ককটেলের কল পবনে নাড়ায় by শেখর ইমতিয়াজ

ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে_ গ্রামবাংলার এই প্রাচীন প্রবাদটি ইদানীং বাংলাদেশের নগর-রাজনীতিতে জমজমাট বাজার পেয়েছে। অযোগ্য কারও মধ্যে নেতা হওয়ার খায়েশ চাপলে প্রথমেই অভিনেতা সাজে।
এরপর তাবৎ মিথ্যাচারিতা, অমিতভাষণ, চিৎকার, হুংকার, দম্ভ, নিজের কুকর্ীতির দায়ভার নির্দোষের ওপর চাপিয়ে দেয়ার নানান অপকৌশল প্রকাশের অলিগলি চিনে ফেলে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের বেলেলস্নাপনা শুরম্ন হয়েছে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর থেকে। শিৰা ও সংস্কৃতি চর্চা, মহানুভবতা, উদারতা ও শালীন রম্নচিবোধ রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে উবে যাওয়ার পথে। পরমত সহিষ্ণুতা নেই, বেড়েছে পরশ্রীকাতরতা। প্রাসঙ্গিকভাবে উলেস্নখ করতেই হয়, অপরের মধ্যে শ্রীও খুব একটা নেই যেটুকু আছে তা বিত্তের শ্রী, চিত্তের নয়। ফলে পরাজিত রাজনৈতিক দল বিজয়ীদের কাজেকর্মে এবং কথাবার্তায় গন্ধ খুঁজে ফেরে। হাস্যকরভাবে মিথ্যের বেসাতি করে বেড়ায়। এতে শানত্মিকামী ও গণতন্ত্রমনা জনগণ ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠে। রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অতিসম্প্রতি ঘটে যাওয়া রাজপথ নাটকে উন্মোচিত হলো প্রতারকদের মুখোশ।
২৩ ফেব্রম্নয়ারি রাত সোয়া দশটার দিকে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সামনে দুটো বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। এই বোমা বিস্ফোরণের রেশ ধরে ২৫ ফেব্রম্নয়ারি বিকেলে পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিৰোভ সমাবেশে বিএনপির নেতারা বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা সুষ্ঠুভাবে তদনত্মের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান। গণতান্ত্রিক সরকার অবশ্যই বিরোধী দলের দাবিকে সম্মান জানাবেই। সুতরাং সুষ্ঠুভাবেই তদনত্ম হয়েছে। তদনত্মে কী বেরিয়ে এসেছে, সে প্রসঙ্গ পরে উলেস্নখ করা হচ্ছে। তার আগে বিএনপি নেতাদের মনত্মব্য দেখা যাক। ২৫ ফেব্রম্নয়ারি সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরম্নল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়াকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এই বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মির্জা আজমের সংশিস্নষ্টতার ইঙ্গিতও নাকি তিনি পেয়েছেন। এ ধরনের ঘৃণ্য মিথের বেসাতি এবং উতরচাপান হয়েছিল জনপ্রিয় ও সফল রাজনীতিবিদ আহসানউলস্নাহ মাস্টার এবং শাহ কিবরিয়াকে হত্যার পর। এই দুটো হত্যাকান্ড নাকি আওয়ামী লীগই ঘটিয়েছিল। কিন্তু তদনত্ম এবং মাননীয় আদালত জানে প্রকৃত সত্যটি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৭ ফেব্রম্নয়ারি সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। ব্যাপারটি নিয়ে বিএনপির মধ্যে শোরগোল হচ্ছিল, সরকারের পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে। বিএনপি নেতৃবৃন্দ ভুলে গিয়েছিলেন, ২০০১ সালে ৰমতায় এসে বেগম জিয়া নিজেই বিরোধীদলীয় নেতার স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) দিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা তুলে নেন। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার প্রাণনাশের একাধিক হুমকি থাকা সত্ত্বেও খালেদা জিয়া এ কাজটি করেননি। একাধিকবার শেখ হাসিনার ওপর হামলা হলেও তৎকালীন বিএনপি সরকার শেখ হাসিনাকে আর এসএসএফ দেয়নি। খালেদা জিয়া ৰমতার দম্ভে জাতির জনকের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য করা আইনটিও বাতিল করে দেন।
