ইউক্রেন নির্বাচন- ইয়ানুকোভিচের রাজনৈতিক পুনরুত্থান

অর্ধযুঞ্জ পার হয়নি। 'অরেঞ্জ বিপক্ষোভে এর খলনায়ক ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ, জনগণের বিক্ষোভে মতার মসনদ হতে যার পতন হয়েছিল অত্যনত্ম করুণভাবে,
দিনবদলের পালায় সেই খলনায়কেরই পুনরুত্থান এবং রাজনৈতিক পুর্নজন্ম আসলেই চমকপ্রদ! মাত্র ৫বছর আগে স্বৈরাচারী আখ্যা দিয়ে যার বিরম্নদ্ধে লাখ লাখ মানুষ রাসত্মায় নেমেছিলো; রাষ্ট্রমতা থেকে উৎখাতের মাধ্যমে পালন করেছিল গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সত্যের জয়, তাকেই ফের জনগণ ভোটের মধ্য দিয়ে মতার সিংহাসনে বসালো। বিস্ময়কর ঘটনাই বটে!
ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়াপন্থী ইয়ানুকোভিচের বিজয় এখন 'অরেঞ্জ বিপস্নব'-এর প্রতিশোধ বলেই মনে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর ফলে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রনীতি আবারও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়বে।

নির্বাচন ২০১০
এবছর ১৭ জানুয়ারী ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভিক্টর ইউশচেঙ্কো সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়া তিমোশেঙ্কো আর অরেঞ্জ বিপস্নবের খলনায়ক ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। যদিও ভোট গণনা শেষে দেখা যায় কোন প্রাথর্ীই ৫০ শতাংশ ভোট পায়নি, তারপরও ইয়ানুকোভিচ তিমোশেঙ্কোর চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছেন। ইয়ানুকোভিচের জয়ের আভাস পাওয়া গিয়েছিল তখনই। এরপর দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন হয় ৭ ফেব্রম্নয়ারি। আগে থেকেই বোঝা গিয়েছিল দ্বিতীয় দফায় ভোটগ্রহণ হলে নির্বাচনী ফলাফল তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। কারণ তিমোশেঙ্কো প্রথম দফার ফলাফল দেখে বেশ আটঘাঁট বেঁধেই নেমেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় দফায়ও তিমোশেঙ্কো হেরে যান। যদিও এবার ভোট ব্যবধান আরও কম। মাত্র সাড়ে তিন শতাংশ। তিমোশেঙ্কো অবশ্য নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখান করেছেন। নির্বাচনে কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ এনে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে অরেঞ্জ বিপস্নবের মতো জনগণকে রাজপথে বিােভ-আন্দোলনের জন্য ডাক দেবেন না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের নির্বাচনের প্রশংসা করেছে। কিয়েভে মার্কিন দূতাবাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ৭ ফেব্রম্নয়ারির দ্বিতীয় দফা নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করায় ইউক্রেনের জনগণকে অভিনন্দন জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বিবৃতিতে অবশ্য ইয়ানুকোভিচকে নিয়ে কোন কথা বলা হয়নি। রম্নশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভও অভিনন্দন জানান নির্বাচনে বিজয়ী ইয়ানুকোভিচকে।

