বই পড়ুন সুন্দর জীবনের জন্য by মোস্তফা আদনান

বছর ঘুরে আবার ফেব্রুয়ারি মাস চলে এসেছে। বাঙালীর জীবনে ফেব্রুয়ারি শুধু একটি মাস নয়। ফেব্রুয়ারি মানে বাঙালীর চেতনায় নতুন করে নাড়া দেওয়া।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনে ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা আনুগত্য অনুরাগ প্রকাশে অন্যরকম চেতনা জাগায় এই ফেব্রুয়ারি। এই ফেব্রুয়ারি এলেই শুরু হয়ে যায় বাংলা একাডেমী চত্বরে অমর একুশে বইমেলার বিশাল আয়োজন। আর এই সময়ের অপেক্ষায় থাকেন বইপ্রেমী মানুষ। একুশের বইমেলা মানে লেখক-পাঠকের প্রাণের মেলা। লেখক-পাঠকের, সেতুবন্ধের মেলা। অমর একুশের বইমেলায় প্রতিবছর প্রকাশিত হয় কয়েক হাজার নতুন বই। এর মধ্যে উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, গবেষণামূলক, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণমূলক, শিশুতোষ বিভিন্ন ধরনের বই থাকে। এবারের একুশের বইমেলায়ও প্রকাশিত হবে তেমনি অনেক বই। আমাদের নাগরিক জীবনে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণের অমর একুশে বইমেলা সৃজনশীল চেতনাকে দীপ্ত করে। নাগরিক জীবনের অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমীর অমর একুশে বইমেলায় ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, ভাইবোন, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ভিড় করেন লাখো মানুষ। কেউ একবার আসেন। আবার অনেকে বেশ অনেকবার আসেন। তারা বিভিন্ন স্টল ঘুরে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন লেখকের বই কেনেন নিজের পছন্দ অনুযায়ী। এর মধ্যে সায়েন্স ফিকশন, এ্যাডভেঞ্জার, ভূতের গল্প, ছড়ার বই থাকে। এর পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের কিশোর ক্ল্যাসিক বইও কম বিক্রি হয় না। আমাদের নাগরিক জীবনযাপনে অনেক ব্যস্ততা গ্রাস করায় বই পড়ার অভ্যেস ক্রমেই যেন লোপ পাচ্ছে। কিন্তু তারপরও অনেকে শত ব্যস্ততার পরেও যেটুকু অবসর পান তার অনেকটাই বই পড়ার কাজে লাগান। কারও কারও ছাত্রজীবন থেকেই পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়ার প্রতি বিশেষ আগ্রহ থাকে। কর্মজীবনে ঢোকার পরেও তাদের বই পড়ার অভ্যসটি হারিয়ে যায় না। এখনও তারা অবসর পেলেই পছন্দের বইয়ের মধ্যে ডুব দেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব মহলে পড়ুয়া মানুষ এবং জ্ঞানী হিসেবে তাদের বিশেষ কদর ও সম্মান রয়েছে। আশপাশের অনেকেই এ কারণে কোন বিষয়ে জানতে হলে তাদের কাছে আসেন। ফোন করেন। এ রকম বাবা-মায়ের দেখাদেখি তাদের ছেলেমেয়েরাও বই পড়ার প্রতি উৎসাহী হয়ে ওঠে। তারাও পড়ুয়া হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ জন্য খুব অল্প বয়সেই ছেলেমেয়েদের হাতে তাদের রুচি ও মনমানসিকতা অনুযায়ী মজার মজার বই তুলে দেয়া উচিত। এর মাধ্যমেই তাদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। এটা দিনে দিনে আরও বিকাশ লাভ করে বয়স বাড়ার সাথে সাথে।
আজকাল টেলিভিশনে কার্টুন দেখা এবং কম্পিউটারে মজার মাজার গেম নিয়ে মেতে থেকে প্রচুর সময় নষ্ট করে বিভিন্ন শিশু, কিশোর-কিশোরীরা। এর মাধ্যমে মেধা ও মননশীলতার তেমন বিকাশ ঘটে না। কিন্তু যেসব ছেলেমেয়ে বই পড়ায় অভ্যস্ত তাদের মেধা ও মননশীলতার বিকাশ ঘটতে বাধ্য। অনেকে বছরে শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারি এলে অমর একুশে বইমেলা থেকে নিজের জন্য এবং ছেলেমেয়েদের জন্য বই কেনেন। আবার অনেকে বছরজুড়ে নিজের এবং পরিবারের অন্যদের জন্য হরেক রকম বই কেনেন। কারণ তারা ঠিকই উপলব্ধি করেছেন ভাল বই পড়ার মাধ্যমে একজন মানুষের যথার্থ উন্নত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বই পড়ার অভ্যাসের আর কোন বিকল্প নেই।
