শ্রীলঙ্কায় গণতন্ত্র কোন্ পথে by শামীম আহমেদ

দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসানের পর শ্রীলঙ্কায় যখন স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা হাতছানি দিচ্ছিল, তখন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশটির রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক অবস্থার পাশাপাশি গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
বছরের পর বছর ধরে সেনাবাহিনী ও তামিল বিদ্রোহীদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব-সংঘাতে শ্রীলঙ্কার মাঠ প্রানত্মর রক্তাক্ত হলেও গণতন্ত্রের পথ থেকে দেশটি পিছু হটেনি। ১৯১৩ সাল থেকে শ্রীলঙ্কায় সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থার প্রচলন হয়ে আসছে। শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বৈরতন্ত্রের কোন স্থান ছিল না। কিন্তু মাহেন্দ রাজাপাকসে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই কেমন যেন স্বৈরাচারী আচরণ শুরম্ন করেছেন। অবশ্য এবারের নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। রাজাপাকসের স্বৈরাচারী মনোভাব শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্রকে যে মারাত্মকভাবে তিগ্রসত্ম করছে সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মহল একমত। শ্রীলঙ্কা ক্রমেই একটি বিসত্মীর্ণ কারাগারে পরিণত হচ্ছে। তামিল জঙ্গী দমনের নামে সাধারণ তামিল লোকদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ, মানবাধিকার ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তামিলদের বন্দিশিবিরে আটক করে রাখা, স্বজনপ্রীতি, মতার অপব্যবহার, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ও সেনাবাহিনীকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার ইত্যাদি কারণে শ্রীলঙ্কার রাজনীতি কোন্ পথে এগুচ্ছে সে বিষয়ে সকলে উদ্বিগ্ন।
শ্রীলঙ্কার সাবেক সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী সরাথ ফনসেকাকে গত সপ্তহে তাঁর অফিস থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বিরম্নদ্ধে সেনাবাহিনীর আইন লঙ্ঘন করার অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়াও বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রেসিডেন্টের বিরম্নদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁর বিরম্নদ্ধে। দেশটির প্রতিরা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে ফনসেকাকে সেনা হেফাজতে রাখা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার এক কর্মকর্তা বলেছেন, 'ফনসেকা যদিও সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন, তবু তাঁকে সামরিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন করা হবে।' ফনসেকাকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে রাজধানী কলম্বোসহ সারা দেশে সেনাবাহিনী ও সরকারপন্থীদের সাথে ফনসেকার সমর্থকদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। মাত্র ছয় মাস আগেও রাজাপাকসে ও ফনসেকা খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। শ্রীলঙ্কায় তামিলবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। রাজাপাকসে নিয়ন্ত্রণ করেছেন রাষ্ট্রযন্ত্র, আর ফনসেকা লড়েছেন ময়দানে। তামিলবিরোধী যুদ্ধে বিজয়ের নায়ক তাঁরা দু'জনেই। কিন্তু যুদ্ধোত্তর পরিবেশে তারা হয়ে উঠেছেন একে অপরের চরম শক্র। তামিল দমনের কৃতিত্ব নিয়ে পরস্পর প্রতিযোগিতা হয়। এই শক্রতার সূত্রপাত বিশেষত সাবেক সেনাপ্রধান সরাথ ফনসেকা যখন প্রেসিডেন্ট পদে লড়ার ঘোষণা দেন তখন থেকে। নির্বাচনের দিন ফনসেকা তাঁর বেশ কয়েক সঙ্গীসহ স্থানীয় একটি হোটেলে অবস্থান করলে সেনা সদস্যরা হোটেলটি ঘেরাও করে রাখে। তখন থেকে ফনসেকা দাবি করে আসছেন রাজাপাকসে তাঁকে হত্যা করতে চান। নির্বাচনে পরাজয়ের পর ফনসেকা জীবন বাঁচানোর জন্য প্রথমে ভারতে আশ্রয় নিতে চাইলেও ভারত সরকার এ বিষয়ে কোন আগ্রহ দেখায়নি। অবশ্য এরপর তিনি অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এদিকে, রাজাপাকসে বলেছেন ফনসেকা রাষ্ট্রবিরোধী অপতৎপরতায় জড়িত। ফনসেকার গ্রেফতার হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। বান-কি মুন টেলিফোনে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের সঙ্গে আলাপকালে সরকারকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার পাশাপাশি ফনসেকার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহবান জানান। