সন্ত্রাসীর মন by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

মানুষের ইতিহাসে সন্ত্রাসীর আবির্ভাব প্রায় তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে ইহুদি কদুৎসাহী শিকারির দেখা পাওয়া যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলমান আসাসিন সম্প্রদায় এবং সপ্তম থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ভারত উপমহাদেশে ঠগীদের কথা বিশেষভাবে আলোচিত হয়ে আসছে।
সমসাময়িককালে সন্ত্রাসীরা ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর সর্বত্র। গত এক দশকে নিউ ইয়র্ক, মাদ্রিদ ও লন্ডন শহরে সন্ত্রাসীরা যেসব বিস্ফোরণ ঘটায়, সারা দুনিয়ায় সেগুলোর প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। সন্ত্রাসীদের মতাদর্শ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু অস্ত্রের ব্যবহারে তাদের কোনো পার্থক্য নেই।
গত দেড় শ বছরে সন্ত্রাসীদের প্রবাহ একেক যুগে একেক রূপ পরিগ্রহ করেছে। ১৮৭৯ সালে যে নৈরাজ্যবাদী কার্যকলাপ শুরু হয়, তা ১৯২০-এর দশকে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে, ১৯৬০-এর দশকে নব্যবাম ও ১৯৭৯ সালে তা ধর্মীয় রূপ নেয়।
নৈরাজ্যবাদীরা গুপ্তহত্যার মাধ্যমে সমাজে নৈরাজ্যবাদী মতামত প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে ঔপনিবেশিক শক্তিকে দুর্বল করার জন্য উপনিবেশের পুলিশ বাহিনীর ওপর হামলা করা হয়। নব্যবাম আন্দোলন বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করার জন্য ব্যারিকেড বা ঘেরাও নীতি অনুসরণ করে। এ সন্ত্রাসের রূপ হতে পারে বিচিত্র। ধর্মীয় সন্ত্রাসের আত্মঘাতী হামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনেও অনুসৃত হচ্ছে। ভিয়েতনামের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আত্মহত্যা, তালেবান জিহাদ ও তামিল টাইগারদের আত্মঘাতী হামলা আত্মহত্যাবিরোধী চিরাচরিত ধর্মীয় অনুশাসনের নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছে। হঠাৎ করে একজন অস্ত্রধারী স্কুলে ঢুকে বা উন্মুক্ত স্থানে দমাদম গুলি ছুড়ে শিশু বা বয়স্ক লোককে খুন করছে।
সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে এখন সন্ত্রাস বা সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা দেওয়া মুশকিল হয়ে উঠেছে। 'রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদ'-এর লেখকদ্বয় এপি স্মিথ ও এ জে ইয়ংহাম সন্ত্রাসবাদের ১০৯টি সংজ্ঞার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, সেই সংজ্ঞার সংখ্যা শেষ করা যায়নি।
সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যে নিন্দার্থ জড়িয়ে রয়েছে, তা সব সময় এক ছিল না। ভেরা জাসুলিখ একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে আহত করে তাঁর অস্ত্র মাটিতে ফেলে গর্বের সঙ্গে বলেন, 'আমি সন্ত্রাসবাদী, আমি খুনি নই।'
আজকাল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বলে কথা উঠেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর বোমাবর্ষণকেও এক ধরনের সন্ত্রাসীকর্ম বলে চিহ্নিত করা হতো। বাছবিচার করে এখন বলা হচ্ছে, সন্ত্রাসকর্ম হচ্ছে সামাজিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বেসামরিক লোকের বিরুদ্ধে অরাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগ। নানা সন্ত্রাসবাদকে খান করে বিবেচনা করা হলেও মূলে রয়েছে সন্ত্রাসীর মন।
