সময় যদি পানি কমানো যায় এবং শুষ্ক মৌসুমে যখন পানির পরিমাণ কম থাকে তখন পানির সরবরাহ বাড়ানো যায়, এটা খুবই ভালো একটি বিষয়। সে বিবেচনা থেকেই ভারত টিপাইমুখ বাঁধের পেছনে তাদের যুক্তি হিসেবে এ বিষয়টি তুলে ধরেছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখানে রয়েছে বিশাল জলাভূমি ও অসংখ্য হাওর। এর একটি নিজস্ব ইকোসিস্টেম রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে এখানে বর্ষার সময় পানি বাড়বে, বন্যা হবে ও শুষ্ক মৌসুমে অনেক এলাকা শুকিয়ে যাবে_এর ওপর ভিত্তি করেই সেখানকার ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে। ফলে বন্যার পানি কমা বা শুষ্ক মৌসুমে পানি বেশি পাওয়ার যে আশ্বাস ভারত দিচ্ছে, তা এই এলাকার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।'

শুষ্ক মৌসুমে অধিক পানি কি ইতিবাচক?
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের হাওরগুলো শুষ্ক মৌসুমে যখন শুকিয়ে যায় তখন কৃষকরা সেখানে বোরো ধান বপন করে, যা এ অঞ্চলের একমাত্র ফসল। এই ধান বর্ষা আসার আগেই ঘরে ওঠে, যা এ লোকগুলোর বছরের একমাত্র শর্করার জোগান দেয়। বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানিপ্রবাহ বেড়ে গেলে এ এলাকার চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। আর যদি ধরেও নিই যে এই বর্ধিত প্রবাহ চাষাবাদের জমিকে খুব বেশি প্লাবিত করবে না, সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন থেকে যায়, এই জমিগুলোয় বন্যার সময় প্লাবিত হওয়ায় বিপুল পরিমাণ পলি জমে। এখন বর্ষা মৌসুমে পানি কমে যাওয়ায় তা আগের মতো আর প্লাবিত হবে না, ফলে জমিগুলো তাদের উর্বরতা হারাবে। সুতরাং ফুলেরতল ব্যারাজ না হলেই টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক_এই যুক্তি অসার ও বিভ্রান্তিমূলক।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : শামা মাহজাবীন

No comments

Powered by Blogger.