চাক হ্যাগেলকে যে কারণে বেছে নিলেন ওবামা by এনামুল হক

ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে রিপাবলিকান দলীয় চাক হ্যাগেলকে মনোনয়ন দিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। আলোচনাটা অবশ্য এ নিয়ে নয় যে, নিজে ডেমোক্র্যাট হয়ে তিনি রিপাবলিকান সদস্যকে কেন মন্ত্রী বানাবেন।
কেননা এই রেওয়াজ আমেরিকায় আছে। অনেক প্রেসিডেন্টই এ কাজ করেছেন। এমনকি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশও ভিন্ন দলের একজনকে নিজের কেবিনেটে ঠাঁই দিয়েছিলেন। তবে দেখা গেছে, ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্টরাই প্রতিরক্ষা ইস্যুটিকে দলের ওপরে স্থান দিয়েছেন বেশি। যেমন কেনেডি ম্যাকনামানাকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী বানিয়েছিলেন। ক্লিনটনও এ পদে একজন রিপাবলিকানকে বসিয়েছিলেন। এবার বসালেন ওবামা। অবশ্য ওবামার মন্ত্রিসভায় এর আগে আরও দু’তিনজন রিপাবলিকানকে নিয়েছেন। আলোচনা বা বিতর্কের ব্যাপারটা হলো ওবামা কেন চাক হ্যাগেলকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে মনোনয়ন দিলেন। এখানে আরেকটা কথাও বলে রাখা ভাল যে, এই মনোনয়নের পিছনে কংগ্রেসের অনুমোদন লাগবে।
সুতরাং প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে রিপাবলিকান চাক হ্যাগেলকে কেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে মনোনয়ন দিলেন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন বিশ্লেষক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন একটা ব্যাখ্যা হলো ডেমোক্র্যাটরা প্রতিরক্ষা ইস্যুতে বরাবরই দুর্বল। সেজন্য এ দায়িত্বটা তারা রিপাবলিকানদের দিয়ে সম্পন্ন করাতে চায়। দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখানো হয় যে, এ পর্যন্ত যতজন ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় এসেছেন তাদের অর্ধেকই প্রতিরক্ষাপদে একজন রিপাবলিকানকে নিয়েছেন।
আরেক ব্যাখ্যা হলো, ওবামা তার দ্বিতীয় মেয়াদে সুস্থ ও শান্তির প্রশ্নে নতুন সুর সংযোজন করতে ও নতুন গতিপথ নির্দেশ করতে চান। সেজন্যই চাক হ্যাগেলকে এ দায়িত্ব দেয়ার প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু চাক হ্যাগেল কেন, একজন আধুনিক রিপাবলিকান বলতে যা বোঝায় চাক হ্যাগেল ঠিক তা নন। তিনি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রক্ষণশীল, তবে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রশ্নে অতিমাত্রায় স্বাধীন এবং দীর্ঘকাল ধরে রিপাবলিকান মূলধারার চিন্তাচেতনা থেকে আলাদা, বিশেষ করে নাইন ইলেভেনের পর থেকে। সিনেটের শেব্রাঙ্কার সদস্য ছিলেন ১১ বছর। এ সময় প্রায়ই তিনি বিভিন্ন ইস্যুতে আপন দলের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। হ্যাগেল ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতাও করেছেন। তাঁর ভাষায়, যে কোন যুদ্ধই অনৈতিক। বুশের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধও তিনি সমর্থন করেননি। তিনি বুশের প্যাট্রিয়ট এ্যাক্ট, বিনা পরোয়ানায় তারবার্তা ট্যাপ করার বোরাধিতা করেছিলেন। ইরাক যুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন সত্য, তবে পরবর্তীকালে ইরাক ও আফগান যুদ্ধকে একবিংশ শতাব্দীর সমস্যাকে বিংশ শতাব্দীয় সমাধান বলে আখ্যায়িত করেন। ২০০৭ সালে ইরাক যুদ্ধে অর্থায়নের বিষয়টিকে মার্কিন সৈন্যদের স্বদেশ ফিরিয়ে আনার সময়সূচীর সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাবে তিনি ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে ভোট দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা দখলদার বাহিনী হিসেবে থেকে যেতে পারে না। তিনি কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য এবং ইরান ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সংলাপের পক্ষে অভিমত দিয়েছিলেন- যখন এ জাতীয় ভাবনা নিষিদ্ধ বস্তুর মতো বিবেচিত হতো। তথাপি তিনি শান্তিবাদী নন। ইসরাইল, হামাস ও হিজবুল্লাহ প্রশ্নে তাঁর অবস্থানের কারণেই নিজ দলের চরম রক্ষণশীল ও ইসরাইলী লবির তিনি ইতোমধ্যেই বিরাগভাজন হয়েছেন।
রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামের ভাষায়, হ্যাগেলের মনোনয়ন কংগ্রেসে অনুমোদিত হলে আমেরিকার ইতিহাসে তিনিই হবেন ইসরাইলের প্রতি সবচেয়ে বৈরীভাবাপন্ন প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
ওবামা প্রশাসন সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্যের দিকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাকাবেন, যেখানে ইসরাইল ঠিক আগের মতো একই মাত্রায় গুরুত্ব পাবে না। এমন এক ভূমিকা পালনে ওবামা তাই হ্যাগেলকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করছেন।
অন্য একটি ব্যাখ্যা হলো, দ্বিতীয় মেয়াদে এসে ওবামা প্রশাসনকে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ কর্মসূচী: যেমন শিক্ষা, বিজ্ঞান, অবকাঠামো, দারিদ্র্য বিমোচন, প্রতিরক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বড় রকমের কাটছাঁট করতে হবে। তার মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতেই সবচেয়ে বড় ধরনের টান ধরবে। বর্তমান বাজেটে প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে সরাসরি ৩ শতাংশে আনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে প্রতিরক্ষা ব্যয় হ্রাসের প্রক্রিয়া শুধু একটি বাজেটে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এক প্রজন্ম ধরে চলবে। এই ব্যয়হ্রাসের ফলে বিশ্বে আমেরিকার মর্যাদাগত অবস্থার অনেক রূপান্তর ঘটবে। তখন আমেরিকার অবস্থা অনেকটা আজকের ইউরোপের মতো হয়ে দাঁড়াবে।
চাক হ্যাগেলকে প্রতিরক্ষা ব্যয় হ্রাসের এই প্রজন্ম দীর্ঘ প্রতীক্ষার সূচনা পর্বটি তদারক করার জন্যই প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে মনোনীত করা হয়েছে। যে কোন ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রতিরক্ষা ব্যয়ে বড় ধরনের কাটছাঁট করতে চাইলে তিনি চাইবেন পেন্টাগনের দায়িত্বে যেন একজন রিপাবলিকান থাকেন- যার বদৌলতে তিনি রাজনৈতিক ছত্রছায়া পেতে পারেন। আর সেই মানুষটি যদি যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য প্রদকপ্রাপ্ত একজন প্রাক্তন সৈনিক হন তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
ইসরাইল বা ইরান সম্পর্কে হ্যাগেল যত কথাই বলুন না কেন সবই গৌন ব্যাপার। আসল প্রশ্ন প্রতিরক্ষা ব্যয় হ্রাসের দীর্ঘ প্রক্রিয়াটা তিনি কিভাবে শুরু করবেন, কিভাবে তিনি সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন এবং বর্তমান সেনা সদস্যদের বেতন-ভাতা পরিশোধের মধ্যে ভারসাম্য বিধান করবেন। ওবামা এই কাজগুলোর জন্য হ্যাগেলকেই সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করেছেন। তাই তাকে এ কাজের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.