সুদান ॥ অস্ত্রবিরতি চুক্তি কতটুকু শান্তি আনবে by শামীম আহমেদ

'ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে ভদ্র পলস্নীতে, এখানে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।" _দারিদ্র্যকিষ্ট পদ্মা পাড়ের জেলেদের জীবন সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এ কথাগুলো বলেছেন।
আফ্রিকার দেশ সুদানের দারফুরের জনগণ এমনই জীবন সংগ্রামে লিপ্ত যা সাহিত্যিক বর্ণনায় ফুটিয়ে তোলা দুরূহ। দারফুর যেন পৃথিবীর বুকে এক উন্মুক্ত কারাগার। সভ্যতা, সংস্কৃতি ও উন্নয়ন নিয়ে এখানকার অধিকাংশ মানুষের কোন মাথাব্যথা নেই। বর্তমানে এদের মূল ল্য হচ্ছে কোন রকম টিকে থাকা। তাও আবার বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভর করে। প্রায় দু' যুগের বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধে সুদানের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রানত্মে উপনীত হয়েছে। কালেভদ্রে এখানে শানত্মির সু-বাতাস উঁকি দিলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৫৬ সালে স্বাধীনতা লাভের পর '৭২ থেকে '৮৩ সাল ব্যতীত বাঁকি সময় সুদানে যুদ্ধবিগ্রহ লেগে আছে। সুদানের সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় উত্তর সুদানের তুলনায় দণি সুদানের অবস্থা ভয়াবহ। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী দারফুরে ২০০৩ সালে সংঘর্ষ শুরম্ন হওয়ার পর থেকে এ পর্যনত্ম প্রায় তিন লাখ লোক নিহত হয়েছে। বাস্তুহারা হয়েছে ২৭ লাখ লোক। তবে সুদান দাবি করছে, সহিংসতায় মাত্র ১০ হাজার লোক নিহত হয়েছে।

চুক্তি
অনেক চড়াই উতরাইর পর সুদান সরকার ও দারফুরের প্রধান বিদ্রোহী দল জেইএম গত সপ্তাহে কাতারের রাজধানী দোহায় একাটি অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে স্বার করেছে। তবে চূড়ানত্ম শানত্মি চুক্তির জন্য অন্যান্য সশস্ত্র দলগুলোর সমর্থন জরম্নরী। কাতারের আমির শেখ হামাদ বিন খালিফা আল-থানির আমন্ত্রণে শাদের প্রেসিডেন্ট ইদ্রিস দেবাই ইতনো ও ইরিত্রিয়ার প্রেসিডেন্ট ইসাইয়াস আফেওরকি চুক্তি স্বার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। গত সপ্তাহের শুরম্নর দিকে শাদে খার্তুম সরকার, জাস্টিস ও ইকুয়ালিটি মুভমেন্ট(জেইএম) প্রতিনিধিরা অস্ত্রবিরতি ঘোষণা সংবলিত চুক্তির একটি রূপরেখায় স্বার করেন। বিদ্রোহীদের সহায়তার জন্য খার্তুম দীর্ঘ দিন থেকে শাদকে অভিযুক্ত করে আসছিল। অন্যদিকে শাদেরও অভিযোগ, সুদান তাঁর নিজস্ব বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা দিচ্ছে। সব অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ ছাপিয়ে চলতি মাসে উভয় দেশের নেতারা খার্তুমে ঐকমত্যে পেঁৗছান, যা দারফুর চুক্তির ত্রে প্রস্তুত করে দেয়।
১২টি ধারা সংবলিত এ চুক্তিটিতে দারফুরের শীর্ষ সশস্ত্র দল জেইএমকে সুদানে মতা ভাগাভাগিতে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো হয়। চুক্তির ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'মতার সব পর্যায়ে জেইএম'র অংশগ্রহণের ব্যাপারে সুদান সরকার ও জেইএম'র মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে।' চতুর্থ ধারায় বলা হয়েছে, শীঘ্রই একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে জেইএম'র আত্মপ্রকাশ এবং ১৫ মার্চ নাগাদ চূড়ানত্ম চুক্তি স্বারিত হওয়ার ব্যাপারে উভয় পরে মধ্যে মতৈক্য হয়েছে। তবে সুদানিজ লিবারেশন আর্মির মতো ছোট ছোট বিদ্রোহী দল খার্তুমের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। উপদলগুলো সম্পাদিত চুক্তিটিকে পপাতমূলক বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। সুদানের প্রেসিডেন্ট বলেন, অস্ত্রবিরতি চুক্তির মাধ্যমে দারফুরে যুদ্ধের অবসান ঘটেছে। ওয়াশিংটন চুক্তিটিকে উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি বলে অভিহিত করেছেন। ব্রিটেনও এ চুক্তিটিকে অভিনন্দন জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব কাতারে সম্পাদিত চুক্তিটিকে শানত্মির পথে উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি বলে অভিহিত করেছেন।

