তলবে সাড়া দেননি তৌফিক ॥ অভিযানে নেমেছে দুদক- বিটিসিএলের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের পরও বহাল তবিয়তে! by মহিউদ্দিন আহমেদ

 বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের হোতা খ্যাত মোহাম্মদ তৌফিককে খুঁজতে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
কিন্তু কোনভাবেই তাঁর সন্ধান পাচ্ছে না। সর্বশেষ দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে নোটিস করা হয়। সোমবার আসতে বলা হলেও তিনি দুদকের ডাকে সাড়া দেননি। শুধু তাই নয়, সরকারী চাকরি বিধিমালার নিয়মও তাঁর বেলায় অকার্যকর। চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী কোন সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হলে ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অবশ্যই সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হবে। কিন্তু এ নিয়মের উর্ধে রয়েছেন গাজীপুর টেলিকম স্টাফ কলেজের ডিজি মোহাম্মদ তৌফিক।
২০০৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিলে চার বছর পরও তিনি চাকরিতে বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। বরং পদোন্নতি পেয়ে তিনি এখন গাজীপুর টেলিকম স্টাফ কলেজের ডিজির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল আছেন। এর আগে তিনি বিটিসিএল রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন।
অবৈধভাবে ভিওআইপি ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগে মোহাম্মদ তৌফিক তত্ত্বাবধায়ক আমলে জেল খেটেছেন। সে সময় তিনি বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ডের (বিটিটিবি) চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক ছিলেন। বিটিটিবি থেকে বিটিসিএলে কর্মরত থাকা অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে অনিয়মের দায়ে তিনি চার দফায় পাঁচ বছরেরও বেশি সময় সাময়িক বরখাস্ত ছিলেন। দুর্নীতি ও খুনের মামলাসহ তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে মোট আটটি মামলা দায়ের হয়। এর মধ্যে দুটি মামলা এখনও বিচারাধীন। তাঁর বিরুদ্ধে দুদকও অভিযোগপত্র দাখিল করেছে।
কিন্তু এসব নিয়ে মোহাম্মদ তৌফিকের কোন বিকার নেই। তিনি সাংবাদিকদের কৌশলে এড়িয়ে চলেন। তাঁর কার্যালয়ে দেখা করার অনুমতি মেলে না। আর মুঠোফোনেও তাঁকে পাওয়া দুরূহ।
অবৈধ ভিওআইপির অভিযোগ ও
বিচারাধীন মামলা ॥ গ্রেফতারের পর তৌফিকের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, বনানীর ইকবাল টাওয়ারে তাঁর বেনামী প্রতিষ্ঠান ‘ও-নেট লিমিটেড’ এবং গুলশানের নিকেতনের একটি বাসা থেকে প্রচুর পরিমাণে ভিওআইপি সরঞ্জাম উদ্ধার করে যৌথ বাহিনী।
ও-নেট লিমিটেড থেকে পাওয়া ডায়াগ্রাম অনুযায়ী, তৎকালীন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) জানতে পারে, ঢাকার উত্তরা, ধানম-ি, বাড্ডা, বারিধারা, কারওয়ান বাজারসহ আরও অনেক জায়গায় তৌফিকের অবৈধ ভিওআইপির নেটওয়ার্ক বিস্তৃত ছিল। বিটিটিবি থেকে ডায়াল আপ সার্ভিসের জন্য ১২টি ই-১ এবং সাবমেরিন কেবল নেটওয়ার্ক থেকে ১৪ মেগা ব্যান্ডউইথ এসব জায়গায় ব্যবহার ও বিতরণের প্রমাণ পাওয়া যায়। ও-নেট লিমিটেডের ৯ শেয়ারহোল্ডারের তিনজনই তৌফিকের নিকটাত্মীয়। একজন তৌফিকের মা, আরেকজন বোন ও অন্যজন স্ত্রী। বিটিআরসি নিশ্চিত হয়Ñ পরিবারের সদস্যদের নামে ব্যবসা পরিচালনা করতেন তৌফিক নিজেই। গ্রেফতারের পর রিমান্ডে তৌফিক এ দেশে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার গোড়াপত্তনের সঙ্গে জড়িত থাকার কথাও স্বীকার করেন। এ ছাড়া মাঝে মাঝে সাবমেরিন কেবল কেটে দিয়ে ভিওআইপি ব্যবসার মাধ্যমে প্রচুর অর্থ আয়ের কথাও স্বীকার করেন তিনি। ২০০৮ সালে গণমাধ্যমে তৌফিকের এসব খবর প্রচারও করা হয়। অবৈধ ভিওআইপি সরঞ্জাম উদ্ধারের ঘটনায় তৌফিকের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় ২০০৮ সালের ৭ মার্চ টেলিযোগাযোগ আইনে মামলা দায়ের হয়। মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ-৭-এ বিচারের জন্য বদলি করা হয়। মামলাটি এখন হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। আর এ মামলাটিও নিষ্পত্তি হয়নি বলে জানা গেছে।
দুদকের অনিষ্পন্ন মামলা ॥ ২০০৮ সালের ২৫ আগস্ট রমনা থানায় তৌফিকের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সহকারী পরিচালক মোঃ তৌফিকুল ইসলাম। তিন কোটি ৮৯ লাখ তিন হাজার ২৯৪ টাকার সম্পদ অবৈধভাবে অর্জন ও তা গোপন করার অভিযোগ। ওই মামলায় তৌফিকের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দেয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকার সিনিয়র বিশেষ জজ ও মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। যদিও তৌফিকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২২ জুন হাইকোর্ট মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেছে। ওই স্থগিতাদেশ এখনও বহাল।
এ মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম। মামলাটির ফয়সালা হয়নি জানিয়ে দুদকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, ‘তৌফিক সাহেবের বিরুদ্ধে মামলার চার্জশীট থানা ও দুদকে জমা রয়েছে। তাঁর মামলাটি বর্তমানে চলমান। আদালতে মামলাজটের কারণে শুনানির সিরিয়াল আসছে না। আর এই মামলার ফয়সালা করতে হলে বাদী ও তদন্তকারী দুজনকেই উপস্থিত থাকতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুদকের মামলাটি বিশেষ মেট্রো মামলা ৭৪/২০০৯ হিসেবে তালিকাভুক্ত রয়েছে। ওই মামলা চ্যালেঞ্জ করে এর বিপরীতে তৌফিক ‘ক্রিমিনাল মিসকেস ৭৯০৯/২০০৯’ করে ওই মামলার পক্ষে ২০০৯ সালের ২৪ জুন একটি ‘স্টে অর্ডার’ নিয়েছেন। ওই স্টে অর্ডার পরে আবারও ছয় মাসের জন্য বাড়ানো হয়েছে। এর মেয়াদ ছিল ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ পর্যন্ত। ফলে এখনও মামলাটির কোন সুরাহা হয়নি। এ ছাড়া গত বছরের ৫ নবেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে আরেকটি মামলা করেছে দুদক। মামলার করার পর তাঁকে বদলি করা হয় গাজীপুর টেলিকম স্টাফ কলেজে। সেখানে তিনি ডিজি হিসবে বদলি হলেও অফিসে যোগ না দিয়ে দুই মাসের ছুটি নেন। ৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর ছুটি শেষ হবে। এ ছাড়া দুদকের এই মামলায় তিনি জামিন নেন। জামিন নেয়ার পর দুদক জামিন বাতিলের জন্য আপীল করে। এরপর কেন জামিন বাতিল করা হবে না মর্মে রুল জারি করে। এ অবস্থায় হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের আরেকটি অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চলতি মাসের ২৮ তারিখে তাঁকে দুদক আবার তলব করে। কিন্তু তিনি দুদকের ডাকে সাড়া দেননি।
