সাঈদীর মামলার রায় যে কোন দিন- যুদ্ধাপরাধী বিচার

 একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়েছে।
মামলাটির রায় ঘোষণার জন্য আবারও অপেক্ষাধীন (সিএভি) রাখা হয়েছে। যে কোন দিন রায় ঘোষণা করা হবে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মঙ্গলবার এই আদেশ প্রদান করেছে। ট্রাইব্যুনালে অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক।
প্রসিকিউশন পক্ষের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী দ্বিতীয় দফায় মঙ্গলবার আসামি পক্ষের যুক্তি খ-ন করেছেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, আমরা সাক্ষী ও দাখিলকৃত দলিলপত্রাদি দিয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। সে জন্য আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়া উচিত। আমি মনে করি আসামির অপরাধের গুরত্ব এতই বেশি, যাতে তাঁর মৃত্যুদ- হওয়া উচিত। উল্লেখ্য, এর আগে ৬ ডিসেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলার রায় ঘোষণার জন্য সিএভি রাখা হয়েছিল। ১৩ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করায় সাঈদীর মামলায় নতুন করে পুনরায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়।
এদিকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী তাঁর বিরুদ্ধে আনা প্রতিটি অভিযোগই মিথ্যা বলে দাবি করে বলেছেন, আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, হে আল্লাহ আমার বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা, তাঁর সহযোগী প্রসিকিউশন এবং মিথ্যা স্বাক্ষ্যদাতাদের হেদায়েত কর আর হেদায়েত তাঁদের নসিবে না থাকলে তাদের সকলকে শারীরিক, মানসিক ও পারিবারিকভাবে সে রকম অশান্তির আগুনে দগ্ধিভূত কর যেমনটি আমাকে, আমার পরিবারকে এবং বিশব্যাপী আমার অগণিত ভক্তবৃন্দকে মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে। আর জাহান্নাম কর তাদের চিরস্থায়ী ঠিকানা।
সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর বক্তব্য দিতে উঠে প্রসিকিউশন পক্ষকে এ অভিশাপ দেন তিনি। এ সময় ট্রাইব্যুনালের বিনা অনুমতিতে সাঈদীর লিখিত বক্তব্য পাঠ করা নিয়ে প্রসিকিউশন আপত্তি জানালে চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে আসামিপক্ষ। সাঈদীর ৩ ছেলে ও তাঁর আইনজীবী প্রসিকিউশন পক্ষের প্রসিকিউটরের দিকে তেড়ে যান। তবে উভয়পক্ষের সিনিয়র আইনজীবীদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হলে সাঈদী তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।
আদেশের পর প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনালের নিয়ম অনুযায়ী, আদালত এখন সুবিধামতো সময়ে যে কোন দিন এ মামলার রায় ঘোষণা করতে পারে। তবে সবার সুবিধার জন্য রায়ের দুয়েকদিন আগে তারিখ জানিয়ে দেয়া হবে। সাঈদীর মামলায় এর আগেও একবার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন হলেও ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের কারণে আদালত যুক্তিতর্কের অংশটি আবার শোনে।
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে ২১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার মামলাও শুনানি শেষে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। যে কোন দিন কাদের মোল্লার রায় ঘোষণা করা হবে।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩ হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ভাংচুর ও ধর্মান্তরে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ২০টি ঘটনায় গতবছর ৩ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে সাঈদীর বিচার শুরু হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতারকৃত জামায়াত নেতাদের মধ্যে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধেই সবার আগে অভিযোগ গঠন হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় গত বছরের ৭ ডিসেম্বর। তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনসহ মোট ২৮ জন রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন। এ ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া ১৫ সাক্ষীর জবানবন্দী ট্রাইব্যুনাল সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে। আসামি পক্ষে ১৭ জনের সাফাই সাক্ষ্য শেষ হয় গত ২৩ অক্টোবর।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরে হত্যা, লুণ্ঠন, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের করা একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয় সাবেক সংসদ সদস্য সাঈদীকে। পরের বছর ১৪ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। সাঈদী ছাড়াও জামায়াতের সাবেক ও বর্তমান আমিরসহ সাত শীর্ষ নেতা এবং বিএনপির দুই নেতার বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