জাতীয়তাবাদের শুরম্ন

পূর্বে রাশিয়া, উত্তরে বেলারম্নশ, পশ্চিমে পোল্যান্ড, সেস্নাভাকিয়া ও হাঙ্গেরি, দণি-পশ্চিমে রোমানিয়া ও মলদোভা এবং সর্বদেিণ কালো সাগর (বস্ন্যাক সি); এই নিয়ে ইউক্রেনের অবস্থান। কৃষিকাজের জন্য প্রচুর উর্বর জমিতে সমৃদ্ধ পূর্ব ইউরোপের এই দেশটিতে খ্রীষ্টের জন্মের সাড়ে চার হাজার বছর পূর্বে মানববসতির সন্ধান মেলে।
নবম শতকে 'সস্নাভিক' জনপদের কেন্দ্রবিন্দু ইউক্রেন দ্বাদশ শতাব্দীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তুকর্ী, তাতার, কসাকসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ইউক্রেন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। ইউক্রেন প্রাকৃতিক সম্পদের বিশাল ভান্ডার এবং অত্যনত্ম উর্বরা ভূমি হওয়ায় এঅঞ্চল নিয়ন্ত্রণের জন্য বিদেশী আক্রমণকারীরা ব্যাপক চেষ্টা চালিয়ে গেছে। ১৬৫৭ থেকে ১৬৮৬ সাল পর্যনত্ম ত্রিশবছর ধরে ইউক্রেনের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য রাশিয়ান, পোলিশ, তুকর্ী এবং কসাকদের মধ্যে যুদ্ধ বাধে। উনবিংশ শতাব্দীতে ইউক্রেনের একটি বড় অংশ রাশিয়ান সাম্রাজ্য এবং বাকি অংশ অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। রম্নশ বিপস্নবের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হলে ইউক্রেন ১৯২২ সালে ইউক্রেনিয়ান সোভিয়েত স্যোসালিস্ট রিপাবলিক নামে পরিচিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরম্ন হলে ১৯৪১ সালে হিটলারের নাৎসি বাহিনী ইউক্রেন দখল করে নেয়। যুদ্ধের সময় দেশটির অবকাঠামো মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞের সম্মুখীন হয়। প্রায় অর্ধকোটি ইউক্রেনিয়ান নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ হারান। জামর্ানরা ইউক্রেন থেকে প্রায় ১৫ লাখ ইহুদিকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করে। ১৯৪৪ সালে স্ট্যালিন হিটলারকে উৎখাতের জন্য প্রায় ২ ল তাতার সৈন্য সাইবেরিয়া এবং মধ্য এশিয়ায় নিযুক্ত করেন। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি এবং অশক্তির পরাজয় ইউক্রেনে ফের সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
১৯৮৮ সালে ইউক্রেনের বুদ্ধিজীবি মহল রাষ্ট্রীয় পুর্নগঠনের দাবীতে গণআন্দোলন আরম্ভ করেন। ১৯৯০ সালের ২১ জানুয়ারী প্রায় ৩ ল ইউক্রেনিয়ান স্বাধীনতা দাবী করে এক বিশাল মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করেন। ১৯৯১ সালের গণভোটে ইউক্রেনের স্বাধীনতার প ে৯০শতাংশ ভোট পড়ে। এসময় প্রায় আড়াই ল তাতার এবং তাদের অনুসারীরা ক্রিমিয়ায় ফিরে আসে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৪ আগস্ট ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
ইয়ানুকোভিচের উত্থান-পতন

