বহিঃসমর্পণ চুক্তি-সব অপরাধী আনা যাবে না

ভারতের সঙ্গে বহুল আলোচিত বহিঃসমর্পণ চুক্তি হওয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির অপরাধী হস্তান্তর-প্রক্রিয়া সহজ হবে। তবে এর আওতায় সব অপরাধী আসবে না। তাই বাংলাদেশ বা ভারত পরস্পরের কাছে নিজ দেশের অপরাধীকে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানালেই তা রক্ষা করার সুযোগ থাকছে না।
চুক্তিতে রাজনৈতিক বিবেচনার জন্য যোগ্যদের বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। এ ছাড়া রাজনৈতিক চরিত্রের অপরাধের কোনো সংজ্ঞা না থাকায় ভবিষ্যতে জটিলতাও দেখা দিতে পারে।
গত সোমবার ঢাকায় বাংলাদেশের পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও ভারতের পক্ষে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্ধে বহিঃসমর্পণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। বেশ কয়েক বছর ধরেই চুক্তিটির খসড়া নিয়ে আলোচনা চলছিল। এ চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে দৃশ্যত বাংলাদেশ খুব একটা আগ্রহী না হলেও বিশেষ গতি পায় গত ডিসেম্বরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ভারত সফরে। ওই সফরে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্ধের সঙ্গে বৈঠকের পরই সাংবাদিকদের জানানো হয়, জানুয়ারিতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরেই বহিঃসমর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, গত সোমবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিটিকে বিভিন্ন মহল থেকে বন্দি বিনিময় চুক্তি বলা হলেও এটি আসলে বহিঃসমর্পণ চুক্তি। এ চুক্তি বাস্তবায়নের আগে দুই দেশকে তা অনুমোদন করতে হবে। চুক্তিটি অনুস্বাক্ষরের পর কিভাবে বাস্তবায়িত হবে তা নিয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হবে দুই পক্ষকে। বন্দি বিনিময় চুক্তি ও বহিঃসমর্পণ চুক্তির মধ্যে পার্থক্য কী জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বন্দি বিনিময় চুক্তি হলে দুই দেশের মধ্যে বিনিময় বোঝাত। কিন্তু বহিঃসমর্পণ চুক্তির ধরন ভিন্ন। এখানে একজনকে হস্তান্তরের বিনিময়ে আরেকজনকে পাওয়ার বিষয় নেই। দুই দেশ তাদের নাগরিকদের নিজ দেশের কাছে হস্তান্তরের অনুরোধ জানাতে পারবে এই চুক্তির আওতায়।
বাংলাদেশের কারাগারে আটক ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা অনুপ চেটিয়া বা ভারত থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম দুই খুনি ক্যাপ্টেন (অব.) মাজেদ ও রিসালদার (অব.) মোসলেম উদ্দিনকে ফেরত পাঠানো বা ফেরত আনা যাবে কি না জানতে চাইলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেছেন। ওই আবেদন বিবেচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো চুক্তির আওতায়ই তাঁকে হস্তান্তরের সুযোগ নেই।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর দুই খুনি ভারতে আছেন কি না তা নিশ্চিত নয়। কোনো এক সময় তাঁরা ভারতে ছিলেন, এমন তথ্যের আলোকে বাংলাদেশ তাঁদের হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে আসছে। দিল্লি এ ব্যাপারে আরো সুস্পষ্ট তথ্য পেলে ঢাকাকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সাজাপ্রাপ্ত আসামি বিনিময় চুক্তি রয়েছে। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরে ওই চুক্তি সই হলেও গত তিন বছরে একজন বন্দিও বিনিময় সম্ভব হয়নি। দুই দেশ ওই চুক্তি বাস্তবায়নে বিধি প্রণয়নের কাজ করছে।
সূত্র আরো জানায়, ভারতের সঙ্গে বহিঃসমর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে অপরাধী হস্তান্তরে আইনি কাঠামো তৈরি হলো। আইন না থাকলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে অপরাধী হস্তান্তরে বাংলাদেশের সহযোগিতার কথা বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছে। ভারত এ জন্য বাংলাদেশের প্রশংসাও করেছে। তবে সার্কের (দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা) পারস্পরিক আইনি সহায়তাবিষয়ক সনদের আওতায়ও অপরাধী হস্তান্তরের সুযোগ ছিল।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন সময় অনানুষ্ঠানিকভাবে অপরাধী হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটি হয়েছে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বর্তমান সুসম্পর্কের কারণে। উভয় দেশ নিজের ভূখণ্ড অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার না হতে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে।
ঢাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, স্বাক্ষরিত বহিঃসমর্পণ চুক্তিতে অপরাধী প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান না করারও সুযোগ রয়েছে। অপরাধীর গুরুত্ব হিসেবে প্রতিটি অনুরোধ আলাদাভাবে বিবেচনা করা হবে।
চুক্তির ৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আইনানুগ কর্তৃপক্ষের অনুরোধে এক দেশ অন্য দেশের কাছে দণ্ডপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন ব্যক্তিকে সাজা কমপক্ষে এক বছর হলে বহিঃসমর্পণ করতে পারবে। তবে চুক্তিতে বর্ণিত বিধানাবলি সাপেক্ষে কোনো বহিঃসমর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করারও সুযোগ থাকবে। কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত বা অভিযুক্তকে স্বল্প সময়ের জন্য সাময়িকভাবেও বহিঃসমর্পণ করা যাবে। একই ব্যক্তির বিষয়ে একাধিক দেশের বহিঃসমর্পণের অনুরোধ থাকলে সে ক্ষেত্রে কিছু শর্ত সাপেক্ষে অনুরোধ পাওয়া দেশ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে।
