জীবনের নীলিমায় নিজেকে খোঁজা

কবি তার ব্যক্তিগত আবেগ ও মনের অনুভূতিগুলোকে, বেদনার মুহূর্তগুলোকে নিজস্ব ভাষার শৈলীতে প্রকাশ করেন। কবিতার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হোক কবির পারিপার্শ্বিক সমাজ ও সামাজিকভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো উঠে আসে কবির মনের ভাবের প্রকাশে।
নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে রূপময়ও আকর্ষণীয় ভাব, ভাষা, সৌন্দর্য, ছন্দের গাঁথুনিতে কবি উপযোগী করে তোলেন। বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতার নির্যাস যেন কবিতার সৌন্দর্য ও কবিতার নীলিমায় প্রকাশিত হয়ে ওঠে। তেমনিভাবে কবি মেহের নিগার তার সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ ‘খুঁজি’তে নিজের মনের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে খুঁজেছেন সমাজের অন্তর্নিহিত সত্যকে। সমাজের মধ্য থেকে নিজের দুঃখ-কষ্টগুলোকে লেখনীর কোমল স্পর্শে প্রতিপালিত করেছেন বিভিন্ন সময়ে লেখা কবিতার মধ্য দিয়ে। কবির প্রকাশের ক্ষমতা ও মানস জগতের মনের ছবিতে বাস্তবতার পটভূমিতে ফুটিয়ে কবিতাকে তিনি করে তুলেছেন হৃদয়গ্রাহী। সামাজিক পরিবেশের মধ্যে কবির বেড়ে ওঠা। তিনি নিজেই অকপটে বলেছেন কবিতা নিয়ে ভাবনার কথা। “নিত্যনতুন বিশ্বস্ততার সাথে কবিতা আমার মনে আশ্রয় নেয়। আমিও সমর্পিত হই কবিতার মাঝে/সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে কবিতা নিয়ে প্রকৃতির রূপের মাঝে হারিয়ে যাই।’ কবি মেহের নিগার কবিতার মাঝে রূপ, সৌন্দর্য, নান্দনিকতার স্বাদ আহরণ উপমিত সমাজ ও পরিবেশের মাঝ থেকে। প্রতীকে রূপায়নে ও কবিতায় তার অনুভূমি বাঙময় হয়ে উঠে অনায়াসেই। তাই তো সাজাতে চাই কবিতায় বলেছে
যা কিছু সুন্দর, যা কিছু পবিত্র সব-সব কিছু দিয়ে সাজাতে চাই নিজেকে
একটি বৃক্ষ চাই, যেখানে নিঃশ্বাস ভরে যাবে বিশ্বাসে
একটি শ্যামল ছায়া চাই, যার স্নিগ্ধতায় ঢেকে যাবে
বিঁধে থাকা গাঁজয়ের কষ্টগুলো,
একটি প্রতীক্ষা চাই, যে আসবে বলে
বুকে বাজবে সরোদের মিষ্টি সুর
বুকের পাঁজরে, কণ্ঠে, উচ্চারণে সর্বদা খুঁজি বেঁচে থাকার বিশ্বাসগুলোকে। (সাজাতে চাই)
কবি জীবনবোধের সঙ্গে নিবিড় পরিচয়ে সুখ-দুঃখের বেদনায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেন প্রতিনিয়ত। কবি সমাজে ও ভালোবাসার দিনগুলোতে প্রাণবন্তু ভাবনা কবিকে প্রতিনিয়ত বিদ্ধ করে, জীবন চেতনা ও ভালোবাসার স্বপ্নজাগানিয়া প্রখর হওয়ার ফলে অন্তরালে কবির মনে বাজে বিস্ময় বোধের উচ্চারণ তাই তো কবি বলেন