১৯৯১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যনত্ম ইউক্রেনের ইতিহাসকে বলা যায় লিওনিদ ক্র্যাভচুক এবং লিওনিদ কুচমা-র শাসনামলের ইতিহাস। এই সময় ইউক্রেনের রাজনীতিতে পট পরিবর্তন শুরম্ন হয়। বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরও ইউক্রেনের রাজনীতিবিদেরা প্রতিবেশি রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতো। ১৯৯৬ সালে ইউক্রেনে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান গৃহীত হয় এবং রম্নবলের পরিবর্তে নতুন মুদ্রা রিভনিয়া প্রচলন করে।
২০০৪ সালে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আবিভর্ূত হন ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ এবং ভিক্টর ইউশচেঙ্কো। কুচমার আমলে প্রধানমন্ত্রী ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদারের বিষয়ে আশাবাদী ছিলেন। যদিও প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা ইউশচেঙ্কো ইউক্রেনের পশ্চিমাপন্থী নীতি অনুসরণের পপাতী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানে উচ্চকন্ঠ ছিলেন। তিনি ইয়ানুকোভিচের মস্কোপন্থার ব্যাপক সমালোচনা করেন। ২১ নবেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ইয়ানুকোভিচ খুব অল্প ব্যবধানে জয়লাভ করলেও ইউশচেঙ্কো নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখান করেন। এসময় চরম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়, রাজধানী কিয়েভসহ অন্যান্য শহরে শুরম্ন হয় গণআন্দোলন, হাজার হাজার বিােভকারী রাজপথে নেমে পড়ে প্রতিবাদ জানাতে। জনগণের এই স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলনের নামই 'অরেঞ্জ বিপস্নব'। ২৬ ডিসেম্বর ইউক্রেনের সুপ্রীম কোর্ট নির্বাচনী ফলাফল বাতিল ঘোষণা করলে পুনঃনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পুনঃনির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় ভিক্টর ইউশচেঙ্কো জয়ী হয়েছেন। ৫দিন পরে ইয়ানুকোভিচ পদত্যাগ করে তার মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেন। ২০০৫ সালের ২৩ জানুয়ারী ভিক্টর ইউশচেঙ্কোর রাষ্ট্রপতি পদে মতাগ্রহণের মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে ঐতিহাসিক অরেঞ্জ বিপস্নবের।
অরেঞ্জ বিপস্নবের পর থেকে ইউক্রেনে সোভিয়েত উত্তর নতুন জাতীয়তা ল্য করা যায়। দাবী উঠেছিল পরিবর্তনের। যদিও বর্তমান নির্বাচনের ফলাফল বলে দেয়, অরেঞ্জ বিপস্নবের জনপ্রিয়তা এখন আর নেই। বিপস্নবের নায়কদের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। তবে এটা সত্য যে অরেঞ্জ বিপস্নব ইউক্রেনের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে এবং বিপস্নবোত্তরকালে জাতীয়তাবাদী চেতনা পুনর্গঠিত হয়েছে।
২০০৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিদায়ী রাষ্ট্রপতি লিওনিদ কুচমার অকুন্ঠ সমর্থন পেয়েছিলেন ইয়ানুকোভিচ। রাশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভস্নাাদিমির পুতিনও সমর্থন যুগিয়েছিলেন তাকে। নির্বাচনের ফলাফলেও তার প্রতিফলন দেখা যায়। হওতো ইয়ানুকোভিচের অতিমাত্রায় রাশিয়াপন্থাই তার জন্য কাল হয়ে দাড়ায়। ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে থেকেও রাষ্ট্রপতি পদ ছাড়তে হয় তাকে। তবে এবার ইয়ানুকোভিচ একধরনের নিরপে ইমেজ তৈরি করতে চাচ্ছেন। ভারসাম্যনীতি গ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ রা করবেন বলে সমপ্রতি জানিয়েছেন তিনি। ইয়ানুকোভিচ আরও বলেছেন, ইউরোপীয়ান ইউনিয়নে অনর্ত্মভুক্ত হওয়াই হবে ইউক্রেনের কৌশলগত ল্য। ইউশচেঙ্কোর সময় দেশে যে চরম অর্থনৈতিক সংকট শুরম্ন হয়, তাকে নির্বাচনী প্রচারণায় কাজে লাগিয়েছেন ইয়ানুকোভিচ। তার রাজনৈতিক দল পার্টি অব দ্য রিজনস এই বলে প্রচারণা চালিয়েছে যে ইউক্রেনে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আইএমএফ থেকে কোটি কোটি ডলার ঋণ সাহায্য নিতে হয়েছে। ইউশচেঙ্কোর অতিমাত্রায় পশ্চিমঘেঁষা মনোভাব ইয়ানুকোভিচের জন্য সহায়কই হয়েছে। নির্বাচনে জয়ের েেত্র ইয়ানুকোভিচ দোনেতস্ক, খারকিভ, লুগানস্ক এবং ক্রিমিয়া অঞ্চলের ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছেন। ১৯৫০ সালের জুলাই মাসে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ইয়েনাকিয়েভা শহরের এক দরিদ্র পরিবারে ইয়ানুকোভিচের জন্ম। ছোটবেলা কাটে অত্যনত্ম দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে। তরম্নণ বয়সে দুইবার সহিংস অপরাধের জন্য জেল খাটেন। একটি কয়লাখনি শিল্পে পরিবহন অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরম্ন করেন ইয়ানুকোভিচ। সেখানের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক পর্যনত্ম পদোন্নতি পান। ১৯৯৭ সালে তিনি ইউক্রেনের দোনেতস্ক অঞ্চলের গবর্ণর নির্বাচিত হন। ২০০০ সালে অর্থনীতিতে ডক্টরেট করার ২ বছর পর তিনি প্রেসিডেন্ট কুচমার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। এসময় থেকেই ইয়ানুকোভিচের জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিসত্মার শুরম্ন হয়। তবে তিনি সমস্যায় পড়েন ভাষা নিয়ে। জন্মগতভাবে রম্নশভাষী ইয়ানুকোভিচ অনেক কষ্টে ইউক্রেনীয় ভাষা আয়ত্ত করেছেন, তবে এখনও খুব ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। দেশের অর্থনৈতিক পুর্নগঠনের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিমর্ূল করাকে প্রধান দায়িত্ব হিসেবে মনে করেন ইয়ানুকোভিচ। এজন্যই তার বলিষ্ঠ উচ্চারণ, আমি চাই দারিদ্যকে জয় করতে। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের হাত ধরে ইউক্রেন কতদূর যায় তা দেখার জন্য সবারই চোখ থাকবে পূর্ব ইউরোপের এই বিশাল দেশটির দিকে।

No comments

Powered by Blogger.