ফটকাবাজি রোধে আর্থিক লেনদেনের ওপর কর by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

'এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে'- কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাথ বধ কাব্যের পঙ্ক্তিটি মনে পড়ল। প্রচারমাধ্যমে জানা গেছে, ইউরোপের ১১টি দেশ আর্থিক লেনদেনের ওপর কর আরোপের বিষয়ে সম্মত হয়েছে। এর ফলে প্রথমবারের মতো আঞ্চলিকভাবে আর্থিক লেনদেন কর প্রবর্তন করতে যাচ্ছে তারা।
যদিও ইউরোপ ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশ বা ইউরো জোনের ২৭টি দেশের ভেতর ১৭টি একমত হতে পারেনি। কিন্তু ফ্রান্স, জার্মানিসহ ১১টি দেশ ঐকমত্যে পৌঁছেছে। বাকি দেশগুলো হলো অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, এস্তোনিয়া, গ্রিস, ইতালি, পর্তুগাল, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া ও স্পেন। এর ফলে এসব দেশে শেয়ারসহ আর্থিক বাজার লেনদেনের ক্ষেত্র ন্যূনতম ০.১০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। তবে ডেরিভিটিভসের জন্য এই হার হবে ০.০১ শতাংশ। কৃত্রিমভাবে বিভিন্ন পণ্য যথা- শেয়ার, বন্ডের দাম বাড়িয়ে নিরীহ বিনিয়োগকারীদের গলা কাটা হয়। আর্থিক বাজারের পরিধি এখন এতটাই বেড়েছে যে খাদ্যপণ্যের বাজারেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বজুড়ে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে খাদ্যের বিপুল মূল্যবৃদ্ধির পেছনে এই ফটকাবাজি ভূমিকা রেখেছে। এই প্রসঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। হয়তো অনেক কথা আগে বলা হয়ে থাকতে পারে।
তবে গুরুত্বপূর্ণ কথা বারবারই বলতে হয়। আল্লাহ তায়ালার পছন্দ তাই। পবিত্র কিতাবে গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনি বারবার স্মরণ করে দিয়েছেন। শেয়ারবাজার ফটকাবাজি এবং এর ফলে উদ্ভূত বিপর্যয় নতুন নয়। শেয়ারবাজারের জন্মলগ্ন থেকে বললেও অত্যুক্তি হবে না। ১৭২০ সালে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে সাউথ সি কম্পানির শেয়ার নিয়ে বিরাট কেলেঙ্কারি হয়েছিল। ১৭২০ সালের মার্চ মাসে সে শেয়ারের দাম ছিল ১২৮ পাউন্ড। একই বছরের জুন মাসে তা গিয়ে দাঁড়াল ১০৫০ পাউন্ডে। তারপর ধস নামল। যৌথ সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে জেলে যেতে হয়েছিল। কেন না তিনিও এতে জড়িত ছিলেন। এরপর থেকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে শেয়ারবাজারে বিপর্যয় এসেছে। এর মূল কারণ কিছু অসৎ ব্রোকার, ব্যবসায়ী কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশেও তো দুবার এ রকম ঘটল।
যাহোক ইউরোপের করারোপের বিষয়টি এটাই প্রমাণ করল যে ফটকাবাজি স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অতএব ফটকাবাজি বললে অসম্মান বোধ করার কোনো কারণ নেই। উল্লেখ্য, ইউরোপের কতিপয় দেশ যে আর্থিক লেনদেনে কর আরোপ করতে চলেছে, আজ থেকে ৪০ বছর আগে অর্থনীতিবিদ জেমস টোবিন এই প্রস্তাব রেখেছিলেন। সে কারণে এটি 'টোবিন ট্যাঙ্' নামে পরিচিতি পায়। অনেকে একে রবিনহুড কর বলেও আখ্যায়িত করেন। ইংল্যান্ডে ১২ শতকে রবিনহুডকে নিয়ে এই কিংবদন্তির কাহিনী চালু হয়। ধনীর সম্পদ কেড়ে নিয়ে দরিদ্রের মধ্যে বিতরণ করতেন তিনি। উঠতি যৌবনকালে একটি সুন্দর ছবি দেখেছিলাম। তখন নিজেকে রবিনহুড মনে করতে খুব ভালো লাগত। তবে বর্তমান ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ায় তাতে অনেক দেশে সরকারকে রবিনহুড হতে হচ্ছে। ফ্রান্সের নতুন প্রেসিডেন্ট তো ঘোষণা দিয়েছেন যে ধনী সম্প্রদায়ের ওপর সর্বোচ্চ হারে কর আরোপ করা হবে।