আরও ফৌজদারি মামলা ॥ দুদক, টেলিযোগাযোগ মামলা ছাড়াও তৌফিকের বিরুদ্ধে ঢাকার বিভিন্ন থানায় আরও সাতটি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে রমনা থানায় পাঁচটি ও গুলশান থানায় দুটি মামলা দায়ের হয় তাঁর বিরুদ্ধে। এসব মামলার মধ্যে খুন, অস্ত্র, প্রতারণা ও মারধরের অভিযোগ ছিল বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ তৌফিক বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে আটটি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে ছয়টি মামলা খারিজ হয়ে গেছে। আর দুটি মামলা সরকারের তরফ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। যদিও বর্তমান সরকারের সুপারিশে পূর্বের কোন মামলা এখনও প্রত্যাহার করা হয়নি।
বরখাস্তের কাহিনী ॥ পেশাগত দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন অনিয়মের কারণে চার বার চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হন মোহাম্মদ তৌফিক। কিন্তু প্রতিবারই প্রভাবশালী মহলের তদবিরের কারণে চাকরি ফিরে পান তিনি। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়ে বিদেশে যাওয়ার কারণে প্রথম সাময়িক বরখাস্ত হন ১৯৯৮ সালের ৯ জুলাই। দ্বিতীয়বার ১৯৯৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানে আর্থিক অনিয়মের জন্য তিনি সাময়িক বরখাস্ত হন। ২০০২ সালের ১৫ আগস্ট মগবাজার টিএ্যান্ডটি কলোনিতে হত্যাকা-ের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগেও আরও এক দফা বরখাস্ত হন তিনি। সর্বশেষ ২০০৭ সালের ৪ ডিসেম্বর দুর্নীতির দায়ে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তবে রহস্যজনক কারণে তিনি আবারও দ্রুত চাকরিতে যোগ দিতে পারেন। তবে সর্বশেষ দুদক গত বছরের নবেম্বরে মামলা করার পর উল্লেখযোগ্য কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তাঁর বিরুদ্ধে।
তৌফিকের সম্পদ ॥ দুদকের তদন্তে মোহাম্মদ তৌফিকের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল সম্পদের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তাঁর দেয়া হিসাবের বাইরেও স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ও নিজের নামে ট্রাস্ট ব্যাংকের সেনাকল্যাণ ভবন শাখা ও ৩৬, দিলকুশা শাখায় দুই কোটি ৮১ লাখ ৪৫ হাজার টাকার এফডিআর রয়েছে। এ ছাড়া স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের গুলশান শাখায় তৌফিক ও তাঁর স্ত্রীর নামে রাখা সঞ্চয়পত্র, লকার ও ক্রেডিট কার্ড জব্দ করা হয়। ৯৮, বড় মগবাজারে দুটি ফ্ল্যাটের (নম্বর ১৩০১ ও ১৩০২) সন্ধান পায় দুদক। এইচএসবিসির গুলশান শাখায়ও তাঁর নামে হিসাবের অস্তিত্ব মেলে।
সরকারী চাকরি বিধিমালা ॥ বাংলাদেশ সার্ভিস রুলসের পার্ট ১-এর বিধি ৭৩ অনুযায়ী কোন সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দাখিল হলে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া ১৯৭৮ সালের ২১ নবেম্বর প্রণীত সংস্থাপন বিভাগের অফিস মেমোরেন্ডাম {নং ইডি (রেগ-৬) ১২৩/৭৮-১১৫ (৫০০)} অনুযায়ী কোন কর্মচারী গ্রেফতারের বা আত্মসমর্পণের পর জামিনে মুক্তি পেলেও মামলার সুরাহা না হওয়া পর্যস্ত সাময়িকভাবে বরখাস্ত অবস্থাতেই থাকবেন। এ ক্ষেত্রে কোন ধরনের জটিলতা না হওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে ‘সাময়িক বরখাস্তর আনুষ্ঠানিক আদেশও জারি করতে বলা হয়েছে। কিন্তু তৌফিকের ক্ষেত্রে কোন বিধিই বাধা হয়নি। বরং বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগের পর পরই তাঁর একেক ধাপ পদোন্নতি হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানোর পরও ফল শূন্য রয়ে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.