মাহমুদুর রহমানের মন্তব্য প্রতিবেদনঃ আবদার মিটেছে অধিকার মেলেনি

ড. মনমোহন সিংয়ের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে আমার তিন কিস্তির লেখার প্রথমটার শিরোনাম ছিল— ‘তিস্তা আমাদের অধিকার করিডোর ওদের আব-দার’। বাংলাদেশের কট্টর ভারতপন্থী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনি’র আগাম বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও ভারতীয় পক্ষের অনমনীয়তায় শেষ পর্যন্ত তিস্তা চুক্তি না হওয়ার প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা এদেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য ঘোষণা করেছিলেন, তিস্তার পানির বণ্টন যেহেতু হলো না তাই বাংলাদেশ করিডোরেও সম্মত হচ্ছে না। অর্থাত্ ভারত তিস্তার পানি দিলে বাংলাদেশও করিডোর দেবে। আমাদের আপত্তিটাও সেখানেই ছিল। তিস্তার পানি এবং করিডোর কোনোভাবেই বিনিময়যোগ্য কোনো পণ্য বা সুবিধা নয়। কেন নয়, তার ব্যাখ্যা সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখের লেখা মন্তব্য-প্রতিবেদনে দিয়েছি। তাই আজ আর পুনরাবৃত্তি করছি না।

জনগণ অবস্থার ভয়াবহতার কতটুকু বুঝছেন জানি না। তবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আজকের অবস্থা আরও নাজুক। ভারত তার করিডোরের আবদার ড. মনমোহনের সফরের পরপর তিস্তার পানি না দিয়েই ঘাড় ধরে আদায় করে নিয়েছে। আশুগঞ্জ নৌবন্দরে এখন রাতদিন ভারতীয় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস চলছে। সেই পণ্য ট্রাকে চড়ে আখাউড়া হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে ত্রিপুরায়। এদিকে আমাদের তিস্তাপাড়ের মানুষ গালে হাত দিয়ে বসে অপেক্ষা করছেন, কবে আসবে শেখ হাসিনা এবং দীপুমনি প্রতিশ্রুত সেই পানি! সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে দীপুমনি ক্ষেপে উঠে বলছেন—আমি গণক নই। পানি কবে আসবে তার আমি কী জানি? আসলে কোনো অধিকারই অধিকার নয়, যদি সেটি আদায় করে নেয়া না যায়।
পুরনো প্রবচনের কথা বলি, শিশু না কাঁদলে মাও নাকি দুধ দেয় না। এ ক্ষেত্রে দুর্বল শিশুর কান্নাটাই মোক্ষম অস্ত্র। জননীর কাছে তার দাবি আদায়ের হাতিয়ার। আর বাংলাদেশের একশ্রেণীর নাগরিকের কাছে পরম পূজনীয় ভারতমাতা তো চরিত্রগতভাবে আমাদের এক বলদর্পী সাম্রাজ্যবাদী প্রতিবেশী। তার ওপর এ দেশের সরকারে আছে সে দেশেরই ঘোষিত দালালশ্রেণী। সুতরাং, ষোল কোটি জনতা কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমে অচেতন থাকবে আর দেশের অধিকার আপনাতেই আদায় হয়ে যাবে, সে আশা দুরাশা মাত্র। কুম্ভকর্ণের মতো এ জাতিরও ঘুম একদিন নিশ্চয়ই ভাঙবে। কিন্তু, সেদিন স্বাধীন দেশের আর অস্তিত্ব থাকবে না। আর্য আক্রমণে ভস্মীভূত একদা স্বর্ণপুরী লঙ্কার মতো আমাদেরও ছাইয়ের গাদায় সর্বস্ব খুঁজতে হবে। পানির অধিকার না দিয়ে করিডোরের আবদার হাসিল করে নেয়া বাংলাদেশের সেই চূড়ান্ত সর্বনাশেরই ইঙ্গিত মাত্র।
পত্রিকা পাঠক মাত্রই জানেন করিডোরের আয়ে বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুরে পরিণত করার অবাস্তব ও মিথ্যা স্বপ্ন বছরের পর বছর ধরে কোনো একটি গোষ্ঠী দেখিয়েছিল। আর্থিক উন্নতির মুলা জনগণের নাকের সামনে ঝুলিয়ে রাখার নির্মম প্রতারণায় আওয়ামী রাজনীতিবিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সিপিডি’র নেতৃত্বে ভারতপন্থী সুশীল (?) সমাজ অংশ নিয়েছিল। আর প্রিন্ট মিডিয়ার মধ্যে ট্রানজিটের নামে করিডোর দেয়ার পক্ষে লাগাতার ওকালতি করেছে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার। গত পাঁচ বছরে এ সম্পর্কে বহুবার লিখেছি। তাই আজ আর পুরনো কথা লিখছি না। তবে সিপিডি’র দীর্ঘদিনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ও বর্তমানের সিনিয়র ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের কৌশলের তারিফ না করে পারছি না। মইন-ফখরুদ্দিনের যৌথ আধা সামরিক সরকারে চাকরি বাগানোর আগ পর্যন্ত তিনিই সিপিডি’র মুখ্য কর্মকর্তা ছিলেন। সেই সময় সিপিডি ট্রানজিট নিয়ে যত সেমিনার করেছে, তার প্রধান লক্ষ্যই ছিল ভারতকে ট্রানজিটের মোড়কে করিডোর দেয়ার পক্ষে জনমত গড়ে তোলা। প্রফেসর রেহমান সোবহান, ড. রহমতউল্লাহ প্রমুখ সেসব সেমিনারে ভারতের দালালদের সঙ্গে নিয়ে কোনোরকম সমীক্ষা কিংবা গবেষণা ছাড়াই বছরে বিলিয়ন ডলার আয়ের কল্পকাহিনীর ফানুস উড়িয়েছেন।
তাদের সেইসব বালখিল্য দাবি অধিকাংশ পত্রিকার প্রথম পাতায় ফলাও করে ছাপাও হয়েছে। তাতে জনগণ যে যথেষ্ট পরিমাণেই বিভ্রান্ত হয়েছে, তার প্রমাণ বিনা গণপ্রতিরোধে প্রায় নিঃশব্দে আশুগঞ্জ হয়ে আখাউড়ার মধ্য দিয়ে সরকারের ভারতকে করিডোর প্রদান। আমরা কয়েকজন যারা চোখে আঙুল দিয়ে অবিরাম প্রকৃত অবস্থা দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি, তারা মিডিয়ার অসহযোগিতায় কল্কে পাইনি। আমাদের মতো বাংলাদেশপন্থীদের ভারতবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক ইসলামিস্ট রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। জনগণের কাছে ‘চান্স এডিটর’ মাহমুদুর রহমানের তুলনায় ড. দেবপ্রিয়দের কথাবার্তা অনেক ভার-ভারিক্কি মনে হয়েছে। সেই ড. দেবপ্রিয় দেশের চূড়ান্ত সর্বনাশের আয়োজনে দেড় দশক ধরে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার পর এখন সুযোগ বুঝে ভবিষ্যতে জনরোষের ভয়ে ভোল পাল্টানোর চেষ্টা করছেন। তার সেই চেষ্টা যে আবারও সফল হতে যাচ্ছে, তার প্রমাণ সিরাজুর রহমানের মতো বিজ্ঞ কলামিস্টও ট্রানজিটের বিরুদ্ধে যুক্তি খাড়া করতে গিয়ে ড. দেবপ্রিয়’র বক্তব্যেরই শরণাপন্ন হয়েছেন।
গত বুধবার ৫ অক্টোবর আমার দেশ পত্রিকায় ভারতকে ট্রানজিট দান প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা কলামে তিনি ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে ভারতীয় জাহাজকে নানাভাবে ভর্তুকি সুবিধা প্রদানের কথা লিখেছেন। সিরাজুর রহমানের লেখায় তথ্য ঠিকই আছে। কিন্তু, যাকে উদ্ধৃত করে তিনি যুক্তি খাড়া করছেন, তার নিয়ত নিয়ে যে সন্দেহ রয়েছে, আমি শুধু এটুকুই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। প্রচারের কল্যাণে হয়তো কোনো একদিন আমাদের শুনতে হবে ভারতের সঙ্গে দরকষাকষি করে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষায় এই সুশীলরাই (?) তাদের ওপর অর্পিত মহান দায়িত্ব পালন করে দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন! ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান, প্রফেসর এমাজউদ্দীন, প্রফেসর মাহবুবউল্লাহ এবং আওয়ামী বলয়ের বাইরের অন্যান্য প্রকৃত দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীরা, যারা করিডোরের বিরুদ্ধে অবস্থান থেকে কখনই বিচ্যুত হননি, তারাই বরং হারিয়ে যাবেন। এখন যেমন টেলিভিশনে এক এগারোর নিত্য নতুন বিরোধিতাকারীদের ‘অমৃত বচন’ আমাদের সহ্য করতে হচ্ছে। অথচ সেই সময় অবৈধ সরকারের সমালোচনাকারীদের মধ্যে টেলিভিশন টক শোতে আসাফ্উদ্দৌলাহ্ ও নূরুল কবীর এবং লেখালেখিতে ফরহাদ মজহার ও এই অলেখক মাহমুদুর রহমান ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। টেলিভিশনে কখনও সখনও ডাক পেলে ফরহাদ ভাই এবং আমি জেনারেল মইন নিয়ন্ত্রিত সরকারের স্বরূপ উন্মোচন প্রথম দিন থেকেই করেছি। অনুকূল পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করিনি।
বিশেষ প্রকৃতির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বছরখানেক অতিক্রান্ত হওয়ার পর মইন-মাসুদ গং চূড়ান্তভাবে জনসমর্থন হারালে অবশ্য মরসুমি পাখির অভাব হয়নি। বাজি ধরে বলতে পারি, করিডোরের বিরুদ্ধে শেষ অবধি জনগণ জেগে উঠলে আমরা একই চিত্রের পুনরাবৃত্তি দেখতে পাব। ড. দেবপ্রিয়’র মতো সুশীলদের কনুইয়ের ধাক্কায় আমরা পথিপার্শ্বে পড়ে রইব, জয়মাল্য উঠবে ব্রাহ্মণদেরই গলায়। তাতে কোনো ক্ষোভ নেই। সময়ের প্রয়োজন মেটাতে পারলেই আমি আনন্দিত।
ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি নিয়ে সরকার যে জনগণকে অব্যাহত প্রতারণা করে চলেছে, সে কথাটি গত বছর জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার ভারত সফরের পরই আমার দেশ পত্রিকায় বলার চেষ্টা করেছি। সত্য বলার অপরাধে অবধারিতভাবে এক সময় জেলে গেছি, নির্যাতিতও হয়েছি। ২৯০ দিন জেলবাস শেষে জনগণের দাবির মুখে মুক্তি পেয়ে আবারও লেখালেখিতে আগের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে জনগণকে জাগানোর চেষ্টা করছি। বার বার বলেছি, ভারতের ট্রানজিটে বাংলাদেশের কোনো ফায়দা নেই। আশুগঞ্জ ট্র্যাজেডি দেখার পর আমাদের কথার সত্যতা আজ প্রমাণিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো—মহাজোট সরকারের আগা থেকে গোড়া মিথ্যাচারে অভ্যস্ত। বিনা ফিতে করিডোর প্রদানের পরও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনি জোর গলায় বলে যাচ্ছেন, আইন অনুযায়ী চার্জ নিয়েই করিডোর দেয়া হচ্ছে। যেখানে সরকার এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তির কথা স্বীকার করেনি, রাজস্ব বোর্ড থেকে ট্রানজিট ফি নেয়ার জন্য কোনো পরিপত্র (SRO) জারি হয়নি, সেখানে ফি নেয়ার যে কোনো সুযোগই নেই সেটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জুনিয়র কর্মকর্তারও জানা উচিত। কিন্তু, এই সামান্য ব্যাপারটি দীপু মনি জানেন না অথবা না জানার ভান করছেন। এই মিথ্যাচারের পর পৃথিবীর যে কোনো সভ্য, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হতো। বাংলাদেশের কথা অবশ্য আলাদা। ভারতের আশীর্বাদ যার মাথায়, তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরানোর সাধ্য কার!