মনের কোন অবস্থায়, কী উদ্দেশ্যে বা মতলবে একজন ব্যক্তি সন্ত্রাসী দলে যোগদান করে, কোন পন্থায় বা প্রণোদনায় লোককে দলে ভেড়ানো হয়, কোন বিশ্বাস বা ধর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বাস করে যে সন্ত্রাসকর্মটি মূলতই এক দলীয় দক্ষ ও সম্মানজনক পন্থা বা কায়দা। বেসামরিক লোককে খুন বা গুম করা প্রায় প্রতিটি সংস্কৃতি ও সমাজে নিষিদ্ধ অপকর্ম। এ অপকর্মকে সিদ্ধ করতে হলে তাকে নৈতিক এক সমাজধর্ম এবং সৃষ্টিকর্তার পক্ষের কাজ হিসেবে বিবেচিত হতে হবে। এবং যার বিরুদ্ধে এ অপকর্ম প্রয়োগ করা হচ্ছে সে এক অমানুষ শয়তান বটে, যে আইনের আশ্রয় বা সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। কোনো এক বৃহৎ আদর্শের জন্য সন্ত্রাসীকর্মের ওপর নৈতিকতা আরোপ করা হয় এবং যে জন্য সন্ত্রাসীর আত্মোৎসর্গ, তাকে শহীদ ও নায়কের মর্যাদা দান করা হয়।
সন্ত্রাসবাদকে ব্যক্তি, দল বা সংগঠনের পর্যায়ে মনস্তাত্তি্বক বিবেচনা করা যেতে পারে। ব্যক্তি পর্যায়ে সন্ত্রাসী ব্যবহারকে একটা চিত্তবিকার বা মনোবৈকল্য হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে। সন্ত্রাসীকর্মের রূপ কী ধরনের তা-ও বিবেচনার বিষয় হতে পারে। দলগত পর্যায়ে সামাজিক প্রভাব, মন্ত্রদান, দীক্ষা ইত্যাদি বাচনিক প্রভাব লক্ষ করা যেতে পারে। সাংগঠনিক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, আয়োজন-প্রস্তুতির অনুপুঙ্খ বিষয়, ব্যায়ানুপাতে সুবিধা সন্ত্রাসী পদক্ষেপের আগে বিবেচনা করে নিতে হবে।
ইসলামের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের সম্পর্ক যে অচ্ছেদ্য নয় তা পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মিসর, মরক্কো বা বাংলাদেশের জনমতের বিশ্লেষণে দেখা যাবে, বেশির ভাগ লোক সন্ত্রাসীকর্ম সমর্থন করে না। ইসলামী অতিশয়-পন্থার বিরুদ্ধে একাধিক মুসলমান অধ্যুষিত দেশে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে সমসাময়িক বিশ্বে জিহাদি সন্ত্রাস গভীরভাবে অনুসন্ধানযোগ্য এক বিষয় বটে।
সংগঠনের প্রধান ধর্তব্য হচ্ছে যে সংগঠনে যোগদানের জন্য একজন অংশগ্রহণকারীর কেমন প্রস্তুতি রয়েছে- সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য প্রণোদনা, আত্মোৎসর্গের জন্য প্রস্তুতি, সন্ত্রাসী মতবাদের সঙ্গে সামাজিকীকরণ বা অন্তরঙ্গতা, সংগঠনের কাঠামো, কর্মরীতি ও পুরস্কার সম্পর্কে কেমন সম্যক ধারণা রয়েছে।
মানুষ তার মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সংগঠনের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং সংগঠনের উদ্দেশ্য-অর্জনে স্বেচ্ছায় নিজেকে উৎসর্গ করে। গোপন সংগঠনের সঙ্গে যোগ সৃষ্টি হয় দলের সঙ্গে বন্ধু বা জানাশোনা লোকের সাহচর্যে। কাকে কোন পর্যায়ে কোন কাজের জন্য দায়িত্ব অর্পণ করা যায়। তা সংগঠন মনঃস্থির করে।
সন্ত্রাসবাদের মূলে কী- মনোবৈকল্যে, না এক সমস্যাসংকুল ব্যক্তি! সন্ত্রাসবাদে দীক্ষা কী ঘটনাচক্রে, না অর্থনৈতিক, সামাজিক বা শিক্ষাগত কোনো মূল কারণ রয়েছে, না ব্যক্তিগত মর্মার্থের কারণে যে কিভাবে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করে। এক সময় মনে করা হতো সন্ত্রাসীরা ব্যক্তিত্ব-বিশৃঙ্খলার, আত্মম্ভরিতা, আত্মপূজারী বা অসুস্থ এক মনোবিকারে নিজেকে সদা অত্যাচারিত বা ক্ষতিগ্রস্ত ভাবে। সন্ত্রাসভাবে যে সবাই তার বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, এমন এক ধরনের মনোবৈকল্য সন্ত্রাসবাদীর মনে কাজ করে। মনঃসমীক্ষণে দেখা যায়, সন্ত্রাসবাদীদের মধ্যে এমন কিছু দেখা যায় না, যাকে অস্বাভাবিক বা একেবারে বাতুল বলা যেতে পারে। ব্যক্তিগত চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য দ্বারা সন্ত্রাসীকে বোঝা ভার। তাহলে সামাজিক কারণ কী সবচেয়ে প্রভাবী কারণ?