তবে আজকাল আমাদের সমাজে বইপ্রেমী মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বাংলা একাডেমীর অমর একুশে বইমেলায় আগত নারী-পুরুষ শিশুর যে ভিড় লক্ষ্য করা যায়, তারা সবাই যদি বই কেনেন তাহলে বইমেলায় বই বিক্রির পরিমাণ অনেকগুণ বেড়ে যেত। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বইমেলায় আগতদের বেশিরভাগই বিভিন্ন স্টলে ঘুরে ঘুরে বই নেড়েচেড়ে চলে যান। বই কেনায় তাদের উৎসাহ দেখা যায় না।
এ কথা মানতেই হবে, সবাইকে কিছু লিখতে হলে আগে পড়তে হবে। আবার জানতে হলেও, দর্শন, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, অর্থনীতি, চলচ্চিত্র, শিল্পকলা, জীবনী, অভিধান, ব্যাকরণ তথা বিষয় অনুযায়ী বিভিন্ন বই আলাদা শ্রেণীতে ভাগ করে বুকসেলফে সাজালে খুব ভাল হয়। এতে যখন তখন নিজের চাহিদামতো বইটি খুঁজে বের করতে তেমন বেগ পেতে হবে না। যাদের বাড়ির পরিসর বড় অনেক রুম রয়েছে, তাদের বাড়িতে তারা একটি রুমকে আলাদাভাবে পড়াশোনার জন্য রিডিংরুম হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। যে বাড়িতে এ রকম একটি বইয়ের সাজানো সেলফ কিংবা আলাদা রিডিংরুম রয়েছে সেখানকার মানুষ স্বাভাবিকভাবে পড়ুয়া হবেন ধরে নেয়া যায়। বাড়িতে যদি পড়াশোনার উপযোগী তেমন চমৎকার পরিবেশ থাকে তাহলে পরিবারের ছোট-বড় সবার মধ্যে বই পড়ার যথার্থ অভ্যাস গড়ে উঠবে। এজন্য প্রথমে বড়দের এগিয়ে আসতে হবে। পরিবারের মধ্যে বড়দের দেখেই ছোটরা সব কিছু শেখে। বাড়িতে যদি ছোটরা বড়দের বই পড়তে দেখে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বই পড়তে উৎসাহী হবে। সেই মুহূর্তে যদি তাদের হাতে তাদের বয়সের উপযোগী নানা স্বাদের বই তুলে দেয়া যায় তাহলে ক্রমেই তারা বই পড়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ হবে। এ সময় তাদের বই পড়ায় উৎসাহী করতে সেই বইটি নিয়ে কিছুটা আলোচনা করে তাদের এ ব্যাপারে কৌতূহলী করে তোলা যায়। সেই কৌতূহল মেটাতেই তারা বইটি পড়ে শেষ করবে। আবার পারিবারিক আড্ডায়, নাশতার টেবিলে পঠিত বইটি নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে যারা বইটি পড়েনি তখন পর্যন্ত তারাও বইটি পড়তে সচেষ্ট হবে খুব স্বাভাবিকভাবে।
আজকের ইন্টারনেট, ফেসবুক আর এমপিথ্রি, ডিভিডির যুগে তরুণ প্রজন্মই বিনোদনের জন্য ওসব নিয়ে সারাক্ষণ মেতে থাকতে চায়। সময়ের বাস্তবতার আলোকে আজকাল বইবিমুখ হয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ মানুষ। বই পড়ার অভ্যাস লোপ পাচ্ছে ক্রমেই। অনেকের মতে, বই পড়াটা ব্যাকডেটেড ব্যাপার। এসব অজুহাত দেখিয়ে বই পড়ব না বা বই পড়ার প্রয়োজন নেই এটা ভাবতে যাওয়াটা নিতান্তই বোকামি। এই ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমীর অমর একুশে বইমেলার জোয়ারে ভেসে অনেকেই হয়ত দু’একটি বই কিনে ফেলেন। কিন্তু তারা সেগুলো না পড়ে বুক সেলফে কিংবা র‌্যাকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখেন। হয়ত উল্টেপাল্টে দেখেন কেউ। কিন্তু তারা পুরো বইটি পড়ার তাগিদ অনুভব করেন না। এভাবে বই কিনে না পড়ে ফেলে রাখার কোন মানে হয় না। বইমেলা থেকে কিনে আনা বইগুলো পড়তে শুরু করুন। দেখবেন ওখানে কত আনন্দ আর জ্ঞানের বিষয় জমে আছে। বই পড়ার পর আপনি উপলব্ধি করবেন আরও আগেই এগুলো পড়ে ফেলা উচিত ছিল। কেউ কেউ বই না পড়ে সিনেমা দেখে সময় নষ্ট করেন। রেডিমেড বিনোদন উপকরণ চোখের সামনে পাওয়া যাচ্ছে কষ্ট করে বই পড়ার মানে নেই বলে তারা যুক্তি দেখান। এটা এক ধরনের বোকামি। নতুন প্রজন্মের হাতে যদি তাদের অভিভাবকরা দু’একটি ভাল বই তুলে দেন এবং পড়তে উৎসাহিত করেন তাহলে ঘরে ঘরে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে ব্যাপক