অপশাসন এবং সীমাহীন দুর্নীতির মহোত্সবের ফলে মহাজোট সরকার দেশে জনসমর্থনহীন এবং আন্তর্জাতিক মণ্ডলে বন্ধুহীন হয়ে ক্রমেই অধিক মাত্রায় ভারতনির্ভর হয়ে পড়ছে। সেই কারণে ভারতের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আওয়ামী মিডিয়ায় বহুল প্রশংসিত ‘তিস্তার পানি ছাড়া করিডোর নয়’ নীতি থেকে সরে আসতে হয়েছে। ড. গওহর রিজভী এবং ড. মসিউর রহমানরাই জয়যুক্ত হয়েছেন। বিদেশি নাগরিক ড. গওহর রিজভী ভারতকে করিডোর প্রদানে আর একদিনের বিলম্বও সহ্য করতে রাজি ছিলেন না। করিডোর দেয়া হয়েছে, সুতরাং তাকে আর অপেক্ষার যাতনা সহ্য করতে হচ্ছে না।
ড. মসিউর রহমান যে অসভ্য প্রজাতির নন, সেটি প্রমাণের জন্য ভারতের কাছ থেকে কোনো ফি নিতে চাননি। বিনা ফি-তে করিডোর দিয়ে আওয়ামী লীগ তার সেই সভ্যতার প্রমাণ দিয়েছে। বিনা চুক্তিতেই ভারতকে ফ্রি ট্রানজিট দিয়ে শেখ হাসিনা তার নড়বড়ে মসনদ রক্ষা করতে চাইছেন। ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতকে অধিকতর খুশি করার আতিশয্যে তিনি এবারের দুর্গাপূজা নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে তার আপন ধর্মবিশ্বাস কোথায় গেছে সে বিবেচনা তার এবং ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেমদের। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যে কী পরিমাণ ধর্মনিরপেক্ষ এবং ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত, সেটি প্রমাণ করার জন্যই বোধহয় ঢাকেশ্বরী মন্দির ও রামকৃষ্ণ মিশন পরিদর্শনকালে বলেছেন, ‘আমরা জানি এবং শুনেছি মা দুর্গা প্রত্যেক বছর কোনো না কোনো বাহনে চড়ে আমাদের এ বসুন্ধরায় আসেন। এবার আমাদের দেবী এসেছেন গজে চড়ে। জানি, গজে চড়ে এলে এ পৃথিবী ধন-ধান্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে—তা আমরা দেখতেই পাচ্ছি। এবার ফসল ভালো হয়েছে।’
এ ধরনের বিশ্বাস হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের থাকতেই পারে। একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দুর দেবী অর্চনা এবং পূজা-আচ্চা সেই ধর্মবিশ্বাসেরই প্রতিফলন। সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার সাংবিধানিক দায়িত্ব হচ্ছে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা আয়োজনে যথাসম্ভব সহায়তা প্রদান করা। কিন্তু একজন মুসলমান যে ভুলক্রমেও সেই বিশ্বাসের কথা কোনো অবস্থাতেই প্রচার করতে পারেন না, তার প্রমাণ হিসেবে পবিত্র কোরআন শরিফের সূরা আল-আনকাবুত-এর ১৭ নম্বর আয়াত উদ্ধৃত করছি, ‘তোমরা তো আল্লাহ্র পরিবর্তে কেবল প্রতিমারই পূজা করছ এবং মিথ্যা উদ্ভাবন করছ। তোমরা আল্লাহ্র পরিবর্তে যার এবাদত করছ, তারা তোমাদের রিযিকের মালিক নয়। কাজেই আল্লাহ্র কাছে রিযিক তালাশ কর, তাঁর এবাদত কর এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’