যারা নিপীড়নমূলক আবহাওয়ায় সমাজে বাস করে, তাদের সবাই সন্ত্রাসবাদের দিকে আকৃষ্ট হয় না। পরিবেশগত কোনো কারণকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে দেখা যায় না। সন্ত্রাসবাদের মূল কারণও শনাক্ত করা কঠিন।
সালাফি জিহাদি আন্দোলনে নেতৃত্ব ও সদস্যসংখ্যা থেকে দেখা যায় বেশির ভাগ লোক এসেছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত থেকে। আত্মঘাতী হামলাকারীদের মধ্যে অর্থনৈতিক নিপীড়নের তেমন প্রাধান্য দেখা যায় না। শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্য বা বেকারত্বকে মূল কারণ বলা যায় না।
সন্ত্রাসবাদের বিচিত্র প্রণোদনার মধ্যে যে একটা জিনিস লক্ষণীয়, তা হচ্ছে, ব্যক্তির অর্থ ও মর্মের অন্বেষণ। বিচিত্র প্রণোদনার মধ্যে একটা প্রধান বা মূল প্রণোদনা থাকতে পারে। আবার সেই প্রণোদনা পাঁচমিশালিও হতে পারে। মানুষের জীবন একদিক থেকে বত্রিশ ভাজা।
দলগত আদর্শের প্রতি আনুগত্য মৃত্যুদুশ্চিন্তা হ্রাস করে সন্ত্রাসবাদের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি করে। ১২টি আরব দেশ, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ায় ইন্টারনেটভিত্তিক এক নিরীক্ষা চালায় ন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর দ্য স্টাডি অব টেররিজম অ্যান্ড রেসপনসেস। সংগঠনটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, মানুষ শুধু মৃত্যুচিন্তায় ব্যক্তিগত তাৎপর্য হারাতে পারে না, প্রবাসে-দ্বিবাসে মুসলমান যুবকদের মধ্যে সামাজিক নিঃসঙ্গতা এবং অক্ষমতায়নের জন্যও সে তাৎপর্য ক্ষয়ে যেতে পারে। তেমনটি ঘটতে পারে দলের অপমান ও অবস্থান-চ্যুতির কারণে। পথভ্রষ্ট অবস্থানের খেসারত হিসেবে সন্ত্রাসবাদী আদর্শ আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। ইসরায়েলে যেসব আরব নারী বোমা বিস্ফোরণে জড়িত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বন্ধ্যত্ব, তালাকপ্রাপ্তি বা বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক, ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা ছিল। ভ্রষ্টতা ও অস্বাভাবিক আচরণের জন্য ব্যক্তিগত তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে পুনরুদ্ধারের জন্য কেউ কেউ আদর্শের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত হতে পারে। ওসামা বিন লাদেন, ১৯৯৩ সালে টুইন টাওয়ারের ওপর হামলাকারী রামজি ইউসুফ, আইজাক রবিনের আততায়ীর মধ্যে এমনতর প্রবণতা লক্ষ করেছেন মনঃসমীক্ষণকারী গবেষকরা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসিদের ইহুদি নির্যাতনের প্রতিশোধকল্পে পোল্যান্ডের ১৫০ জনের এক ইহুদিবাদী দল চারটি জার্মান নগরীর জল-সরবরাহের উৎসে বিষপ্রয়োগের যে ষড়যন্ত্র করে, তা ব্রিটিশ সৈন্যদের তৎপরতায় ভেস্তে যায়।
শিশুদেরও সন্ত্রাসকর্মে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে হিজবুল্লার মেহদি জোয়ানদের প্রশিক্ষণ দিয়ে। ইসরায়েলের হামাসের ছয়জন উল্লেখযোগ্য নেতাকে গুপ্তহত্যা করার পরিকল্পনার পর হামাসের সদস্যদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধি পায়।
আঘাতজনিত স্নায়ুরোগ, আদর্শগত কারণ ও সমাজের চাপ একত্রে মিলে ব্যক্তিগত তাৎপর্যের সন্ধানে সন্ত্রাসবাদে মানুষ উদ্বুদ্ধ হতে পারে। এ সন্ত্রাসী চেতনার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটতে পারে বাস্তবিক তাৎপর্যহানিতে বা সম্ভাব্য মর্যাদাহানিতে বা হৃত মর্যাদা উদ্ধারের আকর্ষণীয় সম্ভাবনায়। আত্মঘাতী হামলাকারীদের বিদায়ী সম্ভাষণে, সাক্ষাৎকারে এবং অডিও রেকর্ডিং ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় বিবেচনা করে তাৎপর্য বা মর্যাদার অনুসন্ধান তত্ত্বকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে।
জীবনের অর্থ তাৎপর্য বা মর্যাদাদানের ক্ষেত্রে মতাদর্শের গুরুত্ব ও ভূমিকা রয়েছে। সন্ত্রাসবাদী দলে অংশগ্রহণের ফলে এমন এক সামাজিক বাস্তবিকতায় রূপান্তরিত, যেখানে সন্ত্রাসীকর্মকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হয়, দুশ্চিন্তা বা দোলাচলতা দূর হয় এবং অনপরাধ ব্যক্তিদের ক্ষতি করতে অপরাধবোধ ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে যায় এবং সমাজ যে ব্যবহার অনাচরণীয় তা আকর্ষণীয় মনে হয়। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠদের দৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে যেসব আচরণ আমরা করি, তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে দলে পড়ে দলীয় আনুগত্যে তা সন্ত্রাসী সদস্যের কাছে ধীরে ধীরে মোহনীয় ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। অন্যের সঙ্গে কোনো কাজে অংশগ্রহণ করলে তার প্রতি সহমর্মিতায় মানুষ এমন কাজও করতে পারে, যা সমাজের চোখে অনাচরণীয় হতে পারে, সমাজের সমর্থন না থাকলেও দলের সমর্থনে তা সহনীয়, এমনকি অনুসরণযোগ্য হয়ে ওঠে। মনঃস্তম্ভের অধ্যাপক হাইডারের প্রভাবের ভারসাম্য তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষ অন্যদের সঙ্গে তার ব্যক্তি সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়, এই ভাবে যে অন্যরা যা অপছন্দ করে সে-ও তা অপছন্দ করে এবং অন্যরা যা পছন্দ করে সে-ও তা পছন্দ করে থাকে।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.