সঙ্কটে টয়োটা- কুন্তল রায়

চোখের পানি মোছার জন্য কিছুটা সময় নিলেন মিসেস রোন্ডা স্মিথ। তিন বছর আগের বিভীষিকা মনে পড়তেই কেঁপে ওঠে তার সারা শরীর। নিশ্চিত মৃতু্যকে অনেক কাছ থেকে দেখেছেন তিনি।
ঘটনাটা ২০০৬ সালের। নতুন কেনা লেক্সাস মডেলের সিডান গাড়িটি নিয়ে রাসত্মায় বেরিয়েছিলেন। রাসত্মা ফাঁকা দেখে এক্সিলারেটর প্যাডেলে একটু জোরেই চাপ দিয়েছিলেন হয়ত। কিন্তু একি! স্পীডোমিটারের কাঁটা যে বাড়ছেই! মিটারের কাঁটা যখন ১৬০ কিলোমিটারে, উন্মাদের মতো ব্রেক প্যাডেলে লাথি মারতে লাগলেন তিনি। কিন্তু না, কোনো কাজই হচ্ছে না। ঝড়ের মতো হাইওয়ের বুক চিরে ছুটে যাচ্ছে তার গাড়ি। এমার্জেন্সি হ্যান্ডব্র্যাকের বাটন চেপে, গিয়ার পরিবর্তন করে কিংবা ব্রেক কষে কোন কাজই হচ্ছে না। মৃতু্য আসন্ন! তারপরও বেঁচে থাকার প্রাণপণ আকাঙ্ৰায় আবারও ব্রেক করলেন তিনি। এবার কপাল ভাল, আরও ৬ কিলোমিটার যাওয়ার পর গাড়ি থেমে গেল। মৃতু্য খুব কাছ থেকে দেখা দিয়ে গেল মিসেস স্মিথের। ঘটনার পর বিক্রেতা কোম্পানির কাছে গিয়ে অভিযোগ করে উল্টো অপমানিত হন তিনি। টেকনিশিয়ানরা উল্টো মিসেস স্মিথের ভুল ধরে তার অভিযোগ উড়িয়ে দেন। মিথ্যাবাদী সাব্যসত্ম করায় চরম ুব্ধ হয়ে ফিরে আসেন তিনি।
মার্কিন আইনসভার নিম্নক প্রতিনিধিসভার সদস্যদের নিয়ে গঠিত কমিটির কাছে কংগ্রেসনাল শুনানিতে বিশ্বের এক নম্বর গাড়ি কোম্পানি টয়োটার বিরম্নদ্ধে এই অভিযোগ করেন মিসেস স্মিথ। সম্প্রতি এমন আরও ঘটনার উদাহরণ পাওয়া গেছে। ২০১০ সালে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ঘটনাবলীর মধ্যে টয়োটার বাজার থেকে লৰ লৰ গাড়ি উঠিয়ে নেয়ার কাহিনী অন্যতম 'হট টপিকস'। রূপকথার মতো একটি কোম্পানীর বিশ্ববাজারে উত্থানের পর সহসাই যে দুযের্াগ ঘনিয়ে এলো, সেই দুযের্াগ কিভাবে তারা কাটিয়ে উঠবে সেটাই গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়।