মিডিয়ার কল্যাণে জেনেছি, শেখ হাসিনা ব্যক্তি জীবনে ইসলামের আচারধর্ম নিয়মিতভাবে পালন করে থাকেন, অসংখ্যবার ওমরা এবং হজও করেছেন। আজ ক্ষমতার লোভে ভারত সরকার এবং তার এ দেশীয় ভোট ব্যাংককে সন্তুষ্ট রাখার লক্ষ্যে তিনি যে চরম ধর্মবিরোধী উক্ত করেছেন, তার প্রতিফল কী হতে পারে সেটিও মহান আল্লাহতায়ালা সূরা আন-নিসার ১১৬ নম্বর আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ বলছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করে! এছাড়া যাকে ইচ্ছা, ক্ষমা করেন। যে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করে, সে সুদূর ভ্রান্তিতে পতিত হয়।’ কোনো ব্যক্তির ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস না থাকলে অথবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। তার কোরআন শরীফের সাবধান বাণীতে হয়তো কর্ণপাত না করলেও চলবে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগেই সংসদে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেশের এক নম্বর দেশপ্রেমিক দাবি করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিস্তার পানির ওপর বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এবং করিডোরের বিষয়ে ভারতীয় চাপের মুখে অটল থেকে তিনি তার দাবিকৃত দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে পারতেন। জাতির দুর্ভাগ্য যে, শেখ হাসিনা গদি রক্ষার তাগিদে দেশপ্রেমের সেই পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি।। সরকার প্রধানের কাছে দেশ ও জনগণের স্বার্থ ক্ষমতার বাসনার তুলনায় গৌণ হয়ে উঠলে দেশের জনগণকেই দেশ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হয়। কাজেই ভারতীয় পণ্যবাহী সব যানবাহন এখন আমাদেরই প্রতিরোধ করতে হবে। আশুগঞ্জের স্থানীয় জনসাধারণের নাকের সামনে অবশ্য আবারও এক প্রকার লোভের মুলা ঝোলানো হয়েছে।
ক’দিন আগে সিলেটে লংমার্চে যাওয়ার পথে আশুগঞ্জের একটি রেস্তোরাঁয় যাত্রাবিরতি করেছিলাম। সেখানেই শুনলাম, প্রচারণা চলছে এই করিডোর দেয়া হলে নাকি আশুগঞ্জের অনেক লাভ হবে। ড. দেবপ্রিয়দের সেই পুরনো সিঙ্গাপুর বানানোর গল্প আর কি! হ্যাঁ, কুলিগিরি করে কিছু পয়সা পাওয়া যেতে পারে, রেস্তোরাঁয় বেচা-কেনাও হয়তো খানিক বাড়বে, সর্বশেষ ট্রাক মালিকদেরও ট্রিপের সংখ্যা বাড়তে পারে। কিন্তু, মুষ্টিমেয় লোকের এই যত্সামান্য প্রাপ্তির বিনিময়ে দেশের অমূল্য স্বাধীনতা বেচে দেয়া যায় কিনা, সেটা আশুগঞ্জবাসীকে বিবেচনা করতে হবে। ভারতকে ফ্রি ট্রানজিট দেয়ার রাস্তার জন্য তিতাস নদী শুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। এ দেশের যানবাহন চলাচলের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না করে শত চাকার ভারতীয় বিশাল ট্রেইলারের পাড়ি চলছে বাংলাদেশের বুক চিরে। আমাদের স্বাধীন ভূখণ্ডকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিত্তবৈভব বাড়ানো হচ্ছে। আর আমরা পড়ে আছি সেই তিমিরেই। এমন পরিস্থিতিতে ভেতরে রক্তক্ষরণ যার হয় না, সে আর যাই হোক দেশপ্রেমিক হতে পারে না। আমরা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতপন্থী মিডিয়ার সর্বব্যাপী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছি। জনমনে স্বাধীনতার স্ফুলিঙ্গ প্রজ্বলনের জন্য আপ্রাণ লড়াই করে যাচ্ছি। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশের নাগরিকের দায়িত্ব পালনে এর চেয়ে বেশি কিছু করার সামর্থ্য আমার নেই।