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ফিলিপ ক্রাউলি বলেন, সমাজে এরই মধ্যে যে বিভাজন রয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার ল্যে কাজ করা শ্রীলঙ্কা সরকারের জন্য খুবই জরম্নরী। নরওয়ে বলেছে, ফনসেকাকে গ্রেফতার করার ঘটনা শ্রীলঙ্কায় স্থায়ী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের েেত্র প্রভাব ফেলতে পারে।
২৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রায় ১৯ লাখ ভোটের ব্যাবধানে পরাজিত করেছেন তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক সেনাপ্রধান সরাথ ফনসেকাকে। সাবেক সেনাপ্রধান ফনসেকাকে সমর্থন করে দেশটির মার্কসবাদী দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) এবং তামিল ন্যাশনাল এ্যালায়েন্স (টিএনএ)। ভোটের আগে রাজনৈতিক বিশেস্নষকগণ মনে করেছিলেন নির্বাচনে লড়াই হবে সমানে সমানে। কিন্তু রাজাপাকসে পেয়েছেন ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ফনসেকা পেয়েছেন ৪০ দশমিক ১ শতাংশ ভোট। নির্বাচনে ৭০ শতাংশ ভোটার ভোট প্রয়োগ করলেও, তামিল ভোটারদের উপস্থিতি ছিল খুব কম। যুদ্ধবিধ্বসত্ম তামিল অধু্যষিত উত্তর-পূর্বে ভোট পড়েছে মাত্র ২০ শতাংশ। নির্বাচন পর্যবেক ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো নির্বাচন নিয়ে প্রথম থেকে প্রশ্ন তুলে আসছে। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে ফনসেকা আদালতে যাওয়ার কথাও ঘোষণা করেছিলেন। হংকংভিত্তিক এশিয়ান মানবাধিকার কমিশন জানিয়েছে, ভোট গণনায় অনিয়ম ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহারের মাধ্যমে রাজাপাকসে দ্বিতীয় বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এবারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা হলেও , ভোটে তাঁর প্রভাব পড়েনি। ২০০৫ সালে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর রাজাপাকসে তাঁর ভাইদের রাষ্ট্রের গুরম্নত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব দেন। এ ছাড়া রাজাপাকসের পরিবারের ঘনিষ্ঠজন ও বন্ধুবান্ধবদের গুরম্নত্বপূর্ণ দায়িত্ব বণ্টন করেন। বিরোধীরা অভিযোগ করেন, দেশের বাজেটের ৮০ শতাংশই কব্জা করে রেখেছে রাজাপাকসে ও তাঁর ভাইরা।
প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার দু'মাস আগেই পার্লমেন্ট ভেঙ্গে দিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে ৮ এপ্রিল নতুন নির্বচন অনুষ্ঠিত হবে। জানা যায়, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী ফনসেকা পার্লামেন্ট নির্বাচনে সমমনা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চিনত্মাভাবনা করছেন, ঠিক সে সময় তাঁকে গ্রেফতার করা হলো। অবশ্য গ্রেফতার থাকা অবস্থায়ও ফনসেকা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। রাজপাকসের জোট পার্লামেন্ট নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের আশায় সব কূটকৌশল বাসত্মবায়ন করছে। এর মূল কারণ হচ্ছে মতার ওপর রাজাপাকসের একচ্ছত্র আধিপত্য বিসত্মার।
যুদ্ধবিধ্বসত্ম শ্রীলঙ্কায় জাতিগত ঐক্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক েেত্র যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করতে রাজাপাকসেকে উদ্যোগী হতে হবে। হাজার হাজার তামিল জনগণ শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের পুর্নবাসনসহ যুদ্ধবিধ্বসত্ম এলাকাগুলোর পুনর্গঠনই নবনির্বাচিত সরকারের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত। হাজারো সমস্যার মাঝে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা যদি দীর্ঘায়িত হয় তবে শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্র কোন্ গনত্মব্যে পেঁৗছাবে তা বলা কঠিন।

No comments

Powered by Blogger.