সিডনির মেলব্যাগ- শাহবাগ ॥ যে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে by অজয় দাশ গুপ্ত

বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ কতটা অঙ্গাঙ্গি আর নিবিড়, কাদের মোল্লার যাবজ্জীন দ-াদেশ না হলে তা বোঝা যেত না। আমাদের দেশে ইতিহাস বিকৃতি আর ছদ্মবেশী জামায়াত শাসনে আজগুবি এক ধারাবাহিকতা চালু হয়েছিল।
মুক্তিযোদ্ধা হবার পরও জিয়াউর রহমানই এর উদ্গাতা। রাজাকারদের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতিকে মাঠে নামিয়েছিলেন জিয়া। খালেদা জিয়া ও এরশাদ সবলভাবে তার পৃষ্ঠপোষকতা করে যুদ্ধের চিহ্ন পর্যন্ত মুছে দিতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু, চারনেতা, বুদ্ধিজীবী নিধনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ও তার চেতনা মূলত ফিনিক্স পাখি, যে কোন ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়াতে পারে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ জাতি তারই প্রমাণ দিয়েছে আরেকবার।
প্রবাসে আজ আমরা প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী যে পরিচয় যে পরিচয়পত্র ও সূত্র নিয়ে বাস করি তার সাথে মৌলবাদের সম্পর্ক নেই। প্রত্যেকটি বাংলাদেশী (মুষ্টিমেয় কিছু বাদ দিয়ে) এবং তাদের পরিবার গণতান্ত্রিক মুক্তবুদ্ধির চারণ ক্ষেত্র স্বদেশের স্বপ্ন দেখে। যে দেশে আগামী প্রজন্ম নির্দ্বিধায় বিচরণ করতে পারবে। বাংলাদেশকে নিয়ে গর্ব করতে পারবে। এ দেশের মেধা সম্পদ ও শ্রমকে বিশ্বের সাথে যুক্ত করে ইমেজ বিশাল ও বিপুল করে তুলতে পারবে। অন্যান্য রাজনৈতিক দল বা শক্তি কমবেশি তা মানলেও জামায়াত প্রগতির শত্রু। ইদানীং দেশের মতো বিদেশেও তাদের ছানাপোনা আর নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি দেখতেই পাই। বিলেত আমেরিকায় ধর্মের নামে ব্যবসা, ধর্মের নামে চাঁদাবাজি করে সে অর্থ দিয়ে দেশের ক্যাডার পোষে তারা। ইদানীং অস্ট্রেলিয়াতেও সে অপপ্রক্রিয়া চালু হয়েছে। কোমলমতি তারুণ্যকে বিভ্রান্ত করার যাবতীয় অপকৌশলের হোতা বয়সী জামায়াত সমর্থকরা।
বলাবাহুল্য, দ্বিধাবিভক্ত প্রগতিশীল শক্তি সংখ্যায় অধিক হবার পরও তার মোকাবেলা করতে পারে না। না পারার চাক্ষুস করেন দুটো। প্রথমত, অনৈক্য আর দলাদলি। অতঃপর দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি। সুদূর প্রবাসে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ইত্যাকার দলের সাইনবোর্ডসর্বস্ব প্রবাসী সংগঠন নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। এই যে দেশজুড়ে গণজাগরণ, যুদ্ধাপরাধীদের রায় নিয়ে জনঅসন্তোষ এমন কঠিন সময়ে তাঁদের যেভাবে ঝলসে ওঠার কথা তা কিন্তু এখনও দেখতে পাচ্ছি না।
আমার মতো সাধারণ প্রবাসী বাঙালীরা তবে সাহস পাবে কোথায়? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তাদের প্রতিবাদ স্পৃহা?
আজ বাংলাদেশ এক অন্য রূপ, অন্য মূর্তি ধারণ করেছে। শাহবাগ চত্বরকে শাহবাগ স্কয়ার বা প্রজন্ম চত্বর নামে অভিহিত করা হচ্ছে। দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছে মানুষ। লাঠিসোটা, বন্দুক, ককটেল হাতে ঝাঁপিয়ে পড়া জঙ্গী জামায়াত দৃশ্যপট থেকে সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। একেই বলে চেতনা ও আদর্শের শক্তি। যখন মনে হতে থাকে আর কিছু হবে না, সরঞ্জামগুলো নিহায়তই হারমোনিয়াম, তবলা, ঢোল, সেøাগান বা গানের কলি তখনই তারা অস্ত্রের চেয়েও বিপুলভাবে জেগে ওঠে। তার অন্তর্নিহিত শক্তি আর তেজে বন্দুক কার্তুজ, গুলি, ককটেলও ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। তারই উজ্জ্বল সাক্ষী শাহবাগ মোড়। কোন রাজনৈতিক দল, শক্তি, পেশি বা সাহসের ইশারা না থাকার পরও সাধারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধ প্রেম আর স্বাধীনতার চেতনাই বাঙালীকে আবার ঐক্যবদ্ধ করে গোলাপের মতো রঙিন ও উজ্জ্বল করে তুলেছে।
শাহবাগের যে চেতনা ও আদর্শ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া জাগিয়ে তুলেছে তা কি সত্যি অচেনা কিছু? এই দু’দিন আগেও ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী বা বড় বড় শহরজুড়ে জামায়াত-শিবিরের তা-ব বিশ্ববাসীর চোখের সামনে ‘ভি’ চিহ্ন দেখানো রাজাকার দেখে মনে হতো চল্লিশ বছর দীর্ঘ এক সময়, যা হয়ত মূল চেতনাকেও ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারে। মনে হয়েছিল জোশ, জেহাদ ও অর্থবিত্তে জঙ্গী জামায়াতের কাছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি হয়ত আর আগের মতো দাঁড়াতে পারবে না। এই যে আত্ম অমর্যাদা, বিশ্বাসহীনতা তার জন্য দায়ী জামায়াত-শিবিরের অর্থপুষ্ট লেখক, সাংবাদিক, টকশোওয়ালারা। মিডিয়াজুড়ে মধ্যরাতের দাপট, সহাবস্থান আর পুনর্বাসনের নামে জামায়াত তোষণ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যাকে পয়েন্ট অব নো রিটার্ন ভাবাও অমূলক কিছু ছিল না।
যাবতীয় অপপ্রচার, নিন্দা, বিরোধিতা আর উগ্রতার বিপরীতে দাঁড়ানো কোটি কোটি মানুষের শুদ্ধতা জ্বালিয়ে বাংলার মাটিকে আবার দধীচি করে তুলেছে তারুণ্য, এই আলো, এই উজ্জ্বলতার সীমানা পেরিয়ে আটলান্টিক, প্রশান্ত, নীল নদ আর আরব সাগরের পাড়ের বাংলাদেশীদের মনের দোলা দিয়েছে। না থাক নেতৃত্ব, না থাক সংগঠন, সিডনির বাঙালী জানালা খুলে মনে মনে গাইছে, ‘তুমি বৃথাই আমায় শক্তি দিলে শক্তিদাতা।’ কারণ বাংলাদেশের বদনখানি মলিন হলে তার যে নয়ন জলে ভাসতে হয়, সে শুদ্ধতাই দেশ ও প্রবাসকে এক সূত্রে গেয়ে রেখেছে।

No comments

Powered by Blogger.