সিপির বিরুদ্ধে পোলট্রি খাতকে অস্থিতিশীল করার অভিযোগ- একই অভিযোগে ভিয়েতনামে বিচার শুরু হলেও বাংলাদেশ সরকার নীরব by জিয়াউল হক মিজান

থাইল্যান্ডভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি সিপির বিরুদ্ধে দেশের সম্ভাবনাময় পোলট্রি শিল্প খাতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে।
মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা এ কোম্পানি ইতোমধ্যে দখল করে নিয়েছে ডিম, মুরগি, বাচ্চা, খাদ্য, ওষুধসহ পোলট্রি শিল্পের সামগ্রিক বাজারের অন্তত ২৫ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে ‘পোলট্রি জায়ান্ট’ হিসেবে পরিচিত এ কোম্পানির বিরুদ্ধে বিুব্ধ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের উদ্যোক্তারা। কৃত্রিম উপায়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগে ভিয়েতনাম সরকার ইতোমধ্যে সিপির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু করলেও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে বাংলাদেশ সরকার।

সিপিসহ কয়েকটি বিদেশী কোম্পানি বাংলাদেশের ডিম ও মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে দাবি করে ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব সাইদুর রহমান বাবু নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রতিদিন প্রায় ৩০ মেট্রিক টন ব্রয়লার মুরগি বাজারে ছাড়ছে সিপি। বর্তমানে সিপির মার্কেট শেয়ার ৩০ শতাংশের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে। পোলট্রি খাতের এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে সিপি ব্যবসায় করছে না। এক দিন বয়সী বাচ্চা উৎপাদন থেকে শুরু করে ফিড ও ফিডের প্রিমিক্স তৈরি এমনকি ডিম এবং গোশত উৎপাদন করছে। বিভিন্ন ধরনের পোলট্রি ওষুধ ও ভ্যাকসিন আমদানি এবং তা বাজারজাত করছে। এর বেশির ভাগেরই অনুমোদন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।

এ দিকে বাংলাদেশ সরকার নীরব থাকলেও সিপির অপব্যবসায় বন্ধ করতে মাঠে নেমেছে আশপাশের দেশগুলো। থাননিন নিউজ ডটকমের দেয়া তথ্যানুযায়ী, গত ৪ থেকে ১১ জানুয়ারির মধ্যে ১০টি ডিমের প্রতিটি কার্টনের দাম ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয় সিপি ভিয়েতনাম। ভ্যানএক্সপ্রেসকে দেয়া সাাৎকারে দেশটির শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মার্কেট ডিভিশনের প্রধান ভো ভ্যান কোয়েন সাম্প্রতিক এ মূল্যবৃদ্ধিকে অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

আইনবিদ নুগুয়েন ভ্যান হাউ এ ধরনের কাজকে ফটকাবাজি বলে অভিহিত করেছেন এবং এ জন্য ৮৪ ধারার আওতায় বড় অঙ্কের জরিমানা করার পওে মত দিয়েছেন। সিপির মার্কেট শেয়ার ৩০ শতাংশ হলে ১১৬ ধারার আওতায় গত বছরের আয়ের ওপর ১০ শতাংশ হারে জরিমানা করা যেতে পারে বলে তিনি জানান।