ভারতের শিল্পপতি মুকেশ আমবানির আবাস পৃথিবীর বৃহত্তম ব্যক্তিগত আবাস। আয়তন চার লাখ বর্গফুট, যা ১৩০০ বস্তিবাসীর গৃহের চেয়ে বড়। ভারতে প্রতিবছর হাজারের ওপর কৃষক ঋণের চাপে জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যার মতো করুণ পথ বেছে নেয়। এ অবস্থায় বিশ্বের অর্থনীতিবিদরা এই চিন্তায় মেতেছেন যে পুঁজির অবাধগতি এবং বাধা-বন্ধনহীন বাজার অর্থনীতি বর্তমানে যে অবস্থায় চলছে তাতে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়া কঠিন এবং বৈষম্য বাড়বে বা বাড়ছে বৈ কমবে না। পুঁজিবাদ ও অসাম্যতে নতুন পথের সন্ধান দিতে হবে, যাকে বলা হচ্ছে True Progressivism. এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে আরো আলোচনা করা যাবে।
ইতিমধ্যে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন পাঁচটি ধারণা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। সে সব বাস্তবায়িত হলে বিশ্বের বঞ্চিত মানুষের জীবন সুন্দর হবে। এর অন্যতম প্রধান বিষয় হলো মোবাইল ফোনের ব্যাপক ব্যবহার। বাংলাদেশ বোধহয় প্রথম শর্তটি পূরণ করতে যাচ্ছে।
আমি যে বক্তব্যটি বারবার ঘুরেফিরে উপস্থাপন করছি, উপরোল্লিখিত কর আরোপের বিষয়টি আমাকে আরো প্রত্যয়ী করে তুলেছে আমার বক্তব্যে অটল থাকবার। পুঁজিবাজারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর। একটি প্রাইমারি, অন্যটি সেকেন্ডারি। দেশের জনগণের বিন্দু বিন্দু সঞ্চয়কে সিন্ধুতে পরিণত করে যদি রাষ্ট্রের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চাইতে হয়, তাহলে প্রাইমারি মার্কেটে যেতে হবে। সেকেন্ডারি মার্কেট, যাকে স্টক এক্সচেঞ্জ বলা হয়, সেখানে ক্রেতা-বিক্রেতারা শেয়ার কেনাবেচা করবেন। আমাদের অর্থমন্ত্রী উদ্যোক্তাদের পরামর্শ দিয়েছেন পুঁজিবাজার থেকে ব্যবসায় মূলধন সংগ্রহ করতে। অত্যন্ত সুন্দর পরামর্শ। এখন সমস্যা হলো যে তিনি কথাটা কী বলেছেন?
কেননা একটি অত্যন্ত বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকের শিরোনাম হলো- অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করতে বলেছেন। যদি তা বলে থাকেন, তাহলে এটি অত্যন্ত ভুল বক্তব্য। শেয়ারবাজারে শেয়ার পাওয়া যায়, পুঁজি নয়। দুটির পার্থক্য বুঝতে হবে। এই বিভ্রান্তি বা ভুল বার্তার ফসল হলো ২০১০ সালের শেয়ার মার্কেট বিপর্যয়, যা নিয়ে ইতিমধ্যে বহু আলোচনা হয়েছে।
শেয়ারবাজারে মাঝেমধ্যে বর্গি হানা দেবে। পৃথিবীর সব দেশে এমনটি হয়, তাদের রুখতে হবে। পৃথিবীর প্রথম পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা চালু হয় যুক্তরাষ্ট্রে, যার নাম সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। ১৯৩৪ সালে চালু হয় ১৯২৯ সালের মার্কিন শেয়ার মার্কেটে great crash বা মহাধসের ফলে। এখন অবশ্য পৃথিবীর প্রায় সব দেশে শিরোনামের পার্থক্য সাপেক্ষে এই প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এসইসির মূল দায়িত্ব ধনীদের হাত থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের রক্ষা করা। আর যারা শেয়ার বিক্রি করবেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। আর কিছু পালনীয় বিধি রয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট স্টক এক্সচেঞ্জেরও থাকে।