সামনে কঠিন সময়
গত জানুয়ারি মাসে উত্তর ও দণি সুদানের মধ্যে স্বারিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির পাঁচ বছর শেষ হয়। ২০০৫ সালের ৯ জানুয়ারি 'দি কমপ্রিহেনসিভ পিস এগ্রিমেন্ট(সিপিএ)' স্বারিত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিশেষ দূত জেনারেল স্কট গেরিসন এই চুক্তিটিকে শানত্মির মূল ভিত্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, এই চুক্তি বাসত্মবায়নে ব্যর্থ হলে সুদান আবারও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।
জেনারেল গেরিসন বলেন, উত্তর ও দণি সুদান এখনও (সিপিত্র) চুক্তির অধিকাংশ ধারা বাসত্মবায়ন করতে পারেনি। এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০১১ সালে। অথচ এখনও চুক্তিটির অধিকাংশ ধারা বাসত্মবায়িত হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দিনগুলোতে লণীয় অগ্রগতি সাধন করতে হবে। সুদানের সামনে দু'টি গুরম্নত্বপূর্ণ সময়সীমা আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে এপ্রিল ২০১০। এই সময়টা গুরম্নত্বপূর্ণ এই কারণে যে, সেসময় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও পরে তা বাতিল করা হয়। অন্য সময়সীমা হচ্ছে জানুয়ারি ২০১১। সেময় দণি সুদানের ভাগ্য নির্ধারিত হওয়ার কথা রয়েছে। দণি সুদান কি সুদানের অংশ হয়ে থাকবে না নতুন স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেখা যায় ২০১১ সালে দণি সুদানের জনগণ স্বাধীনতার জন্য ভোট দিবে। সুদানের প্রেসিডেন্ট বসিরের সরকার এবং প্রতিবেশী মিসর দণি সুদানে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে আসছে।

দক্ষিণ সুদানে দুর্ভিরে আশঙ্কা
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী বলেছে, দণি সুদানে প্রায় ৪০ লাখ লোকের খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন। খাদ্য ঘাটতির কারণে এ অঞ্চলে দুর্ভি দেখা দিতে পারে। সংস্থাটি আগামী অক্টোবরে ফসল ওঠা পর্যনত্ম জনগণের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য নিশ্চিত করতে চায়। দণি সুদানের কৃষিমন্ত্রী স্যামসন কোয়াজি এ অবস্থার জন্য অভ্যনত্মরীণ কোন্দল ও খরাকে দায়ী করেছেন। এ অঞ্চলের দুই দশকের গৃহ যুদ্ধ থেকে উত্তোরণ হচ্ছে। তবে অঞ্চলটি এখনও খুব অনুন্নত। ২০০৫ সালে উত্তরের সঙ্গে দণি সুদানের গৃহযুদ্ধ শেষ হয়। তবে এর পরও দণি সুদানে অভ্যনত্মরীণ সংঘাত-সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। গত বছর দণি সুদানে বিদ্রোহী গ্রম্নপগুলোর দ্বন্দ্বে প্রায় আড়াই হাজার লোক নিহত হয়।
উত্তর ও দণি সুদানের যুদ্ধের পর উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়া লাখ লাখ কৃষক বাড়িঘরে ফিরে পুনরায় তাদের জীবনযাপন শুরম্ন করেছে।
চলমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সুদান শানত্মির পথে কতটুকু অগ্রসর হবে তা দেখার অপোয় বিশ্ববাসী।

এ ক ন জ রে

নাম : রিপাবলিক অব সুদান
জনসংখ্যা : ৪ কোটি ২২ লাখ (জাতিসংঘ ২০০৯)
রাজধানী : খার্তুম
আয়তন : ২৫ লাখ বর্গকিলোমিটার
মূল/প্রধান ভাষা : আরবি, নুবিয়ান
প্রধান ধর্ম : ইসলাম, খ্রীষ্টান
গড় আয়ু : ৫৬ বছর (পুরম্নষ), ৬০ বছর (নারী)
প্রধান রফতানি : তেল, সুতা, পশুসম্পদ ও চামড়া।
মাথাপিছু আয় : ১১৩০ মার্কিন ডলার (বিশ্বব্যাংক ২০০৮)
প্রেসিডেন্ট : ওমর হাসান আহমদ আল-বাসির
প্রধান সংবাদপত্র : আল-রায়, আল-আম্ম, আল-আয়াম, খাতর্ুম মনিটর।
টেলিভিশন : সুদান ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (এসএনবিসি)
সংবাদ সংস্থা : সুদান নিউজ এজেন্সি (সানা)

No comments

Powered by Blogger.