নতুন মিশনে স্নেইডার by মোঃ সোহেল রানা

টোটাল ফুটবলের জনক বলা হয় হল্যান্ডকে। হৃদয়ছোঁয়া ফুটবল নৈপুণ্যের কারণেই এমন স্বীকৃতি। যুগে যুগে দেশটির গুণী ফুটবলাররা মাতিয়েছেন ফুটবলবিশ্ব।
এঁদের মধ্যে শীর্ষ নাম-জোহান ক্রুয়েফ, রুড গুলিত, ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড, মার্কো ভ্যান বাস্তেন, ডেনিস বার্গক্যাম্প, রুডি ভ্যান নিস্টলরয়। এতসব গুণী ফুটবলার মাঝে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উঠে এসেছেন আরও একঝাঁক তারকা। আরিয়েন রোবেন, রবিন ভ্যান পার্সি, ভ্যান বোমেলরা এর মধ্যে অন্যতম। এঁদের মধ্যে অবধারিতভাবে থাকবেন ওয়েসলি স্নেইডারও। তারকা এই মিডফিল্ডার এখন পর্যন্ত নিজের সেরা পারফরমেন্স প্রদর্শন করেছেন ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ ফুটবলে। সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ তারকা সম্প্রতি ইতালিয়ান জায়ান্ট ইন্টার মিলান ছেড়ে নাম লিখিয়েছেন তুরস্কের ক্লাব গালাতাসারেতে। ইনজুরির কারণে ফর্ম পড়তি দিকে থাকলেও নতুন ক্লাবে এসে সেরা ছন্দে ফেরার স্বপ্ন বুনছেন তুখোড় এই মিডফিল্ডার। ইতালির মায়াজাল ভেদ করে ইতোমধ্যে নতুন ক্লাবের আঙিনায় এসেছেন স্নেইডার। গালাতাসারের ভক্ত-সমর্থকরা নয়া তারকাকে ফুলেল অর্ভথ্যনা জানিয়ে বরণ করে নিয়েছেন।
স্নেইডারকে স্বাগত জানাতে ইস্তামবুলের প্রধান বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছিলেন হাজার হাজার ভক্ত-সমর্থক। তিনি ইতালি থেকে তুরস্কে পাড়ি জমান। নতুন জায়গায় আগমনের পর ভক্তদের ভালবাসায় সিক্ত হন ২৮ বছর বয়সী তারকা। তাঁকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে ভক্ত ও সমর্থকদের ঢল নামে। স্নেইডারকে বহনকারী গাড়িটি বিমানবন্দরের টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে সমর্থকরা গালাতাসারের পতাকা উঁচিয়ে ও ক্লাবের পক্ষে সেøাগান দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান। ছাদ খোলা গাড়িতে হাত নেড়ে সমর্থকদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করেন সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ তারকা। এ সময় অনেক ভক্তই লাফিয়ে গাড়িতে উঠে পড়েন এবং ডাচ মিডফিল্ডারকে জড়িয়ে ধরেন। বিমানবন্দরেই ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয় স্নেইডারকে। এরপর ক্লাবের এক টেলিভিশন সাক্ষাতকারে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তিনি। এতে নতুন ক্লাবে এসে নিজের উচ্ছ্বাসের কথা দমাতে পারেননি। সাক্ষতাকারে স্নেইডার বলেন, ‘এখানে এসে আমি অভিভূত। গালাতাসারের পক্ষে মাঠে নামার জন্য আমার তর সইছে না। আমি জানি তুরস্কের জনগণ কতটা ফুটবল ভালবাসেন। গালাতাসারে ভক্তরা ক্লাবের প্রতি কতটা নিবেদিত এবং আবেগপ্রবণ সেটা আমাকে স্বাগত জানানোর মধ্যদিয়েই বুঝতে পেরেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি খুব খুশি। গালাতাসারের ফুটবলার হতে পেরে আমি গর্বিত। ভক্তরা আমাকে যে ভালবাসা দিয়েছে তা ভোলার নয়। আমি তাদের ভালবাসার প্রতিদান দিতে চাই।’ গত ২৭ জানুয়ারি তুর্কী লীগে গালাতাসারের হয়ে বেসিকতাসের বিরুদ্ধে অভিষেক হয়েছে স্নেইডারের। নয়া মিশনে অভিষেক ম্যাচে অবশ্য গোল পাননি তিনি।
গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ইন্টার মিলানের সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরে স্নেইডারের। এ কারণে নবেম্বরে জোর গুঞ্জন রটে, জানুয়ারির দলবদলেই ইন্টার ছাড়ছেন তারকা এই মিডফিল্ডার। বেতন-ভাতা নিয়ে ঝামেলা হলেও ২৮ বছর বয়সী এ তারকা জানিয়েছিলেন, ইতালিয়ান ক্লাবেই থেকে যেতে চান তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। সমস্ত জল্পনা-কল্পনা আর আলোচনার ইতি টেনে তুরস্কের ক্লাব গালাতাসারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন স্নেইডার। সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ তারকাকে ৭.৫ মিলিয়ন ইউরোতে দল ভেড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছে ইস্তানবুলের ক্লাবটি। ইন্টার সঙ্গে চার বছরের বন্ধন ছিন্ন করলেও তুর্কি ক্লাবে এসে খুশি স্নেইডার। প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ডাচ তারকা বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে আমি খুব উচ্ছ্বসিত, খুশি। এই মুহূর্তে দিন গুনছি, কবে গালাতাসারের ঐতিহ্যবাহী জার্সি গায়ে চড়াব।’ উচ্ছ্বাসের মধ্যে আগামী দিনগুলোতে তুর্কী ভাষাটা শিখে নেয়ার ইচ্ছার কথাও জানিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ মাতানো এ তারকা। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের উদ্ধৃতিতে জানা গেছে, গালাতাসারের সঙ্গেও নাকি বেতনাদি নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল স্নেইডারের। গালাতাসারে ও ইন্টার মিলান স্নেইডারের দলবদলের জন্য যে দর নির্ধারণ করেছিল, সেটা নাকি পছন্দ হচ্ছিল না ডাচ তারকার। তবে তুর্কী ক্লাবের ওয়েবসাইটে নিশ্চিত করা হয়েছে, ওই ঝামেলার সমাধান হয়েছে।
২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে আলো ছড়ান স্নেইডার। দুর্দান্ত ফুটবলশৈলী প্রদর্শন করে দলকে ফাইনালের টিকেট পাইয়ে দিয়েছিলেন। ফাইনালে স্পেনের কাছে হেরে শেষ রক্ষা না হলেও হল্যান্ডের খেলা প্রশংসিত হয়েছিল ফুটবলবিশ্বে। ডাচদের এমন পারফরমেন্সের অন্যতম প্রধান কারিগর ছিলেন অ্যাটাকিং এই মিডফিল্ডার। কুশলী এ ফুটবলার দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ শেষেই বিয়ের পিড়িতে বসেন। ১৭ জুলাই ২০১০ সালে ডাচ এ তারকা প্রেমকে বাস্তবে পরিণত করেন। অবশ্য আরও আগেই নির্ধারিত ছিল বিয়ের বিষয়টি। ২০০৯ সালের ক্রিস্টমাস ডে’তে নিজেদের বিয়ের ঘোষণা দিয়েছিলেন স্নেইডার-ইওলান্থে জুটি। অবশ্য এর আগেও একবার বিয়ে করেছিলেন স্নেইডার। ২০০৫ সালে রোমান স্ট্রিকস্ট্রাকে বধূ হিসেবে বরণ করেন তিনি। ওই সংসারে জেসি নামের একটি পুত্রসন্তানও রয়েছে। কিন্তু ২০০৯ সালের ২১ জানুয়ারি তাঁদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপরই পরিচয় হয় ডাচ মডেল, অভিনেত্রী ও টিভি উপস্থাপিকা ইওলান্থের সঙ্গে। এরপর দু’জনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের অনেক ছবি চলে আসে সংবাদমাধ্যমে। যে কারণে ২০০৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর তাঁরা বাগদান সম্পন্ন করেন। আর পরের বছর বসেন বিয়ের পিড়িতে।
১৯৮৪ সালে হল্যান্ডের আর্টেরেচ শহরে জন্ম নেয়া স্নেইডারের ফুটবল প্রতিভা বিকশিত হয় পরিবার থেকেই। তাঁর পুরো পরিবার ছিল খেলাপ্রেমী। বাবাসহ বড় ভাইয়েরা ছিলেন পেশাদার ফুটবলার। যে কারণে পেশা হিসেবে ফুটবলকে বেছে নিতে খুব একটা সমস্যা হয়নি তাঁর। ‘ফ্রিকিক মাস্টার’ হিসেবে সুপরিচিত এই খ্যাতিমান ফুটবলারের উত্থান ঘটে মাত্র সাত বছর বয়সে আয়াক্সের হয়ে। ‘আয়াক্স একাডেমি’ই তাঁকে ঘষেমেজে তারকা ফুটবলারে পরিণত করতে সাহায্য করে। প্রায় একযুগ ক্লাবটির যুবদলে খেলে নিজের প্রতিভাকে শাণিত করেন। দীর্ঘ এই সময়ে নিজের নৈপুণ্য দেখিয়ে জায়গা করে নেন আয়াক্সের মূল দলে। সেখানেও টানা ছয় বছর (২০০২-২০০৭) আলো ছড়ান নিয়মিত। ক্লাবের হয়ে জিতেছেন অসংখ্য শিরোপা। এ সময় দলের হয়ে ১২৭ ম্যাচে গোল করেন ৪৪টি। মূলত এ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হলেও গোলও পেয়েছেন প্রচুর। এখানে অসাধারণ নৈপুণ্যের ফলে তাঁর দিকে নজর পড়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা ও জনপ্রিয় ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের। যার ফলেই ২০০৭ সালের ১২ আগস্ট ২৭ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে নাম লেখান সান্টিয়াগো বার্নাব্যুর ক্লাবে। এর ফলে রয়েসটন ড্রেনথ এবং আরিয়েন রোবেনের পর ডাচদের হয়ে মাত্র তৃতীয় ফুটবলার হিসেবে নাম লেখান বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্লাবটিতে। কিন্তু স্পেনে এসে স্নেইডারের সময় খুব একটা ভাল যায়নি। দলের মূল একাদশে জায়গা পেতেন না নিয়মিত। এক বছর পর অবশ্য নিজেকে মানিয়ে নিতে থাকেন। সে সময় ব্রাজিলিয়ান তারকা রবিনহো রিয়াল ছেড়ে ম্যানচেস্টার সিটিতে পাড়ি জমালে ১০ নন্বর জার্সিটা পেয়ে যান স্নেইডার।
এরপর প্রত্যাশা অনুযায়ী পারফর্ম করতে পারছিলেন না। এ কারণে একরকম হতাশাই ভর করে ওলন্দাজ তারকার মনে। দুই বছরে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ৫২ ম্যাচে গোল করেন মাত্র ১১টি। সঙ্গতকারণেই ক্লাব বদলের চিন্তা এসে যায় তাঁর মনে।
এরই ফলে ২০০৯ সালের ২৭ আগস্ট ১৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে নাম লেখান ইতালিয়ান জায়ান্ট ইন্টার মিলানে। এখানে আসার পরই মূলত উত্থান ঘটে স্নেইডারের। ইতালিয়ান চ্যাম্পিয়ন ক্লাবে সাইন করার পর থেকেই নিয়মিত আলো ছড়াতে থাকেন। যার পুরস্কার হিসেবে শুরু থেকেই সুযোগ পান গৌরবময় ১০ নন্বর জার্সি গায়ে চাপানোর। এখানে তাঁর সেরা সাফল্য হচ্ছে এক মৌসুমে তিনটি শিরোপা জয়। যেগুলো হচ্ছে সিরি এ, কোপা ইতালিয়ান এবং উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ। পর্তুগীজ কোচ জোশে মরিনহোর অধীনে পুরো মৌসুমই খেলেন দুর্দান্ত। এই অবস্থানের জন্য বিনয়ী স্নেইডার কৃতিত্ব দেন মরিনহোকে, ‘মরিনহো একজন অসাধারণ কোচ। তিনি জানেন কিভাবে একজনের মেধাকে কাজে লাগাতে হয়। আমার আজকের অবস্থানের জন্য তাঁর অবদানই বেশি।’ মরিনহোও ইন্টার মিলানে থাকাকালে স্নেইডারের ভূয়সী প্রশংসা করেন, ‘ও (স্নেইডার) অসাধারণ মেধাসম্পন্ন এক ফুটবলার। যে কোন বিষয় খুব দ্রুত ও আয়ত্তে নিতে পারে। আমার দেখা অন্যতম সেরা ফুটবল প্রতিভা ও।’
স্নেইডারের জাতীয় দলে অভিষেক হয় ২০০৪ সালে। জাতীয় দলের হয়ে প্রথম গোলে দেখা পান মালদোভার বিরুদ্ধে ২০০৪ ইউরো কোয়ালিফাইং ম্যাচে। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপেও তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন দেশের হয়ে। তবে ২০০৮ সাল থেকেই মূলত দেশের হয়ে নিয়মিত খেলে চলেছেন। এখন দলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তিনি। এখন পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে ৯০ ম্যাচে গোল করেছেন ২৪টি। বিশ্বকাপে শিরোপা জিততে ব্যর্থ হলেও হতাশ নন তারকা এ ফুটবলার। এখনও দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখেন তিনি, ‘আমি এখনও স্বপ্ন দেখি। দক্ষিণ আফ্রিকায় শেষ মুহূর্তে এসে স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার কষ্ট পেয়েছি। তাই বলে এখানেই থেমে যেতে চাই না। দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জেতাই এখন আমার একমাত্র স্বপ্ন।’

No comments

Powered by Blogger.