টয়োটার উত্থান-পতন
কয়েক দশকে গড়ে ওঠা টয়োটার বিশ্বব্যাপী সুনাম মাত্র কয়েক সপ্তাহে দুর্বল স্থাপনার মতো বিধ্বসত্ম হয়ে গেছে। ১৯৩০ সালে টয়োটা প্রতিষ্ঠিত হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এর প্রকৃত উত্থান শুরম্ন। বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসসত্মূপ থেকে উঠে জাপানের নয়া অর্থনৈতিক উত্থানের সঙ্গে সমানত্মরালভাবে টয়োটা এগোতে থাকে। পঞ্চাশের দশকে টয়োটা প্রযুক্তিভিত্তিক আধুনিক মডেলের গাড়ি তৈরি আরম্ভ করে। যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি কোম্পানিগুলোকে যন্ত্রাংশ তৈরির পর বিভিন্ন অংশ জোড়া দেয়ার জন্য বসে থাকতে হতো, কারণ এই কাজ অন্য কোন কোম্পানি করত। জাপানে এই পদ্ধতিতে গাড়ি তৈরি খুবই ব্যয়বহুল ছিল, এ জন্য তারা নিজেরাই গাড়ির যন্ত্রাংশ থেকে জোড়া দেয়া, সব কাজ করার জন্য নতুন এক উৎপাদন পদ্ধতি চালু করে যার নাম টয়োটা প্রডাকশন সিস্টেম (টিপিএস)। প্রয়োজন অনুযায়ী কমর্ীবাহিনী নিয়োগ করা হতো। মডেল ডিজাইন, কাঁচামাল সরবরাহ এবং যন্ত্রাংশ তৈরি করে জোড়া দেয়া, এসব পৃথক পৃথক কাজের জন্য লোকবল নিয়োগ করা হতো। এক ব্যক্তি একই সঙ্গে ডিজাইন থেকে শুরম্ন করে উৎপাদনের বিভিন্ন সত্মরে অংশগ্রহণ করত। ফলে উৎপাদন খরচ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কমে আসে এবং বাজারেও গাড়ি অনেক সসত্মা হয়ে পড়ে।
টিপিএসকে জাপানে বলা হয় 'চলমান উন্নয়নে'র মডেল। কাজের েেত্র এই প্রক্রিয়ায় কমর্ীদের মতায়ন করা হয়। জাপানী ভাষায় এটিকে বলা হয় কাইজেন। কাইজেন অর্থ উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ, যে নাটবল্টু লাগাবে সে ডিজাইন তৈরিও করতে পারবে, এবং নিজের শেখা জ্ঞান বিভিন্ন সত্মরে ছড়িয়ে দিতে পারবে। কাইজেনের ফলে টয়োটার উৎপাদনব্যবস্থা গতিশীল হয় এবং জেনারেল মোটরসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরম্ন করে। বিশ্বের এক নম্বর মোটরগাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি জেনারেল মোটরের সমান লোকবল নিয়ে এর চেয়ে বেশি মানসম্মত গাড়ি তৈরি শুরম্ন করে এবং উৎপাদন বাড়তে থাকে।
সাকিচি টয়োডা জিডোকা নামে নতুন একটি উৎপাদন পদ্ধতি চালু করেন। এর মানে হলো 'যেখানেই সমস্যা সেখানেই থেমে যাও'। ফ্যাক্টরির একজন সাধারণ শ্রমিক কোন বিষয়ে সমস্যা অনুধাবন করলে কিংবা অসংলগ্ন মনে করলে কাজ সেখানেই থেমে যাবে এবং ঐ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যনত্ম নতুন করে কাজ শুরম্ন হবে না। এই পদ্ধতিতে মানসম্মত পণ্য উৎপাদন করতে থাকে টয়োটা এবং অটোমোবাইল মার্কেটে সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে থাকে।
তাহলে টয়োটা কেন এমন গাড়ি তৈরি করল যে জন্য ল ল গাড়ি উঠিয়ে নিতে হচ্ছে? পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল মোটর ভেহিক্যাল প্রোগ্রামের কো-ডিরেক্টর জন পল ম্যাকডাফি মনে করেন গত দশ বছরে টয়োটা কোম্পানির দ্রম্নত বর্ধনশীলতাই এর পেছনে দায়ী। ২০০০ সালে টয়োটা ৫৩ ল গাড়ি তৈরি করেছে, গত বছর সেই কোম্পানি তৈরি করেছে প্রায় এক কোটি। গত ৯ বছরে টয়োটার ৫৮টি প্রডাকশন সাইটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও ১৭টি সাইট। বিশ্বের এক নম্বর কোম্পানি হওয়ার জন্য টয়োটার এই প্রাণপণ চেষ্টা আয়তনে এটি ক্রাইসলারকেও ছাড়িয়ে গেছে। ফলে টয়োটার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের গলদ রয়ে গেছে তা কেউ ল্য করেনি। হাজার মাইল দূরত্বে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউনে যখন টয়োটা তাদের নতুন পস্ন্যান্ট প্রতিষ্ঠা করে, তখন জাপান থেকে অসংখ্য বিশেষজ্ঞ টেকনিশিয়ান ও ইঞ্জিনিয়ার এসে যুক্তরাষ্ট্রে টয়োটার নতুন পস্ন্যান্ট চালু করার জন্য কাজ করেছে, কিন্তু সাংস্কৃতিক ও পারিপাশ্বর্িক পরিবেশের সঙ্গে কাজ করা যে আসলেই সহজ ব্যাপার নয় তা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সবার কাছে।
২০০২ সালে যখন টয়োটার গাড়িতে বিভিন্ন সমস্যার কথা শোনা যেতে থাকে, তখন কোম্পানির ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত উচ্চপদস্থরা বিষয়টি আমলে নেননি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যখন টয়োটা তাদের বিপণন বৃদ্ধির সুখস্বপ্নে বিভোর, তখন তারা এটা মাথায় রাখেননি যে, মার্কিনীরা তাদের যানবাহনের নিরাপত্তার বিষয়ে কতখানি সচেতন। এজন্যই যখন কোন অভিযোগ বা সমস্যা এই ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বরতদের কানে এসেছে, তারা সঠিকভাবে বিষয়টি তত্ত্বাবধান করেননি। যে কোন কোম্পানির ব্যবস্থাপকদের হাতেই আসলে ঐ কোম্পানির ভাল-মন্দ নির্ভর করে, তাদের দায়িত্বে অবহেলা বা অসচেতনতার ফলে গোটা উৎপাদন ব্যবস্থা তিগ্রসত্ম হয়। কিন্তু টয়োটার েেত্র এটি আর তির পর্যায়ে নেই বরং জীবন-মরণের প্রশ্ন হয়ে গেছে।
অর্থনৈতিক মন্দার পর গত অর্থবছরে প্রায় ৪.৯ বিলিয়ন ডলারের তি পুষিয়ে টয়োটা যখন ফের গতি ফিরে পাচ্ছিল, তখনই আঘাত নেমে এলো। কর্পোরেট বাণিজ্যের সঙ্গে মার্কিন রাজনীতি খুব গভীরভাবে জড়িত, টয়োটার েেত্রও সে নিয়মে কোন পরিবর্তন আসেনি। সানফ্রান্সিসকোর ফারমন্টে টয়োটার ম্যানুফাকচারিং পস্ন্যান্ট বন্ধ করার ফলে প্রায় ৫৪০০ জন চাকরিচু্যত হবে, তির সম্মুখীন হবে প্রায় ১০০০ পণ্য সরবরাহকারী। ডেমোক্রেটিক হাউস স্পীকার ন্যান্সি পেলোসি টয়োটার এই সিদ্ধানত্মে খুব খুশি হওয়ার কথা নয়। এর পরই ক্যালিফোর্নিয়ায় লেক্সাস গাড়িতে দুর্ঘটনায় ৪জনের মৃতু্যর খবর। এছাড়াও মার্কিন পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি সংস্থা ন্যাশনাল হাইওয়ে ট্র্যাফিক সেফটি এ্যাডমিনিসট্রেশন (এনএইচটিএসএ)-ও টয়োটাকে কোন সুবিধা দেয়নি। ২০০৩ সাল থেকেই তারা টয়োটার গাড়িতে নিরাপত্তা সমস্যা নিয়ে তদনত্ম করছে। মার্কিনমুলুকে টয়োটার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেল মোটরসের অবদানও এখানে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ফেডারেল সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় জেনারেল মোটরস যে টয়োটার খুঁত ধরার জন্য চরম আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে, সে কথা বলার অপো রাখে না। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে টয়োটার চাহিদা কমানোর েেত্র তাদের ভূমিকাকে একেবারে উড়িয়েও দেয়া যায় না।

