বিশ্বব্যাংক থেকে অর্থ না নিলেও দুদক মামলা চালিয়ে যাবে- পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র -পর্যবেক্ষণে থাকবে না বিশ্বব্যাংক by মহিউদ্দিন আহমেদ

বিশ্বব্যাংক থেকে সরকার অর্থ না নিলেও পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক যাচাইয়ে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলা চালাবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিশ্বব্যাংক পর্যবেক্ষণ করতে চাইলে দুদকের পক্ষ থেকে কোন আপত্তি নেই বলেও জানালেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। এদিকে বিবৃতিতে দুর্নীতির পূর্ণ ও নিরপেক্ষ তদন্ত শেষ করার জন্য দুদককে উৎসাহ দিলেও পর্যবেক্ষণে থাকবে না বলে জানায়িছে বিশ্ব ব্যাংক। শনিবার সংস্থার বাংলাদেশ অফিসের একটি সূত্র জনকণ্ঠকে এ খবর জানায়। অপরদিকে আজ রবিবার মামলা তদন্তের জন্য দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবে আরও দুই সাক্ষীকে।
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এ সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে দরপত্র আহ্বান করার পর যে সব প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে সেখান থেকে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের তালিকা বিশ্বব্যাংকে পাঠানো হয়। কানাডার এসএনসি লাভালিনকে সর্বনিম্ম দরদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি কাজ পাওয়ার জন্য ঘুষ দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল বলে অভিযোগ তোলে বিশ্বব্যাংক। অভিযোগ ওঠার পর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু করা হয় পরামর্শক প্রাক-যাচাই প্রক্রিয়ার দুর্নীতির অভিযোগ। দুদক উপ পরিচালক মির্জা জাহিদুল ইসলাম ছিলেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। এ অভিযোগের বিষয়ে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, তৎকালীন সেতু বিভাগের সচিব মোশররফ হোসেন ভুইয়া, জাতীয় সংসদের এক হুইপের ছোট ভাই নিক্সন চৌধুরী, চার প্রকৌশলী, এসএনসি লাভালিনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি জিয়াউল হক, গোলাম মোস্তফা এবং অপর চারটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশের ১৪ প্রতিনিধিসহ ৩১ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। একই বিষয়ে পদ্মা সেতুর মূল্যায়ন কিমিটির সঙ্গেও আলাপ করেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এর মধ্যে জুলাই মাসের ২৩ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা ঢাকায় এসে প্রস্তাব দেন তিন সদস্যের একটি আন্তর্জাতিক মানের প্যানেলের সঙ্গে দুদকের অনুসন্ধান কাজে শেয়ার করার। কিন্তু দুদক সেই প্রস্তাবে তখন রাজি হয়নি। দুদকের যুক্তি ছিল এটা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং দুদকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের শামিল। এছাড়া সরকারকে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান এবং ওই সময়ের সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভুইয়াকে অনুসন্ধান চলাকালীন সময়ে ছুটিতে পাঠনোর শর্ত দেয় বিশ্বব্যাংক। কিন্তু তখন দুদক ও সরকার তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এমন অবস্থায় দুর্নীতির অভিযোগ তুলে গত বছরের জুন মাসের ২৯ তারিখ পদ্মা সেতু প্রকল্পে ২৯০ কোটি ডলারের এই প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে সংস্থাটি। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় আবারও ঋণ দিতে সম্মত হলেও দুর্নীতির অনুসন্ধান চলা অবস্থায় তাদের পূর্বের শর্ত বাস্তবায়নের দাবিটি আগের মতোই রাখে। পরবর্তীতে নানা দেনদরবারের পর সংস্থার দেয়া চার শর্ত মেনে নেয় সরকার ও দুদক। এতে করে ২০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতু প্রকল্পে সম্পৃক্ত হওয়ার ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক। শর্তানুযায়ী ৫ অক্টোবর পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির তদন্ত পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল ঘোষণা করে বিশ্বব্যাংক। ওয়াশিংটনে অবস্থিত সংস্থার প্রধান কার্যালয় থেকে তিন সদস্যের এ প্যানেল ঘোষণা করা হয়। পরদিন ৬ অক্টোবর এ সংক্রান্ত একটি বিবৃতি প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিস। প্যানেলটির নেতৃত্ব দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সাবেক প্রধান প্রসিকিউটর লুই গাব্রিয়েল ওকাম্পো। যিনি আইসিসির হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তে কাজ করতেন। অপর দুই সদস্য হলেন, হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক কমিশনার টিমোথি টং এবং যুক্তরাজ্যের দুর্নীতি দমন কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অল্ডারম্যান। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনও তাদের পূর্বের অনুসন্ধান কমিটির পরিধি বৃদ্ধি করে চার সদস্য করেন। একই সঙ্গে অনুসন্ধান কমিটির প্রধান করা হয় আবদুল্লাহ আল জাহিদকে। বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দল দুদকের অনুসন্ধান কাজ পর্যবেক্ষণ করতে ১৪ অক্টোবর ঢাকায় আসেন। দুদকের সঙ্গে ১৪ ও ১৫ তারিখ দুই দফা বৈঠক করে ১৬ তারিখ ঢাকা ত্যাগ করেন তারা। দ্বিতীয়বার পর্যবেক্ষণে আসেন ১ ডিসেম্বর। বিশেষজ্ঞ প্যানেলের পরামর্শ অনুযায়ী দুদক প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, তৎকালীন, যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভুইয়া, নিক্সন চৌধুরীসহ সহ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসবাদ করে। টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির প্রধান বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ও বুয়েটের অধ্যাপক প্রফেসর ড. আমম সফিউল্লাহর বক্তব্য নেয় দুদক। গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর ৭জনকে আসামি করে একটি মামলাও দায়ের করে দুদক। এ মামলার দুই আসামি মোশাররফ হোসেন ভুইয়া, কাজী ফেরদাউসকে গ্রেফতার করে তদন্তের সুবিধার্থে কারাবন্দী করে রাখলেও বিশ্বব্যাংকের প্যানেল দুদকের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলে গত মাসে একটি বিবৃতি দেয়। দুদক ওই বিবৃতির জবাব দেয় একই মাসের ৯ তারিখে। দুদকের জবাবের পর বিশ্বব্যাংকের প্যানেল কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি। এদিকে সরকারের মেয়াদ ক্রমান্বয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ঋণ দিতে বিলম্ব করলে সেতু বাস্তবায়ন করা যাবে না আশঙ্কা থেকে সরকার ঋণ দেয়ার আন্তর্জাতিক এ সংস্থাকে অর্থ লাগবে না বলে জানিয়ে দেয়।
এমন পরিস্থিতিতে পদ্মা সেতুর প্রকল্পের পরামর্শক যাচাইয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে অর্থায়ন না করলে মামলা চলবে কিনা জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থায়নের সঙ্গে তদন্তের সম্পর্ক নেই। দুদক মামলা তদন্ত কাজ শেষ করবে।

No comments

Powered by Blogger.