এবার আসা যাক হাওয়াই মিঠাই নাটকের রচয়িতা সম্পাদক-অভিনেতা খোন্দকার পবনের প্রসঙ্গে। দেখা যাক, কীভাবে নিজের তৈরি খন্দে পড়েন তিনি। সূত্রটি হচ্ছে তার নেতা হওয়ার হাউশ ছিল খুব। হাউশে বেহুশের মতো কাজ করতে গিয়ে ফেঁসে গেলেন। পবনের বন্ধু শোভন মতিগতি ঠিক রাখতে পারল না। হায়রে! শোভন এমন একটা অশোভন কাজ করল ? পুলিশের কাছে সব ফাঁস করে দিল! এ লজ্জা পবন কোথায় ঢাকবেন? সবই যে বাতাসে ছড়িয়ে যাবে? ছড়িয়ে গেলই। সাংবাদিকরা নাটকের খ-চিত্রসহ সব প্রকাশ করে দিলেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ বিএনপির চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করেছে। বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের পুত্র খোন্দকার আকতার হামিদ পবন ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে ওই ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন বলে তদনত্মকারী সংস্থা নিশ্চিত। ২৬ ফেব্রম্নয়ারি রাতে ডিবি পুলিশ বসুন্ধরা সিটির সামনে থেকে পবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গোলাম সাবি্বর শোভনকে গ্রেফতার করার পর সব তথ্য উদ্ধার করা হয়। শোভনের বাড়ি কলাবাগানের বশির উদ্দিন রোডে। সেখান থেকে ঘটনার সময় ব্যবহৃত শোভনের গাড়িটিও আটক করেছে পুলিশ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনের ভাষ্য, এ ঘটনার খলনায়ক হচ্ছেন আকতার হামিদ পবন। তিনি এখন পলাতক হলেও তাকে গ্রেফতার করার জন্য পুলিশের কয়েকটি দল বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে। পবনবন্ধু শোভন জানান, ককটেল বিস্ফোরণে অংশ নিয়েছিল ছয়জন। বিস্ফোরণে পবন আহত হননি। তারপরও আহত সেজে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
নাটকের পরিকল্পনা, মহড়া, সম্পাদনা, অভিনয় সবই ঠিক ছিল। নাট্য বিশেস্নষকরা ভাষণ বিবৃতি মনগড়া হলেও ভালই দিয়েছেন। গোল বাধাল শোভনের স্বীকারোক্তি। পুলিশ সকল সত্য উদ্ধার করে সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করে দিল। বিএনপি মহাসচিবের গুণধর পুত্র পবন চেয়েছিলেন ঢাকা মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ। ম্যাডামের কাছে প্রিয়পাত্র এবং নিবেদিতপ্রাণ নেতা হওয়ার সকল জল্পনাকল্পনা মন্ত্রণা ভেসত্মে গেল।
পবনের সঙ্গে শোভনের ঘনিষ্ঠতার শুরম্ন তিন বছর আগে থেকে। পবন বিএনপির মহাসচিবের পুত্র হওয়ায় তাকে ব্যবহার করে শোভন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির কোন পদ না পাওয়ায় হতাশায় মুষড়ে পড়েছিলেন মহাসচিবের এই পুত্রটি। এক পর্যায়ে মহানগর শাখার সাংগঠনিক পদ পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে নানান ফন্দি অাঁটতে থাকেন। (অতীতে অসংখ্যবার তিনি অনেক কিছুর জন্যই মরিয়া হয়ে উঠেছেন।) ২২ ফেব্রম্নয়ারি রাতে শোভনের বাড়িতে পলস্নবী থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক রনি, সোনাইমুড়ী থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ কুমার ও চাটখিল থানা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ফারম্নককে নিয়ে পবন একটি বৈঠক করেন। ২৩ ফেব্রম্নয়ারি রাত আনুমানিক দশটায় শোভনের গাড়িযোগে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ের সামনে যাওয়ার পর পবন গাড়ি থেকে নেমে যান। একটু পরে দুই যুবক গাড়িতে উঠতে গিয়ে পানি খাওয়ার কথা বলে। মিনিটখানেক পরেই দুটো ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। প্রতিপৰ হামলা চালিয়েছে বলে দ্রম্নত তারা সরে আসে বিজয় সরণিতে। জানানো হয়, পবন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
