যে মৃত্যু সবাইকে কাঁদায় by লিটু খান

জন্মিলে মরিতে হয় এ কথা কারই অজানা নয়। মানুষ জন্মগ্রহণ করে, কালের অমোঘ নিয়মে আবার তাকে চলেও যেতে হয়। এদিক থেকে মানুষের জীবনে মৃত্যু স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। কিন্তু কারও কারও চলে যাওয়ার মেনে নেয়া যায় না। তাঁদের চলে যাওয়া আমাদের মাঝে সৃষ্টি করে গভীর শূন্যতার।
শ্রীনিবাস রামানুজ। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে যক্ষ্মায় ভুগে মারা যান এই অসামান্য প্রতিভাবান তরুণ। কত কিছুই না পৃথিবীকে দেয়ার বাকি ছিল রামানুজের। আধুনিক গণিত শাস্ত্রকে আরও কতই না সমৃদ্ধ করতে পারতেন এই ‘গণিতবিদদের গণিতবিদ’। বেঁচে থাকলে আইনস্টান গোছের বড় মাপের কেউ হতেন নিশ্চয়ই।
হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, কবি কিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্য এদের চলে যাওয়া সত্যিই অপূরণীয় ক্ষতি। এ শ্রেণীর মানুষের প্রস্থান সত্যি আমাদের কাঁদায়, হৃদয়কে করে ভারাক্রান্ত।
সম্প্রতি এই তালিকায় যুক্ত হলেন এ্যারন সোয়ার্স্টজ। ২৬ বছর বয়সী এই অসামান্য সম্ভাবনাময় তরুণের আত্মহত্যা কিছুতেই মেনে নেয়ার মতো নয়। মেনে নেয়নি গোটা বিশ্বের অবাধ তথ্য স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সচেতন মানুষরাও। তাঁর চলে যাওয়ায় বিশ্ব হারাল বিল গেটসের মতো কাউকে। বিল গেটসের সঙ্গে এ্যারনের তুলনার কারণ তিনিও কম্পিউটার প্রোগ্রামার, আইটি কর্মী। কিন্তু বড় হয়ে তিনি অন্তত বিল গেটস হতেন না। তিনি তাঁর প্রতিভাকে নিশ্চিতভাবেই কোটিপতি হওয়ার পথে সঁপে দিতেন না এ স্বীকারোক্তি তাঁর ঘনিষ্ঠ সতীর্থদেরই।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের জন্ম এ্যারন সোয়ার্স্টজের। বাবা রবার্ট ছিলেন সফটওয়্যার ব্যবসায়ী। অসম্ভব মেধাবী এ্যারস শৈশবেই বাবার কাছ থেকে নেন কম্পিউটার শিক্ষার হাতেখড়ি। ছেলেবেলা থেকে এই কম্পিউটার যন্ত্রটার সঙ্গে নিবিড় সখ্য এ্যারনের। কম্পিউটার শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর অগাধ জ্ঞানের পরিচয় তিনি অল্প বয়সেই দিতে শুরু করেন। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি একটি কম্পিউটার সফটওয়্যার গড়ে তুলতে সক্ষম হন। ১৩ বছর বয়সে এক প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন একটি অবাণিজ্যিক ওয়েবসাইট। আর এ জন্য আর্সডিজিটা পুরস্কার অর্জন করেছিলেন তিনি।
মাত্র ১৪ বছর বয়সেই এ্যারন আইটি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। ইন্টারনেটে ব্লগপোস্ট সঞ্চালনের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা আরএসএস গড়ে তোলার উদ্যোগে একই বছর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন এ্যারন।
এক পর্যায়ে পরিচয় ঘটে নামকরা অধ্যাপক লরেন্স লেসিগের সঙ্গে। তাঁর ইন্টারনেট সংস্থা ক্রিয়েটিভ কমনস তৈরিতেও এ্যারনের ছিল উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা। বর্তমানে ক্রিয়েটিভ কমনস পশ্চিমা আইটি জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত একটি সংস্থা হিসেবে পরিগণিত। এক পর্যায়ে অসম্ভব মেধাবী এই তরুণ পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েও এক বছরের মাথায় বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। তবে এ্যারনের অন্য অধ্যবসায় কিন্তু থেমে থাকেনি। ইতোমধ্যে বন্ধুদের নিয়ে এ্যারোন গড়ে তোলেন নিজের প্রতিষ্ঠা করা প্রথম সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইনফোগামি।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগভিত্তিক সংবাদ সংস্থা রেডিট বেশ সুপরিচিত। এটিও প্রতিষ্ঠা করেন এ্যারন সোয়ার্টজ। পরে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের বিরাট প্রকাশনা সংস্থা কনডি ন্যাস্ট কিনে নেয় রেডিট। প্রচুর অর্থ সমাগম হয় এ্যারনের হাতে। কিন্তু এতো কিছুর কোনটিই এ্যারন টাকার জন্য করেননি। করলে তাঁকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হতো না।