বর্তমান পরিস্থিতি
হেনরি ফোর্ড ৩, ফোর্ড মটর কোম্পানীর সাবেক প্রদান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রায়ই বলতেন, আমাদের কোম্পানীর কোনো মুকুটধারী রাজকুমার নেই। যুক্তরাষ্ট্রের অটোমোবাইল শিল্পের উত্থান-পতন কোন কোম্পানীকেই এখানে একক রাজত্ব করতে দেয়নি। তবে গত ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে আকিয়ো টয়োডা টয়োটা কোম্পানীর মুকুটহীন রাজকুমারের মতোই অবস্থান নিয়ে আছেন। পিতৃপুরম্নষের ব্যবসাকে গতিশীল করে সবার উপরে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব তারই। কিন্তু টয়োটার গাড়ি নিয়ে বর্তমান সংকটের পরে সবার দৃষ্টিই এখন আকিয়ো টয়োডার ওপরই। কিভাবে তিনি মহাসংকট থেকে কোম্পানীকে উত্তরণ করবেন?
মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকৰ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের সদস্যদের নিয়ে গঠিত কমিটির সামনে টয়োটা প্রতিনিধিদের কংগ্রেশনাল শুনানি শুরম্ন হয়েছে গত বুধবার থেকে। আকিয়ো টয়োডা অবশ্য শুনানিতে থাকছেন না, রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে টয়োটা সেলসের প্রেসিডেন্ট জেমস ই লেনজসহ অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকতর্ারা। তবে প্রত্যাহারকৃত গাড়িগুলি মেরামত করা হলে সমস্যার সমাধান হবে কিনা এ বিষয়ে টয়োটা কতর্ৃপৰ নিশ্চিত নয়। যদিও আকিয়ো টয়োডা চীন সফরে এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, টয়োটার ভুল হতেই পারে, কিন্তু সেই ভুল শোধরানোর মতো দৰতা আমাদের আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হাইওয়ে এন্ড ট্রাফিক সেফটি এডমিনিসট্রেশন টয়োটার উৎপাদন ব্যবস্থায় কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো প্রয়োজন বলে মনে করে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় অটোমোবাইল মার্কেট যুক্তরাষ্ট্র ট্রাফিক নিরাপত্তা নিয়ে অনেক বেশি সচেতন। এক্সিলারেটর প্যাডেলে সমস্যার কারণে টয়োটা বিশ্বব্যাপী যে ৮৫ লৰ গাড়ি মেরামতের জন্য উঠিয়ে নিয়েছে, তার ৬০ লৰই মার্কিন বাজার থেকে। ব্রেকে ত্রম্নটির কারণেও যুক্তরাষ্ট্রেই প্রায় ৪লৰ ৩৭ হাজার প্রিয়ুস অন্যান্য হাইব্রিড গাড়ি ওঠানো হয়েছে। জাপানে প্রিয়ুস মডেলের গাড়িই বিক্রী হয়েছিল ২ লৰ ২৩ হাজার, যার মধ্যে ২লৰ গাড়ি মেরামতের জন্য পাঠানো হয়েছে। তবে বাজার থেকে প্রিয়ুস ২০১০ মডেল এখনও ওঠানো হয়নি। সারাবিশ্বে এটিই গ্যাস-ইলেকট্রিক কম্বিনেশনের সর্বাধিক বিক্রীত হাইব্রিড মডেলের গাড়ি। সমস্যা পাওয়া গেছে টয়োটা করোলার পাওয়ার স্টিয়ারিং-এ। জাপানেই করোলা মডেলের গাড়ির ৰেত্রে শতাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওঠানো হয়েছে প্রায় ৮ হাজার টাকোমা পিকআপ। প্রতিদিনই নতুন নতুন মডেলের গাড়িতে সমস্যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে এবং সেগুলি মেরামতের জন্য প্রত্যাহার করছে টয়োটা।