বেশ সুন্দর একটা কাইমেক্সে পেঁৗছেছিল নাটকটি। কিন্তু উপসংহারে যাওয়ার আগেই শেষ অঙ্কটি পঙ্কে নিমজ্জিত হলো। এই পবন পাক মেখেছেন অনেকবার। গাড়ি চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বহনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরম্নদ্ধে। চোরাই গাড়িসহ ডিবির হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন চারদলীয় জোট সরকারের আমলেই। তখন অবশ্য ৰমতাবানদের পুত্ররা অনেক ৰমতার অধিকারী ছিলেন, যে সবের খেসারত জাতি এখনও পর্যনত্ম দিয়ে যাচ্ছে। এই খোন্দকার পবন বংশাল রোডে মোবাইল ফোনের দোকানে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে ব্যবসায়ীকে লৰ্য করে গুলি ছোড়েন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পবন বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রসহ র্যাবের হাতে ধরা পড়েন। আদালত একটি মামলায় তাকে ১৪ বছরের জেল দেয়। দায়ের করা সকল মামলায় তিনি এখন জামিনে মুক্ত। সাংগঠনিক সম্পাদকের পদটি পাওয়ার পথও মুক্ত হয়ে যেতে পারে। কারণ কতিপয় নষ্টের কাছে রাজনীতি জিম্মি হওয়ার পথটি ইদানীং ক্রমশই প্রশসত্ম হচ্ছে। যদিও তার শুরম্ন পঁয়ত্রিশ বছর আগে থেকেই। যুদ্ধাপরাধীরা এখন বিজয় দিবস পালন করে। হয়ত স্বাধীনতা দিবসও পালন করার মতো দুঃসাহস দেখাবে। তারা চাচ্ছে রাষ্ট্রটিকে সব সম্ভবের দেশে পরিণত করতে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সাম্প্রদায়িকতার উত্থান এবং বিষবৃৰের বিসত্মার ঘটে। মোশতাক অনৈতিকভাবে গদিতে বসেই জাতির উদ্দেশ্যে প্রথম টেলিভিশন ভাষণ শুরম্ন করলেন বিসমিলস্নাহ বলে এবং তা প্রবল উচ্চৈঃস্বরে। ধর্মপরায়ণ মুসলমানরা কাজ শুরম্নর আগে বিসমিলস্নাহ বলেন, এখানে কারও কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু মোশতাকের উচ্চৈঃকণ্ঠে বিসমিলস্নাহ বলার ভেতরে লোক দেখানো ব্যাপার ছিল। এছাড়া মোশতাকের সেনাপতি জাতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলা শব্দ মুছে ফেললেন। যুদ্ধাপরাধীর হাতে প্রধানমন্ত্রিত্ব এবং ধর্মমন্ত্রিত্ব দেয়া হয়। সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ আসনে বসানো হয়। ডবল মার্চ করে ধর্মনিরপেৰতা বাদ রেখে পাকিসত্মানের দিকে এগুতে থাকে। ইসলামী মসলা দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ করা হয়। এরপর আরেক সেনাপতি লেবাস পাল্টিয়ে বাঙালী হতে গিয়ে ভয়ঙ্কর মুসলমান এবং নিকৃষ্ট কবি হয়ে উঠলেন। সেনানিবাসে নিজেই নিজের নামে স্টেডিয়াম বানালেন। পুরো বাংলাদেশকে বানালেন সাবেক সেনাপতির স্মরণস্থল। ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ব্যক্তি মালিকানায় চলে যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি চলে যায় অছাত্রদের হাতে। দুই সেনাপতিই সংবিধানে পরিবর্তন আনার ধৃষ্টতা দেখান, নির্বাচন নিয়ে প্রহসন করেন, শিৰকদের চরিত্রে সর্বনাশ ঘটান। দ্বিতীয় সেনাপতির আমলে নির্বাচনে প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছেন যে সকল শিৰক তারা জানেন সেনাপতিরা রাষ্ট্রভার কেড়ে নিলে মূল্যবোধ কতটা ধ্বংস হতে পারে। এক সেনাপতি সানগস্নাস, আরেক সেনাপতি ভুল কবিতা ছাড়া পরবতর্ী প্রজন্মকে আর কিছু দিতে অৰম ছিলেন। তারা কেড়ে নিয়েছেন অসংখ্য মেধাবী ছাত্রের স্বপ্নকে, তাদের বিকশিত জীবনকে। জীবানু ছড়িয়েছেন জোয়ার এনে দিয়ে গেছেন রম্নগ্ন রাজনৈতিক বিশ্বাসে।
সুতরাং এই পথ ধরে দীর্ঘদিন একটি জাতি পচনশীল মূল্যবোধকে লালন করেছে। জেগে উঠেছে ধর্মান্ধ জঙ্গীবাদ। কমে গেছে মানুষের জীবনের মূল্য। গণতন্ত্র চর্চায় অগ্রসর হতে ভুলে গেছে। সুতরাং সেখানে একজন পবনের বেড়ে ওঠায় সত্মম্ভিত হওয়ার কিছু নেই। দুই সেনাপতি এদের জন্য মসৃণ ময়দান তৈরি করে গেছেন। রাজনীতিতে সুভাষ এবং সুবাতাস কবে থেকে বইবে তা জানে ভবিতব্য।

No comments

Powered by Blogger.