গত ১৮ জানুয়ারি গণমাধ্যমের কাছে দেয়া এক সাাৎকারে সিপি থাইল্যান্ডে তার মার্কেট শেয়ার ১৬ শতাংশ বলে দাবি করেছে। তবে হো চি মিন সিটির ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্স পরিচালক দাও থি হুং ল্যান সিপির এ দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, ভিয়েতনাম কমপিটিশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়টি তদন্ত করছে। সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলো এ সপ্তাহে অভিযুক্ত কোম্পানির ডিমের দাম ও বিক্রয়ের পরিমাণ অডিট করবে বলেও খবরে বলা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারের অনুমতি নিয়ে সাতটি বিদেশী কোম্পানি বর্তমানে এ দেশে ব্যবসায় করছে। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের পাঁচটি এবং থাইল্যান্ড ও চীনের একটি করে কোম্পানি। এর মধ্যে থাই কোম্পানি পিসির দখলে রয়েছে বাজারের অন্তত ২৫ শতাংশ। আরো প্রায় ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে অপর ছয়টি বিদেশী কোম্পানি। পোলট্রি সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাচ্চা উৎপাদনের অনুমতি নিয়ে দেশে ব্যবসায় শুরু করা এসব কোম্পানি নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে এখন সবই করছে। আরো আটটি বিদেশী কোম্পানি এ খাতে বিনিয়োগের অনুমতি পেতে যাচ্ছে জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তখন সম্ভাবনাময় এ শিল্পের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশই চলে যাবে বিদেশীদের হাতে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশী খামারগুলোকে বসিয়ে দিতে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে সিপিসহ বিদেশী কোম্পানিগুলো। বিপুল পুঁজির মালিক হওয়ার সুবাদে তারাই কখনো উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে ডিম, মুরগি ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। আবার সুযোগ বুঝে উৎপাদন বাড়িয়ে বিপাকে ফেলছে দেশী খামারিদের। তাদের চাতুরির শিকার হয়ে দেশের এক লাখ ১৪ হাজার ৭৬৩টি খামারের মধ্যে গত তিন বছরে ৫৯ হাজার ৩০০ খামার বন্ধ হয়ে গেছে। বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই বারবার বার্ড ফুর শিকার হওয়া এসব খামারে বর্তমানে কোনো মুরগি নেই।

বাংলাদেশের একটি কোম্পানির সাথে ৫১:৪৯ শেয়ারে প্রথমে ব্যবসা শুরু করলেও সিপি-বাংলাদেশ কয়েক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশী পার্টনারকে সরিয়ে দিয়ে শতভাগ মালিকানা নিজেদের নামে নিয়ে নেয়। সিপিসহ বিদেশী কোম্পানিগুলো সরকারকে স্বল্পমূল্যে উন্নত প্রোটিন সরবরাহের আশ্বাস দিলেও তা রাখেনি। বাচ্চা উৎপাদনের পর এখন তারা সাধারণ ুদ্র খামারিদের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে এবং বাণিজ্যিকভাবে লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগি উৎপাদন শুরু করেছে। খামারিদের অভিযোগ, বাজারে দাম ভালো থাকলে এক দিন বয়সী বাচ্চা বিক্রি কমিয়ে দিয়ে সিপি নিজেরাই তা পালন শুরু করে। ফলে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি হয়। অন্য দিকে সাধারণ দেশীয় খামারিরা যখন সামান্য লাভের আশায় অপোয় থাকে তখন ওভার প্রোডাকশন করে তারা দরপতন ঘটায়।

বহুজাতিক কোম্পানিগুলো স্বল্পপুঁজির দেশী বিনিয়োগকারীদের অসহায় করে তুলেছে মন্তব্য করে পোলট্রি শিল্প খাত বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেস প্রধান মুহম্মদ মাহাবুব আলী বলেন, বিদেশী বৃহৎ পুঁজির কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে দেশীয় শিল্প। তিনি বলেন, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিদেশী বিনিয়োগের অবশ্যই প্রয়োজন আছে তবে দেশীয় স্বার্থ সংরণের জন্যও প্রয়োজনীয় নীতিমালা থাকতে হবে। বিদেশী কোম্পানিগুলো আমাদের দেশে যে ধরনের অবাধ সুবিধা ভোগ করছে বাংলাদেশী কোনো কোম্পানি ওই সব দেশে গেলে এ সুবিধাগুলোর বেশির ভাগই পায় না বলে মন্তব্য করেন তিনি। পোলট্রি-সংশ্লিষ্টরা তাই ভিয়েতনামের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে সরকারকে শিা নিয়ে সে দেশের অনুকরণে প্রতিযোগিতা আইনের মতো শক্তিশালী আইন করে তার প্রয়োগ এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে আরো শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.