কিন্তু মেরামতের ফলে সমস্যার সমাধান কি আসবে? বিষয়টি নিশ্চিত নয়। কেননা গোটা সিস্টেমে সমস্যার কারণে টয়োটার এতো বিপুল সংখ্যক গাড়িতে সমস্যা হয়েছে এটা সহজেই বোধগম্য। গাড়ি উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম কোম্পানীটির এই ভরাডুবি ইতোমধ্যেই এর শেয়ারের দরপতনের কারণ হয়েছে। আসলেই কেন এই সংকট ঘটলো, তা জানতে আমাদের আরও সময় অপেৰা করতে হবে হয়তো।

গাড়ি শিল্পেই চলছে খরা
বিশ্ববাজারে গাড়ি শিল্পেই যেন খরা লেগেছে। টয়োটার পর হোন্ডা ও হিউন্দাই কোম্পানীর গাড়িও বাজার থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। জাপানের দ্বিতীয় বৃহত্তম গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানী হোন্ডা প্রায় ৪লৰ ৩৭ হাজার ৭৬৩ গাড়ি বাজার থেকে উঠিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এসব গাড়ির ত্রম্নটিযুক্ত এয়ারব্যাগ মেরামত করা হবে। হোন্ডার সিভিক এবং একর্ড মডেলের গাড়ি যুক্তরাষ্ট্র, কানাযা, জাপান, মেক্সিকো, তাইওয়ান ও অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়। ত্রম্নটিযুক্ত গাড়ির মডেল ২০০১ ও ২০০২ সালের এবং অধিকাংশই উত্তর আমেরিকায় তৈরি করা হয়েছে। হিউন্দাই মটরও অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৩০০ এবং দৰিণ কোরিয়া থেকে ৪৬ হাজার সোনাটা মডেলের সেডান উঠিয়ে নিচ্ছে। সোনাটা গাড়ির সামনের দরজায় সমস্যা ঠিক করে এগুলি আবার বাজারে ছাড়া হবে বলে জানা গেছে। এছাড়া বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এমনিতেই অটোমোবাইল শিল্পে ধ্বস নেমেছে। অর্থনৈতিক মন্দার আঘাতে বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ি প্রস্তুতকারকের অবস্থান থেকে ছিটকে গেছে জেনারেল মটরস। সার্বিক বিবেচনায় গোটা অটোমোবাইল শিল্পেই যেন 'শনির দশা' হয়েছে।