জ্ঞানের জগতে সাধারণ্যের বিনামূল্যে প্রবেশের অধিকার, সরকারের গোপনীয়তা নীতি অবসান এবং অবাধ তথ্য স্বাধীনতার জন্য যাঁরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন তাঁদের সামনের সারির এক যোদ্ধা এ্যারন সোয়ার্টজ। এ জন্যই মূলত রাজরোষ তথা যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের রোষের মুখে পড়েন ইন্টারনেট স্বাধীনতার এই লড়াকু সৈনিক।
এ্যারন মূলত ফ্রি ডেটা এ্যাকটিভিস্ট বা ইন্টারনেট ফ্রিডম এ্যাকটিভিস্ট হিসেবে সমধিক পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস তাঁর নামের আগে জুড়ে দিয়েছে পলিটিক্যাল এ্যাকটিভিস্ট অভিধা। ডেমোক্রেসি ওয়াচ-খ্যাত এমি গুডম্যান তাঁকে বলেন সোশাল জাস্টিস এ্যাকটিভিস্ট।
ইন্টারনেট ও অবাধ তথ্যের ওপর রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছিলেন এ্যারন। এ্যারন বিশ্বাস করেন তথ্যই ক্ষমতা। তথ্যই পারে মানুষকে সত্যিকারের স্বাধীনতা দিতে।
কিন্তু দেশে দেশে প্রচলিত সরকার কাঠামো জনগণকে তথ্য স্বাধীনতা দিতে নারাজ। ইন্টারনেটের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখতে শাসককুলের উঠে পড়ে লাগি অবস্থা। এর বিরুদ্ধেই মূলত সোচ্চার হয়েছিলেন এ্যারন। তাই হয়ত পলিটিকাল এ্যাকটিভিস্ট ভূষণ নিউইয়র্ক টাইমস সেঁটে দেয় এ্যারনের গায়ে।
২০০৮ সালের ঘটনা। এ্যারন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অনলাইন ডেটাবেস হ্যাক করে কোটি কোটি নথিপত্র নামিয়ে নেন। ওই ডেটাবেসে মূলত সেদেশের আদালতের নথিপত্র সংরক্ষিত থাকত। যে কেউ চাইলে ওই সব নথিপত্র ডাউনলোড করে দেখে নিতে পারত; অবশ্য টাকার বিনিময়ে। এখানেই আপত্তি এ্যারোনের। জনগণের করের টাকায় চলে আদালত। আর সে আদালতের নথিপত্র দেখতে জনগণকে কেন আবার অর্থ দিতে হবে। যথারীতি এ্যারনের বিরুদ্ধে ইনভেস্টিগেশন শুরু করে দেয় দেশটির কেন্দ্রিয় সংস্থা এফবিআই। কিন্তু এ্যারনের যুক্তির বিরুদ্ধে হার মানতে হয় প্রশাসনকে। তাঁর বিরুদ্ধে কোন মামলা দাড় করানো সম্ভব হয় না। ঝামেলামুক্ত হন এ্যারন। কর্তৃপক্ষ কিন্তু মনে রাখে এ্যারনকে, যাঁর মধ্যে তারা দেখতে পায় অন্য এক জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে।
২০১১ সালে আরও অপর একটি কাজ করে বসলেন এ্যারন। এবার তিনি হ্যাক করলেন জেস্টোর নাম একটি অনলাইন আর্কাইভ। এখানে মূলত বিশ্বের নামকরা সব পত্র-পত্রিকা এবং গবেষণা ও বিজ্ঞান সংক্রান্ত একাডেমিক জার্নাল সংরক্ষিত থাকে। এ্যারন এমআইটির কম্পিউটার সিস্টেমে ঢুকে প্রায় আধ কোটি ফাইল ডাউনলোড করে নেন। বিষয়টি ধরা পরে যায় জেস্টোর কর্তৃপক্ষে চোখে। এ্যারন স্বীকার করে নেন তিনি ওই ডেটাগুলো নামিয়ে নিয়েছেন ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার জন্য, বিনা পয়সায় সাধারণ মানুষ যাতে ওগুলো পডতে পারে। তবে এখনো তা তিনি ইন্টারনেটে ছাড়েন নি। এবার কিন্তু এমআইটি কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে ভুল করে নি। জেস্টোর কর্তৃপক্ষ মামলায় না গেলেও এমআইটি কর্তৃপক্ষ মামলা ঢুকে দেয় তাঁর বিরুদ্ধে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে ৩৫ থেকে ৫০ বছর জেল ও ৪০ লাখ ডলার জরিমানা হতে পারতো বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, আগামী ফেব্রুয়ারিতেই এই বিচার শুরু হওয়া কথা ছিলো। মামলার পর থেকে অবসাদ ও হতাশায় ভুগছিলেন এ্যারন। অবশেষে ১১ জানুয়ারি প্রতিভাবান এ যুবক বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। কে দায়ী এই জীবনের অপচর্য়ে জন্য? পরিবারের অভিযোগ, এটা আত্মহত্যা নয়, হত্যাকা-। মার্কিন বিচার ব্যবস্থাই এ্যারনকে এ পথ বেছে নিতে বাধ্য করে।
এ্যারন সোয়ার্স্টজের প্রয়াণে তাঁর পিতা-মাতা হারালেন সন্তানকে, মুক্তিকামী, অবাধ তথ্য স্বাধীনতায় বিশ্বাসীরা হারালেন তাঁদের এক সহযোদ্ধাকে আর বিশ্ব হারালো এক প্রতিভাবানকে, যিনি বিশ্বকে অনেক কিছু দিতে পারতেন।

No comments

Powered by Blogger.