ভালোবাসা, প্রস্ফুটিত গোলাপের খসে পড়া
অসংখ্য পাপড়ি, সামান্য ফুঁৎকারে উড়ে যায় দূর আকাশে, ছোঁয়া যায় না আর কখনো।
ভালোবাসা দীঘির পানিতে ঝুঁকে থাকা লাল
হিজল তমাল ফুল
ভালোবাসা নতুন উদ্দীপনা ও ব্যর্থতার আশঙ্কায়
কুঁকড়ে যাওয়া মন।”
(ভালোবাসা পৃষ্ঠা ৪৭-৪৯)
সমাজে ঘটে যাওয়া যত অসঙ্গতি ও পরিবেশ থেকে মুক্তির দিশা খুঁজতে মনে যে বিপ্লবের স্পন্দন ভিড় করে কবির মনে। সেই চেতনার পঙ্ক্তিমালা আঁকতে গিয়ে কবি মেহের নিগার উচ্চারণ করেছেন সাহসী পঙ্ক্তিমালা। বিরাজমান সামাজিক পরিস্থিতি তীব্র ক্ষোভের প্রকাশ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে নিতে নিজেকে করেছেন আত্মমগ্ন। কবির তীব্র আবেগমথিত উচ্চারণে সমাজ ও প্রতিবেশের নির্মম বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠে ‘মুছে ফেলো’ কবিতার পঙ্ক্তিতে।
যেমন- বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদ করি
আর দিওনা বিষের ফোঁটা
স্বপ্নগুলো থেমে গেছে
থামাও এবার জাদুর মহড়া
খোলো বিবেকের বোতাম।
টলমলিয়ে কাঁপে নদীর জল, রামধনুর রং নেই আকাশে
কালো কালো শুধুই অন্ধকার।
(মুছে ফেলো-পৃষ্ঠা : ৫১)
জীবনের প্রতি কবির স্বপ্ন, সৃষ্টির বিনষ্ট নিমগ্নতায় কবি সুন্দর শৈল্পিক চেতনায় সমাজ পরিবর্তনের ও নিজের সত্যকে ধারণ করে অনেক স্বপ্নের আঁকা কল্পনায় বিভোর ছিলেন। কবিতার কুশলতা কবিকে কোমল আবেগে নিয়ে গেছে অনেক দূর, কবি তো তাই চেনাজানা স্বজনদের দুঃখ-কষ্ট, ভালোবাসায় অজান্তে আঁকতে চেয়েছেন কবিতার ছায়াপাতে। মেহের নিগার মূলত স্বাপ্নিক কবি, সমাজ সচেতন কবি। জীবনের আনন্দ-বেদনা প্রতিনিয়ত সঞ্চারিত হয়ে ওঠে তার কবিতায়। কবিতা গ্রন্থের আশির অধিক কবিতায় উঠে এসেছে জগৎ ও জীবনবোধের সুন্দর রূপায়ন, দৈনন্দিন জীবনের খ-চিত্রের রূপায়ন, মানবিক ভালোবাসার আর্তি। সমাজের রহস্যময় বাস্তবতা, মানুষের আত্মপরিচয় ছাড়াও মনোবেদনার ভাবনা জগতের মনোবীক্ষণ করেছেন কবি কবিতায়।
কবি প্রকৃতির অসংখ্য রূপের সৌন্দর্যে কবিতায় প্রতিনিয়ত ডুব দেন। হারিয়ে যাওয়া বোধগুলো উচ্চারিত হয় মননের জগতজুড়ে। তাই তো কবিতা সবসময় কবিকে সামনে চলার পথ করে দেয়।
মেহের নিগারের কবিতার বই ‘খুঁজি’ প্রকাশিত হয়েছে একুশের ফেব্রুয়ারি ২০১২-তে নিসর্গ প্রকাশনী ঢাকা থেকে। বইটির চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন মঈন উদ্দীন পাঠান। মূল্য ২০০ টাকা। বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
আরিফ চৌধুরী

No comments

Powered by Blogger.