জনগণের সঞ্চয়কে কাজে লাগানো যদি মূল উদ্দেশ্য হয়, তাহলে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি এত প্রবলভাবে আসবে কেন? যাঁরা শেয়ার ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করবেন, তাঁদের সেটা মাথাব্যথা। প্রখ্যাত মার্কিন অর্থনীতিবিদ ও কূটনীতিক গলব্রেইম The great Crash 1929 শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে তিনি বিনিয়োগকারীদের অতিমাত্রায় Speculation-কে এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং একটি কঠিন মন্তব্য করেছেন।
তিনি শুরুতে বলেছেন, কেউ এই স্পেকুলেশনকে উদ্ধৃত করেনি। পরে কিন্তু বলছেন যে কিছু ওয়াল স্ট্রিটের সদস্য অর্থাৎ শেয়ার ব্রোকাররা একে প্রেরণা দিয়েছেন। একই বইয়ের আরেক জায়গায় তিনি বলেছেন, জনগণ সহজে অর্থ পেলে বেশি মাত্রায় speculation করবেন। স্পেকুলেশন বা অনুমান যদি অতিমাত্রায় কেউ করা শুরু করেন, তাহলে বিচার-বিশ্লেষণে বাস্তবিক দিকটা হারিয়ে ফেলবেন। কেউ যদি বিনিয়োগ নিয়ে চিন্তা করেন, তাহলে তিনি দেখবেন যে কোথায় বিনিয়োগ করছেন, কতটা লাভ হবে এবং প্রতিষ্ঠানের অবস্থাটা বা কি? তা না করে তিনি অতিমাত্রায় স্পেকুলেশন করেন, তাহলে তাকে লোভে পেয়ে যাবে। এই বইতে লেখক বলেছেন যে বিনিয়োগকারীদের অন্তহীন লোভ বা unending greed-এ পেয়ে বসেছিল। আমাদের এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। চটজলদি সমাধান হিসেবে নির্বোধের মতো শেয়ারবাজারের কথিত তারল্য সংকট দূরীভূত করার মতো কথা বলা মানে আড়ালে থাকা লুটেরাদের আরো লুট করতে সহায়তা করা।
পরিশেষে আর একটি বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই। আগেও বলেছি, তা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ স্যারও এ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তা হলো আইপিওতে শেয়ার ছাড়ার সময় প্রিমিয়াম অনুমোদন, যা এসইসির দায়িত্ব। এখনো বল্গাহীনভাবে প্রিমিয়ামের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। প্রিমিয়ামের পক্ষে যুক্তি হলো ভালো কম্পানি, ভালো জিনিস কিনতে হলে বেশি দাম দিতে হবে। এটা তো কেতাবি কথা। এখন আমাদের বক্তব্য হলো, এটি আসমানি বক্তব্য নয় যে এখান থেকে সরে আসা যাবে না। যাঁরা শেয়ার কিনছেন তাঁরা কম্পানির অংশীদার হিসেবে আসছেন, তাঁদের কেন প্রিমিয়ামের নামে জরিমানা দিতে হবে? প্রিমিয়াম তুলে প্রিমিয়াম মানি হিসেবে বছরের পর বছর অ্যাকাউন্টে রেখে দেওয়া হবে। আর যিনি শেয়ার কিনলেন, তিনি লভ্যাংশ পাবেন মূল টাকার ওপর। কম্পানির যতটুকু মূলধন তোলার প্রয়োজন, সেটাই আইপিওর মাধ্যমে উঠিয়ে নিয়ে কাজে সীমাবদ্ধ থাকলে অসুবিধা কোথায়? আগেই বলেছি, বিশ্বব্যাপী এটা এখন স্বীকৃত, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে যে আতঙ্ক চলছে, তা প্রত্যাশা মেটাতে পারছে না। এটি নানা রকম মতবাদের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে, যেমন করপোরেট সামাজিক দায়িত্ব এবং True progressivism এসইসিকেও স্থবির এবং গতানুগতিক ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সাবেক কেতাবি বিদ্যার মধ্যে আবদ্ধ থাকলে চলবে না। সে সঙ্গে আবারও বলছি, দুষ্টের দমন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেছেন, শেয়ারবাজারের শৃঙ্খলার জন্য এসইসিকে ঢেলে সাজানো হয়েছে, কিন্তু এসইসি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে বা ইমেজ সংকট কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.