সৈয়দ হায়দার আলী ॥ প্রসিকিউশন পক্ষের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী মঙ্গলবার আসামি পক্ষের যুক্তি খ-ন করে ও আইনী পয়েন্টে পাল্টা যুক্তি এবং সমাপনী বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এর আগে সোমবার আসামি পক্ষে আইনী পয়েন্টে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন সাঈদীর প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। ১৩ থেকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এবং ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫ কার্যদিবসে প্রসিকিউশন পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী। অন্যদিকে ২০ থেকে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ কার্যদিবসে আসামি পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও এ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম।
আবেদন খারিজ ॥ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের পর আসামি পক্ষ সাঈদীসহ কয়েকজন আসামির পক্ষে পুনর্বিচারের আবেদন করেন। ৩ জানুয়ারি শুনানি শেষে সাঈদীর মামলা পুনর্বিচারে আসামি পক্ষের আবেদন খারিজ করে দেয় ট্রাইব্যুনাল। তবে ইতিপূর্বে শেষ হওয়া রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক ফের শুনবেন বলে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ১৩ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরুর মধ্য দিয়ে সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলাটির বিচারিক প্রক্রিয়া দ্বিতীয়বারের মতো শেষ পর্যায়ে পৌঁছে।
সাঈদীর আইনজীবী ॥ প্রসিকিউশন পক্ষের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী আসামি পক্ষের যুক্তি খ-ন করে ও আইনী পয়েন্টে পাল্টা যুক্তি এবং সমাপনী বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এর আগে সোমবার আসামি পক্ষে আইনী পয়েন্টে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেছিলেন সাঈদীর প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।
তারপরও ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান তাঁর আদেশ দানের আগে সাঈদীর অপর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম রাষ্ট্রপক্ষের সমাপনী যুক্তিতর্কের জবাবে আরও কিছু বলার অনুমতি চান। এ সময় ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান আসামি পক্ষের বক্তব্য দেয়া আগেই শেষ হয়েছে বলে মনে করিয়ে দেন তাঁকে। চেয়ারম্যান এরপরও কোন বক্তব্য থাকলে তা লিখিত আকারে জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন আইনজীবী মিজানুল ইসলামকে।
সাঈদী দাঁড়িয়ে যান ॥ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান আদেশ দানের জন্য প্রস্ততি নিতে থাকলে হঠাৎ আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যান সাঈদী। তিনি ট্রাইব্যুনালের অনুমতি ছাড়াই লিখিত বক্তব্য পাঠ করতে শুরু করে দেন। টানা ৭ মিনিট তাঁর বক্তব্য দেয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ শীমন এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আপত্তি জানান।
বাকবিত-া ॥ এর পরই দুই পক্ষের মধ্যে বাকবিত- শুরু হয়। সাঈদীর ৩ ছেলে এ সময় প্রসিকিউটর এ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদ শীমনের দিকে তেড়ে যান। তাঁরা প্রসিকিউটরদের প্রতি মারমুখী আচরণও করেন। সাঈদীর আইনজীবী তাজুল ইসলামও এ সময় ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন। এ সময় ট্রাইব্যুনালে চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী ও আসামি পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এরপর ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সাঈদীকে তাঁর লিখিত বক্তব্য শেষ করার অনুমতি দেয়ার আবেদন জানালে ট্রাইব্যুনাল অনুমতি দেন। পরে সাঈদী আরও এক মিনিটে তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।
ট্রাইব্যুনালের ক্ষোভ ॥ এ সময় ট্রাইব্যুনাল উভয় পক্ষের আইনজীবীদের এমন আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এর আগের বার এ মামলা সুন্দরভাবে শেষ হয়েছিল। এবারও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন সুন্দরভাবে শেষ হয়েছে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত ভাল থেকে শেষ সময় এসে আপনাদের কাছ থেকে এমন আচরণ কাম্য নয়।
সাঈদীর বক্তব্য ॥ জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মোট ৮ মিনিটের লিখিত বক্তব্যের এক পর্যায়ে সাঈদী অভিযোগ করে বলেন, প্রসিকিউশনের দাবি, আমি নাকি মহান স্বাধীনতা অর্জনের পর পালিয়ে ছিলাম। মিথ্যাচারের তো একটা সীমা থাকে। তদন্ত কর্মকর্তা যাই রিপোর্ট করেছেন, প্রসিকিউশন সেটাকেই বেদ বাক্য মনে করে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ঈমান বিসর্জন দিয়ে সমস্ত মেধা-প্রজ্ঞা খাটিয়ে মিথ্যাকে সত্য বানানোর জন্য প্রাণান্ত হয়েছেন, আফসোস।
লিখিত বক্তব্যে সাঈদী আরও দাবি করেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং শতাব্দীর জঘণ্য ও নিকৃষ্টতম মিথ্যাচার। আল্লাহর কসম, আমার বিরুদ্ধে রচনা করা চার হাজার পৃষ্ঠার প্রতিটি পাতার প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দ, প্রত্যেকটি বর্ণ মিথ্যা, মিথ্যা এবং মিথ্যা। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে কোন এক দেলাওয়ার শিকদারের করা অপরাধ আমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউশন আমার বিরুদ্ধে মিথ্যার পাহাড় রচনা করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.