'টয়োটা সিটি'র বেহাল দশা

সিরু হিরায়ামা আর তার স্ত্রী কিউমীর এত বাজে সময় কখনও আসেনি। বিষণ্ন মনে তারা দাঁড়িয়ে ছিল টয়োমী ফার্মেসির কাউন্টারে। টয়োটা সিটির ডাউনটাউনে তারা স্বামী-স্ত্রী দু'জনে মিলে এই ফার্মেসি চালান। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এমনিতেই বিক্রি কমে গেছে, তারপর আবার বর্তমানে বহুল আলোচিত টয়োটা গাড়ি কেলেঙ্কারিতে ওষুধ ব্যবসায় একেবারেই ভাটা পড়ে গেছে। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! বিক্রি এত কমেছে যে, দিনের খরচ যোগাতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন তারা।
যেন এক মৃতপুরীতে পরিণত হয়েছে টয়োটা সিটি। থেমে গেছে প্রাণস্পন্দন। টয়োটা সিটির সর্বত্রই বর্তমান সঙ্কটের ছাপ পড়েছে। হিরায়ামা বলেন, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে গত ১৮ মাসে আমার দোকানের বিক্রি ২০ শতাংশ কমেছে। এখন গাড়ি নিয়ে সঙ্কটের কারণে বিক্রি একেবারেই শূন্যের কোঠায়। অবস্থা শোচনীয় হতে পারে এই চিনত্মায় উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, টয়োটার অবস্থা না ফিরলে আমাদেরও কোন আশা নেই।
১৯৫৯ সালে পূর্ব জাপানের নাগওয়া অঞ্চলের করোমো শহরের নাম বদলে ফেলেন সেখানকার জনগণ। জাপানের অটোমোবাইল শিল্পের অহঙ্কার টয়োটার নামানুসারে ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষের এই নগরীর নামকরণ করা হয় 'টয়োটা সিটি'। এখানেই টয়োটার হেডকোয়ার্টার এবং সুবিশাল ফ্যাক্টরি কমপেস্নক্স। এখানকার অনত্মত ৭৭ হাজার নাগরিকের কর্মসংস্থান অটোমোবাইল শিল্পের সঙ্গে জড়িত, আর প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে টয়োটার সঙ্গে সম্পর্কিত তা সে রেস্টুরেন্ট কিংবা সুপার মার্কেটের মালিক হোক। টয়োটার ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত তাদের ব্যবসা, ভাগ্য যেন এক সুতোয় বাঁধা পড়ে গেছে।
সময়টা আসলেই নিদারম্নণ। অর্থনৈতিক মন্দার সময় গাড়ি বিক্রি কমে যাওয়ার পর টয়োটা উৎপাদন হ্রাস করে। যার প্রভাব পড়ে টয়োটা সিটিতে। এখানকার এক এ্যাপার্টমেন্ট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ওয়াতানাবে জানান, গত দুই বছরে বাড়িভাড়া ২০ শতাংশের মতো কমে গেছে। অনেক এ্যাপার্টমেন্ট খালি পড়ে আছে। দুঃখ করে বলেন, গাড়ি তৈরিতে জাপানের কিংবদনত্মির মতো গৌরব আজ নষ্ট হয়ে গেছে। বাজারের অবস্থা এত খারাপ যে, তার প্রভাব পড়েছে গোটা অর্থনীতিতে।
টয়োটা সিটির কেন্দ্রে দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো দাঁড়িয়ে আছে কোম্পানিটির হেডকোয়ার্টার। যে কেউ চাইলেই এখানে ঢুকতে পারবে না। কমর্ী-শ্রমিকদের মুখ না খোলার জন্য নির্দেশ দেয়া আছে। কোন কর্মকর্তাকে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে মাথা নুইয়ে বিনয়ের সঙ্গে মনত্মব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান, আমরা কিছুই জানি না যে, আসলেই কি ঘটতে যাচ্ছে।
টয়োটা সিটির কেন্দ্রে 'হ্যাপি এন্ড' ক্যাফের মালিক ইয়াসুতেরম্ন কামইয়ার মনে কোন সন্দেহ নেই যে, টয়োটা সিটি ধ্বংস হতে বসেছে। টয়োটার বর্তমান শকের পরে কামইয়ার ক্যাফের বিক্রি অর্ধেকে নেমে গেছে। বিষাদময় কণ্ঠে বলেন, মনে হয় না এখানে আর ব্যবসা চালাতে পারব। সবকিছুই নির্ভর করছে টয়োটার অবস্থার ওপর।

No comments

Powered by Blogger.