প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কোটা পূরণ হয় না

ঢাকার বাইরের স্কুলগুলো এখনো প্রতিবন্ধীদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। প্রায় সব স্কুলেই প্রতিবন্ধীদের জন্য অবকাঠামো, শিক্ষা সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, পরিবেশ—কিছুই নেই।
স্কুল কর্তৃপক্ষও প্রতিবন্ধীদের ভর্তি করতে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। প্রতিবন্ধীদের জন্য যেসব স্কুল আছে, সেগুলোতে অব্যবস্থাপনা ব্যাপক।
‘বেসরকারি স্কুল/স্কুল অ্যান্ড কলেজ, নিম্নমাধ্যমিক ও সংযুক্ত প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালা ২০১২’ অনুযায়ী, ন্যূনতম যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে ভর্তির ক্ষেত্রে শূন্য আসনের ২ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত থাকবে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য। সরকারের ভর্তিসংক্রান্ত নির্দেশনা থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই কোটা পূরণ করা হয় না।
বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোবারক আলী প্রথম আলোকে জানান, তাঁর বিদ্যালয়ে একজনও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী নেই। বছরের শুরুতে কেউ কেউ ভর্তি হতে এলেও আলাদা পাঠদানের ব্যবস্থা না থাকায় তারা ফেরত যায়।
নন্দীগ্রামের মতো উপজেলা শহরেই শুধু নয়, জেলা শহরের নামী স্কুলগুলোতেই প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষার পরিবেশ নেই।
আহসানুল হক ও আররাফী হোসেন—দুই ভাই জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। দুই ভাইকে ২০০৯ সালে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়েছিল টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে। দোতলা-তিনতলায় উঠে ক্লাস করাও ছিল তাদের জন্য কষ্টসাধ্য।
বাবা আনোয়ার হোসেন বাধ্য হয়ে দুই ছেলেকে সরকারি স্কুল ছেড়ে পার্শ্ববর্তী বিবেকানন্দ উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করান। গত বছর দুই ভাই ওই স্কুল থেকে নবম শ্রেণীতে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছে। বিবেকানন্দ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনন্দমোহন দে বলেন, প্রতিবন্ধী এই দুই শিক্ষার্থীর কথা মাথায় রেখেই তাদের ক্লাস কখনো নিচতলা থেকে সরানো হয়নি।
চট্টগ্রামের নামী স্কুল ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাসমত জাহান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবন্ধীদের বাড়তি যত্নসহকারে পাঠদান করার পরিবেশ, প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ানো, হুইলচেয়ার ওঠানো-নামানোর জন্য আলাদা সিঁড়ির ব্যবস্থাসহ অবকাঠামো কোনো সুবিধা তাঁর বিদ্যালয়ে নেই।
সিলেটের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট বসার আসন নেই। এমনকি তাদের জন্য আলাদা কোনো সুযোগ-সুবিধাও নেই।
সব স্কুল চায়, শিক্ষার্থীরা শতভাগ উত্তীর্ণ হোক। কিন্তু প্রতিবন্ধী ভর্তি হলে এ ক্ষেত্রে উত্তীর্ণ হওয়া নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়। শিক্ষকেরা এ ঝুঁকি নিতে চান না। প্রতিবন্ধীদের স্কুলে নিতে শিক্ষকদের অনাগ্রহের এও এক কারণ। শিক্ষকদের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে এমন কথা বলেছেন।
প্রতিবন্ধীদের জন্য জেলা পর্যায়ে সরকার পরিচালিত বিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত রয়েছে।
জয়পুরহাট জেলায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সমন্বিত অন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কালাই উপজেলার পুনট অন্ধ স্কুলের হাউস কাম প্যারেন্টস টিচার আজিজুল ইসলাম খান বলেন, শিক্ষার্থীদের আবাসন, খাওয়া ও পোশাক বাবদ মাথাপিছু যে বরাদ্দ, সেটা খুবই নগণ্য। আবার সারা বছরে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিনোদনের তেমন কোনো সুযোগ নেই এখানে।
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সহপাঠীদের বিরূপ মনোভাব রয়েছে—এমন কথা স্বীকার করেন শিক্ষকদের অনেকে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক মনোভাব পরিবর্তনে কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন চট্টগ্রামের খাস্তগীর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাসমত জাহান।
স্কুলগুলোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ভর্তি এবং তাদের শিক্ষা কার্যক্রম সঠিকভাবে চলছে কি না, তা পর্যবেক্ষণের জন্যও কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী সনদ দিয়েই সমাজসেবা অধিদপ্তরের কাজ শেষ।
চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক পারভিন মেহতাব প্রথম আলোকে বলেন, কোনো প্রতিবন্ধীকে বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে সনদ দেয় সমাজসেবা কার্যালয়। পরবর্তী সময়ে বিদ্যালয়ের সঙ্গে আর কোনো সম্পৃক্ততা থাকে না সমাজসেবা কার্যালয়ের।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন কামনাশীষ শেখর, টাঙ্গাইল; আনোয়ার পারভেজ, বগুড়া; সুমনকুমার দাশ, সিলেট এবং মেখ্যাইউ মারমা, চট্টগ্রাম]

No comments

Powered by Blogger.