হারে। অনেকেই বলতে পারেন আজকাল স্কুল-কলেজে পাঠ্যবই পড়ার চাপে নিত্য পিষ্ট হচ্ছে অধিকাংশ ছেলেমেয়ে। এ ক্ষেত্রে পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যান্য বই পড়ার সময় কোথায় তাদের? পরীক্ষায় ভাল রেজাল্টের জন্য এমনিতেই স্কুল-কলেজের ক্লাসের পরে টিচারদের বাসায় বাসায় এবং কোচিং সেন্টারে ছুটতে ছুটতে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এর ওপর বাড়তি কোন বই পড়ার ঝামেলায় তারা জড়াতে চায় না আর। আমার জীবনযাপনে বই পড়ার অভ্যাসটি থাকা একান্ত জরুরী। এটা সবাইকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে।
বই পড়তে যারা আলসেমি অনুভব করেন, সেই আলসেমি ভাব দূর করতে হলে আপনাকে কী করতে হবে তা এখানে তুলে ধরা হলো। প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা রুচিবোধ রয়েছে। কাজেই আপনি কারও কাছে কোন বইয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনে সেই বইটি পড়া শুরু করতে পারেন। একবার বইটি পড়া শেষ করতে হবে তেমন কঠিন পণ না করে বিষয়টিকে কোন রুটিন ওয়ার্ক মনে না করে যতক্ষণ পড়তে ভাললাগে ঠিক ততক্ষণ পড়ুন। নিজের কাজকর্মের ক্ষতি না করে যখন পড়তে মন চায় তখনই পড়ুন। পাঠ্যবই পড়ার সময় গান শোনা বা টিভি দেখা যেমন ঠিক নয়, তেমনি এ সময় গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের বই পড়াটাও বর্জন করা উচিত। বই পড়ার জন্য নিজে এবং সন্তান কিংবা ছোট ভাইবোনদের জন্য অবসর সময় বা ছুটির দিনগুলোকেই বেছে নিন। একটা গল্প বা উপন্যাস পড়ে আপনার ভাল না লাগার মানেই কি দুনিয়ার সব বই কি একই রকম একঘেয়ে বিরক্তিকর। কাজেই বই পড়াকে অর্থহীন বলার আগে কয়েক রকম বই পড়ে দেখতে পরামর্শ দিন আপনার সন্তানকে। তার কাছ থেকে জেনে নিন কোন বইটি পড়তে ভাল লাগছে। তারপর সেরকম আরও কিছু বই কিনে দিন তাকে পড়ার জন্য। বাড়িতে ছোট-বড় সবাইকে বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পড়াশোনা এবং বইয়ের প্রতি আলাদা আকর্ষণ সৃষ্টির জন্য বড়দের বিশেষ অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বাড়িতে বইপত্র এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেখানে সেখানে রাখাটা বইয়ের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করার শামিল। বইপত্র বুকসেলফে কিংবা র‌্যাকে যথাযথ সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখা হলে সেটা দেখতেও যেমন ভাল লাগবে, তেমনি যখন তার ইচ্ছা করবে পছন্দের বইটি নিয়ে পড়তে পারবে। ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়েদের ভাল মননশীল বইয়ের প্রতি উৎসাহী করে তোলা উচিত। তাদের একটা কথা বুঝিয়ে বলুন, পড়ার কোন বিকল্প নেই। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয় জ্ঞানবিজ্ঞান, সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজ, বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী, বিষয়ভিত্তিক বই পড়তে ধীরে ধীরে আগ্রহী করে তুলুন। উপন্যাস ও গল্পের বই পড়ার পাশাপাশি ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের চরম আত্মত্যাগ, যুদ্ধাপরাধীদের কলঙ্কিত অধ্যায়ের বিবরণসমৃদ্ধ বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার মাধ্যমে তাদের স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে দিন। এর মাধ্যমে তাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সঠিক চিত্র সম্পর্কে তারা অবহিত হওয়ার সুযোগ পাবে। জ্ঞানের পরিধি বাড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে নিজস্ব বিশ্লেষণ ক্ষমতা বিকশিত হতে পারে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে।
মডেল : মুনিয়া

No comments

Powered by Blogger.