মনে পড়ছে, ২০০৮ সালের ডিজিটাল নির্বাচনের মাত্র ক’দিন আগে বর্তমানে বন্ধ চ্যানেল ওয়ান-এর এক টক শোতে গিয়েছিলাম। তখন ভারতীয় নৌবাহিনীর একাধিক জাহাজ সুন্দরবনের কাছে বাংলাদেশের পানিসীমায় অনুপ্রবেশ করে সেখানে অবস্থান করছিল। আমার স্বভাব অনুযায়ী সেই টক শোতে ভারতীয় অনুপ্রবেশের তীব্র সমালোচনা করেছিলাম। অনুষ্ঠানটি লাইভ প্রচারিত হচ্ছিল এবং দর্শকদের সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল। ভারতের সমালোচনায় ক্রুদ্ধ হয়ে এক দর্শক আমাকে রাগতকণ্ঠে বলেছিলেন, ভারতীয় জুজু’র ভয় আর কত দেখাবেন? এসব কথা বলে আর আমাদের ভোলানো যাবে না। সেই দর্শকের পরিচয় আমার জানা নেই। তিনি বাংলাদেশী নাগরিক কিনা, তাও বলতে পারব না। বাংলাদেশী নাগরিক হয়ে থাকলে আজ তার মুখোমুখি হতে বড় ইচ্ছা জাগে। দেখা হলে প্রশ্ন করতাম, মহাজোট সরকার যে বাংলাদেশের স্বার্থ বন্ধক দিয়েই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে যাচ্ছে সেটি কি তিনি সেদিন বুঝতে পারেননি, নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করেছেন?
টক শো শেষে মনে বড় বেদনা নিয়ে গভীর রাতে বাসায় ফিরে স্ত্রীকে বলেছিলাম, নির্বাচনে নিঃসন্দেহে ভারতপন্থীরাই জয়লাভ করছে। মিডিয়ার উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রচারণায় বিভ্রান্ত ভোটার, ভারতীয় টাকা ও অন্যান্য মদত এবং সেনাপ্রধান জেনারেল মইন গংয়ের দেশ বিকিয়ে আত্মরক্ষার প্রবণতার সংমিশ্রণে শেখ হাসিনার নৌকার জয় অবশ্যম্ভাবী। সব জেনে-বুঝেও এ দেশের অনেক বুদ্ধিমান বুদ্ধিজীবীদের মতো ভোল পাল্টাতে পারিনি। নির্বোধের মতো দেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে পরিবারসহ নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছি। এক এগারোর কুশীলবদের বিরুদ্ধে আমার লড়াই শেখ হাসিনার জামানায় আরও মরণপণ হয়েছে। মইনের ছয় ঘোড়া এখন ষোল কোটি জনতার বুকের ওপর অবিরাম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এমন ভয়ংকর আগ্রাসন সত্ত্বেও বাংলাদেশের সব ‘রক্ষা সমিতি’ যাদের প্রোগ্রামে শ’খানেক লোকের জমায়েত হলেও সেই সংবাদ দেশের নব্বই শতাংশ পত্রিকায় প্রথম পাতায় অন্তত ডবল কলাম ট্রিটমেন্ট পেয়ে থাকে, তাদের টিকিটিরও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। সুশীল (?) সমাজের কথা বলে লাভ নেই। কারণ, তাদের নিয়ন্ত্রণ দিল্লি ও ওয়াশিংটনে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের পরিবারের মুখ চেয়ে চাকরি রক্ষা করতে হবে, তাই তাদেরও হাত-পা বাঁধা। পদুয়া-রৌমারীর বীর সিপাহীদের আজ আর নিরাপত্তা বাহিনীতে খুঁজতে যাওয়া পণ্ডশ্রম। সব মিলিয়ে আমাদেরও আল্লাহর ওপর ভরসা ও জনগণের নিদ্রাভঙ্গের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। সে পর্যন্ত তিস্তার পানিসহ তাবত্ অধিকার উপেক্ষিতই থেকে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.