চুক্তির অনুচ্ছেদ-২-এ বলা হয়েছে, আর্থিক সংশ্লিষ্ট কোনো কেলেঙ্কারিতে জড়িত ব্যক্তি এ চুক্তির আওতায় পড়বে না। দুই দেশের একটি যৌথ কমিটি এ চুক্তির আওতায় আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে। প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করার শর্তে বলা হয়েছে, প্রত্যর্পণ চাওয়া ব্যক্তি বা অভিযুক্ত অপরাধী যদি আটককারী দেশকে বোঝাতে সক্ষম হন যে নিজ দেশে ফেরত পাঠালে অন্যায় ও অন্যায্য আচরণ বা জীবনহানির আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে তাঁকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারবে।
এ ছাড়া ফৌজদারি দণ্ডবিধির আওতায় নয়, কিন্তু সামরিক আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করা যাবে।
চুক্তির অনুচ্ছেদ-৬-এ ১৩ ধরনের ব্যক্তি রাজনৈতিক চরিত্রের অপরাধী গণ্য হবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলো উভয় দেশে ফৌজদারি দণ্ডবিধির আওতায় কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে, খুনি, গণহত্যা বা নরহত্যায় অভিযুক্ত ব্যক্তি, কোনো অস্ত্র দ্বারা আঘাত পাওয়া বা সংক্রামিত ব্যক্তি, কোনো বিস্ফোরক মামলার আসামি, অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরকসহ আটক কোনো ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা আটকের সময় অস্ত্র দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শনকারী ব্যক্তি, সরকারি সম্পদ বিনষ্টকারী ব্যক্তি, অপহরণকারী বা মুক্তিপণ চাওয়া ব্যক্তি অথবা জিম্মির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, কোনো হত্যা মামলার হুকুমের আসামি বা পরিকল্পনাকারী ব্যক্তি, যেকোনো দেশের সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি এবং কোনো ধরনের অপরাধ বা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি।
চুক্তির ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ে বলা হয়েছিল, কোন কোন অপরাধ রাজনৈতিক চরিত্রের অপরাধ বলে গণ্য হবে না তা বলা হলেও রাজনৈতিক চরিত্রের অপরাধের কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। এতে ভবিষ্যতে জটিলতা দেখা দিতে পারে। কাজেই রাজনৈতিক চরিত্রের অপরাধের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া উচিত। তবে উভয় দেশ রাজনৈতিক অপরাধের ব্যাপারে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনার পরও অপরাধের প্রকৃতি সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করতে পারেনি। এটি অনুরোধ পাওয়া দেশের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।
বিচ্ছিন্নতাবাদী মোকাবিলায় সহযোগিতার প্রসঙ্গ যৌথ বিবৃতিতে : ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী মোকাবিলায় বাংলাদেশের সহযোগিতার বিষয়টি গত সোমবার দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে স্থান পেয়েছে। বিষয়টিকে স্পর্শকাতর হিসেবে আখ্যায়িত করেছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অতীতে বিভিন্ন সময় ভারতের আদালতে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জানিয়েছে যে তারা বাংলাদেশে আটক হয়েছে। এরপর তাদের ভারতের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে। দুই দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়গুলো স্বীকার করেনি। তবে সুসম্পর্কের সুবাদে দুই দেশের মধ্যে এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক সহযোগিতা থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু যৌথ বিবৃতিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী মোকাবিলায় সহযোগিতাসহ ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রশমনে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও তা স্পর্শকাতর বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ভিসা ব্যবস্থা সহজ হয়েছে, তবে সংখ্যার ব্যাপারে অস্পষ্টতা কাটেনি : গত সোমবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সংশোধিত ভ্রমণ চুক্তি (আরটিএ) স্বাক্ষরের ফলে ভিসা ব্যবস্থা দৃশ্যত অনেক সহজ হয়েছে। দুই দেশ 'নোটিফিকেশন' জারির মাধ্যমে এ চুক্তি বাস্তবায়ন করবে। এর অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হলো পর্যটক ভিসার আওতায় দুই বার ভ্রমণের মধ্যে দুই মাসের ব্যবধান থাকার বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া। ফলে পর্যটক ভিসায় ভারত ভ্রমণকারী দুই মাসের মধ্যে আবারও যেতে পারবেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, ভিসা ব্যবস্থা সহজ হলে দুই দেশের মানুষে মানুষে যোগাযোগ আরো বাড়বে। তবে বাংলাদেশে ভারতের ভিসার ক্ষেত্রে সমস্যা বোঝাতে চাহিদা ও জোগানের ব্যবধানকেই উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়।
বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশন প্রতিদিন তিন হাজারেরও বেশি ভিসা ইস্যু করলেও প্রত্যাশীর সংখ্যা অনেক বেশি। সংশোধিত আরটিএতে অনেক ক্যাটাগরিতেই আগের চেয়ে বেশি মেয়াদে ভিসা দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এতে বারবার ভিসার জন্য আবেদনকারীদের চাপ কিছুটা কমতে পারে। তবে চাহিদা বিবেচনায় রেখে ভিসার সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে কি না তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শহরে ভারতের ভিসা আবেদনকেন্দ্র খোলার সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

No comments

Powered by Blogger.