ক্যাসিয়াসের দুঃসময় by ফারজানা আক্তার সাথী

এমন বাজে সময় কমই এসেছে তার ক্যারিয়ারে। দুর্দান্ত পারফরমেন্সের সঙ্গে জোরালো ফিটনেস তাঁকে প্রায় অপ্রতিরোধ্যই করে তুলেছিল। একসঙ্গে জাতীয় দল ও ক্লাবের হয়ে অধিনায়কত্বের মতো কঠিন দায়িত্ব পালন করেছেন।
যেমন রিয়াল মাদ্রিদ, তেমনিই স্পেনের হয়ে। গোলপোস্টের নিচে ছিলেন দুর্ভেদ্য, অধিনায়ক হিসেবে বিচক্ষণ আর অবিচল। তবে হঠাৎই থমকে গেছে তাঁর ছন্দ। ঘাতক ইনজুরি ছিটকে দিয়েছে তাঁকে মাঠের বাইরে। বড্ড দুঃসময়ের মুখোমুখি বলতে গেলে এখন ইকার ক্যাসিয়াস।
কিছুদিন আগে খবরের শিরোনাম ছিলেন মাঠের বাইরে থেকে। সেটা লা লীগার ম্যাচে মালাগার বিরুদ্ধে (২২ ডিসেম্বর, ২০১২)। কোচ মরিনহোর সিদ্ধান্তেই সাইড বেঞ্চে বসেছিলেন তিনি। এমন পরিস্থিতি প্রায় ১০ বছর পর দেখতে হয়েছিল ক্যাসিয়াসকে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, ওই ম্যাচে মালাগার সঙ্গে হেরে গিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। ফলে সমালোচনার ঝড় ওঠে ক্যাসিয়াসকে বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে। অনেকে তো মরিনহোর পদত্যাগও দাবি করে। তবে ক্যাসিয়াস সঙ্গে সঙ্গে মুখ খুলেছিলেন। কোচের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, মরিনহোর সিদ্ধান্তকে তিনি সম্মান করেন। তারপরে নিয়মিত ছিলেন গোলপোস্টের নিচে। নিজ সামর্থ্যরে প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছিলেন দক্ষতার সঙ্গে। তবে গত ২৩ জানুয়ারি কোপা দেল রের কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বিতীয় লেগের ম্যাচে ঘটে অঘটন। ভ্যালেন্সিয়ার বিরুদ্ধে ওই ম্যাচে বাঁ হাতের একটি আঙ্গুল ভেঙ্গে যায় তাঁর। বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে সতীর্থ আরবেওলার জোরালো লাথি লাগে ক্যাসিয়াসের হাতে। সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রেচারে করে মাঠের বাইরে নিয়ে আসা হয় তাঁকে। পরে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। গত শুক্রবার অস্ত্রোপচারও করা হয়েছে তাঁর হাতে। ডাক্তারদের অভিমত, সুস্থ হতে প্রায় ৮ থেকে ১২ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে ক্যাসিয়াসকে। ফলে চ্যাম্পিয়ন্স লীগে শেষ ষোলোর গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে শক্তিশালী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে নামা হচ্ছে না ক্যাসিয়াসের, যা রিয়ালের জন্য দুঃসংবাদ। রিয়াল অবশ্য ক্যাসিয়াসের বিকল্প নিতে বিলম্ব করেনি। নিজেদের সাবেক গোলরক্ষক ডিয়েগো লোপেজকে তাঁর বর্তমান ক্লাব সেভিয়ার কাছ থেকে সাড়ে ৩ বছরের জন্য ৩.৫ মিলিয়ন ইউরো ট্রান্সফার ফি দিয়ে দলে ভিড়িয়েছে তারা। আজ বুধবার কোপা দেল রে টুর্নামেন্টে বার্সিলোনার বিরুদ্ধে এল ক্ল্যাসিকোতে মাঠে নামবে রিয়াল মাদ্রিদ। মাঠের বাইরে বসেই ধ্রুপদী লড়াই দেখতে হবে ৩১ বছর বয়সী সুদর্শন এই গোলরক্ষককে।
মালাগা ও রিয়াল সোসিদাদের বিরুদ্ধে টানা দুই ম্যাচ সাইড বেঞ্চে বসে থাকার পর কোপা দেল রে-তে সেল্টা ভিগো ও ভ্যালেন্সিয়ার বিরুদ্ধে দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখিয়েছেন ক্যাসিয়াস। সোসিদাদের বিরুদ্ধে ম্যাচে ক্যাসিয়াসের পরিবর্তে প্রথমদিকে এ্যান্টোনিও আদানকে নামিয়েছিলেন মরিনহো রিয়ালের জাল অরক্ষিত রাখার দায়িত্ব দিয়ে। কিন্তু সোসিদাদের বিরুদ্ধে বিস্ময় উপহার দেয়া দূরে থাক, মাত্র ৫ মিনিট যেতেই লালকার্ডের মুখ দেখে উল্টো লজ্জাই বয়ে এনেছিলেন আদান। বেশকিছু কঠিন আক্রমণ রুখে দিয়ে নিজের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে দুর্দান্ত দক্ষতা প্রমাণ করতে পেরেছেন। শুধু তাই নয়, গত ৫ ম্যাচের মধ্যে রিয়াল বুধবার কোপা দেল রে-তে দ্বিতীয় লেগে ভ্যালেন্সিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম গোল হজম করেছে। আর সেটাও ক্যাসিয়াসের পরিবর্তে শেষ মুহূর্তে নামা আদান হজম করেছেন। সবদিক থেকেই স্পেনের অধিনায়ক ক্যাসিয়াস প্রমাণ দিতে পেরেছেন নিজের নৈপুণ্য বিন্দুমাত্র টলেনি তাঁর। কিন্তু ভ্যালেন্সিয়ার বিরুদ্ধে বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির হাড় ভেঙ্গে যাওয়ায় অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছে ক্যাসিয়াসের। ফলে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের বাকি ম্যাচগুলো তো বটেই কিংস কাপে ক্ল্যাসিকো এবং ৬ ফেব্রুয়ারি উরুগুয়ের বিরুদ্ধে স্পেনের আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচেও তাঁকে পাওয়া সম্ভব হবে না কোচ ভিসেন্তে দেল বস্কের। সবকিছু ঠিক থাকলে ২৬-২৭ ফেব্রুয়ারি মাঠে ফিরতে পারবেন ক্যাসিয়াস। ডাক্তার মিগুয়েল দেল কেরো বলেন, ‘অস্ত্রোপচার ভাল হয়েছে। কিন্তু আনুমানিক ৮ থেকে ১২ সপ্তাহ লাগবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে উঠতে। সবচেয়ে ভাল, তাড়াহুড়া না করে সময় নিয়ে অপেক্ষা করা।’ অন্যদিকে ক্যাসিয়াসের অভাব রিয়ালকে পোড়াবে, তা সত্য। বার্সিলোনার তারকা প্লে-মেকার জাবি হার্নান্দেজই যেমন বলেছেন, ‘এটা তাঁদের জন্য আরেকটা বড় সমস্যা তৈরি হলো। ক্যাসিয়াস রিয়ালের মন-প্রাণ সবই। স্পেন এবং রিয়ালের জন্য এটা অনেক বড় ক্ষতি।’ রিয়াল মাদ্রিদের যুবদলে খেলার মধ্য দিয়ে ক্যারিয়ারের আত্মপ্রকাশ ঘটে ইকার ক্যাসিয়াসের। যুবদলে টানা নয় বছর খেলার পর ১৯৯৮ সালে যোগ দেন রিয়াল মাদ্রিদের ‘সি’ টিমে। সেখানে এক বছর খেলার পর ১৯৯৯ সালে সুযোগ পান ‘বি’ টিমে। সেখানে দুর্দান্ত ক্যারিশমা দেখিয়ে ওই বছরই জায়গা করে নেন রিয়াল মাদ্রিদের মূল দলে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিয়ে চলেছেন সান্টিয়াগো বার্নাব্যুর দলটিকে। প্রায় দুই যুগ রিয়ালে খেলে চলা স্প্যানিশ অধিনায়ক ক্যাসিয়াস কখনই ক্লাব ছাড়ার চিন্তা করেননি! মাঝেমধ্যে লোভনীয় প্রস্তাব যে আসেনি তা নয়। কিন্তু ৩১ বছর বয়সী ক্যাসিয়াস তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ১৯৯৯ সালে রিয়ালের মূল দলে অভিষেক। ইতোমধ্যে খেলেছেন সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলে ৬৫৪ ম্যাচ। এর মধ্যে লা লীগায় নেমেছেন ৪৭৬ ম্যাচে। জিতেছেন দুটি চ্যাম্পিয়নস লীগ, পাঁচটি স্প্যানিশ লীগ শিরোপা। সম্প্রতি নিজের ভবিষ্যত নিয়ে রিয়ালের ওয়েবসাইটে ক্যাসিয়াস বলেন, রিয়াল মাদ্রিদেই নিজের ক্যারিয়ারটা শেষ করতে পারলে আমার একটা স্বপ্ন পূরণ হবে। স্পেন জাতীয় দলের হয়ে ক্যাসিয়াস খেলেছেন ১৪৩টি ম্যাচ। জাতীয় দল কিংবা ক্লাব, গেল বছরটা বেশ ভালই কাটিয়েছেন ইকার ক্যাসিয়াস। দুর্দান্ত পারফরমেন্সের জন্য বর্ষসেরা গোলরক্ষকের এ্যাওয়ার্ড পান তিনি। এই পুরস্কারটি দেয় আন্তর্জাতিক ফুটবল ফেডারেশন ইতিহাস ও পরিসংখ্যান সংস্থা (আইএফএফএইচএস)। বলতে গেলে একতরফাভাবেই পুরস্কারটি জেতেন ক্যাসিয়াস। ২২৪ ভোট পান তিনি। সেখানে দ্বিতীয় স্থানে থাকা জুভেন্টাসের জিয়ানলুইজি বুফন পেয়েছিলেন মাত্র ৯৬ ভোট। এছাড়া তালিকায় ছিলেন চেলসির পিটার চেক, বার্সিলোনার ভিক্টর ভালদেস, বেয়ার্ন মিউনিখের ম্যানুয়েল নিউয়ের ও ম্যানচেস্টার সিটির জো হার্ট। ২০১২ সালটি ছিল ইকার ক্যাসিয়াসের জন্য সুখেরই। এ বছরই তাঁর নেতৃত্বে ইউরো জেতে স্পেন। আর তাঁর অধিনায়কত্বেই তিন মৌসুম পর লা লীগার শিরোপা জেতে রিয়াল মাদ্রিদ। এই এ্যাওয়ার্ড ক্যারিয়ারে পঞ্চমবারের মতো পেলেন ক্যাসিয়াস। তবে নতুন বছরের শুরুতে ইনজুরি ক্যাসিয়াসের পথচলাকে কঠিন করে দেবে। বিশেষ করে আগামী এক মাসের মধ্যে দুটি এল ক্লাসিকোতে বার্সার মোকাবেলা করতে হবে রিয়ালকে। সেখানে ক্যাসিয়াসের অনুপস্থিতি বড় রকমের ধাক্কাই রিয়ালের জন্য।

No comments

Powered by Blogger.