সুঁইসুতার কাজ, বদলে যাচ্ছে ১৬শ’ প্রতিবন্ধী মেয়ের জীবন- প্রতিবন্ধী মেয়েদের ঘুরে দাঁড়ানো by তাহমিন হক ববি

নীলফামারী সদরের পঞ্চপুকুর ইউনিয়নের ষোল শ’ প্রতিবন্ধীর জীবন বদলে যেতে বসেছে। আজ তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তারা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। প্রতিবন্ধী মেয়েদের এমন স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার বাস্তব চিত্র এলাকায় মডেল হিসাবে আখ্যায়িত হয়েছে। সমাজে প্রায় প্রতিটি এলাকায় প্রতিবন্ধীর দেখা মিলবে ।


এরা যদিও আমাদেরই সন্তান ভাই কিংবা বোন তবুও এরা অত্যন্ত অবহেলিত । এদের পূর্ণাঙ্গ সামাজিক মর্যাদা কিংবা অধিকার এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। হয়নি ব্যাপক সচেনতার সৃষ্টি। এখনও অনেক পরিবার তাদের প্রতিবন্ধী সন্তানকে লুকিয়ে রাখে সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে কিংবা অজ্ঞতাবসত। কোন পরিবারে যদি প্রতিবন্ধী কোন সদস্য থাকে, তবে সেই পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার স¤পর্ক করতে এখনো অনেকেই দ্বিধা বোধ করে। অনেকেই অজ্ঞতার কারণে একে অভিশাপও ভাবে। কিন্তু প্রতিবন্ধিতা কোন অভিশাপের ফল নয়। নিছক আর দশটা রোগ কিংবা দুর্ঘটনার ফল এটি। তাই আমাদের উচিত হবে এ মিথ্যে কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসা। আমরা জানি প্রতিবন্ধী মানেই পরিবারের বোঝা। তার ওপর মেয়ে প্রতিবন্ধী হলে অভিভাবকদের মাথায় হাত। বিয়ের কথা ভাবাই যায় না। এক কথায় বলা যায় সাহায্য-সহযোগিতা আর করুণা নিয়েই তাঁর বেঁচে থাকা। সমাজের মানুষের সঙ্গে মনের ভাব প্রকাশ করা যেন এক স্বপ্ন। কিন্তু এসবের উর্ধে উঠে গেছে নীলফামারী সদরের পঞ্চপুকুর ইউনিয়নের ১ হাজার ৬শ‘ প্রতিবন্ধীর জীবন। বেশ কিছু সমাজসেবা ব্যক্তির সহযোগিতায় সংগঠিত হয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছে তারা। গত ৩ বছর ধরে সুঁই-সুতার কাজ করে নিজেদের আয় রোজগার করে জীবনে পরিবর্তনের হাওয়া এনে দিয়েছে। পঞ্চপুকুরের মিস্ত্রিপাড়া গ্রামের ৩শ’ সংগ্রামী প্রতিবন্ধীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গঠন করে ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন ফর অপটিমাম রিহেবিলিটেশন (ডোর) সমিতি। বাজারের খালি জায়গা ভাড়া নিয়ে নির্মাণ করে সমিতির ঘর। ভোরের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘরে একত্রিত হন তারা। গল্প-আড্ডা শেষে মাটিতে চট বিছিয়ে শুরু করে দেয় তাদের কর্মযজ্ঞ। কাজের পরিধি এক-একজনের এক-এক রকম। কেউ সুঁই-সুতা, কেউ সেলাই মেশিনে, কেউবা আবার কাপড় কাটা নিয়ে ব্যস্ত। এক মিনিটের জন্য সময় নেই কারও। নিজেদের পুঁজি দিয়ে শহর থেকে কাপড় কিনে তৈরি করেন নানান পোশাক। সেই পোশাক বাজারে বিক্রি করে চলছে তাদের সংসার। সেলাই প্রশিক্ষণেও অন্যের দ্বারস্থ নন তারা। তাদের প্রশিক্ষক হিসেবে রয়েছেন প্রতিবন্ধী রজিফা বেগম। আত্মপ্রত্যয়ী প্রতিবন্ধীদের এ খবর ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন স্থানে। খবর শুনে ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের আরও ১ হাজার ৩শ’ প্রতিবন্ধী ছুটে আসেন সমিতির সদস্য হওয়ার জন্য। এখন সমিতিতে মোট সদস্য সংখ্যা ১ হাজার ৬শ’। বাক, শারীরিকসহ প্রায় সব ধরনের প্রতিবন্ধীই রয়েছেন এ লড়াইয়ে। সমিতির সভাপতি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী রাশেদুল ইসলাম জানান, প্রতিবন্ধীরাও সমাজের আট-দশজন মানুষের মতোই রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ। কিন্তু প্রকৃতির খেয়ালে তারা আজ প্রতিবন্ধী। শুধু প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে সমাজ ও পরিবার থেকে তারা বিতাড়িত হন। সবাই তাদের নিয়ে উপহাস করেন। করুণা আর দয়া ছাড়া কোনো সহযোগিতাই পান না তারা। তবে এসব থেকে মুক্তি পেতে সংগ্রামে নেমেছেন তারা। এ এক অন্য সংগ্রাম, বাঁচার সংগ্রাম। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে সবাই আজ সংগঠিত। পঞ্চপুকুর ইউনিয়নের প্রতিবন্ধীদের এ বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন এলাকাবাসী। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ অনেকেই ছুটে এসেছেন তাদের পাশে। ইতোমধ্যে, উত্তরাশশী গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক নাসির উদ্দিন শাহ ফকীর ৩ শতক জমি প্রতিবন্ধীদের সমিতির নামে দান করেছেন। শুধু শিক্ষক নাসির উদ্দিন নন, এলাকার পল্লী চিকিৎসক মাহফুজার রহমান সহমর্মিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন তাদের পাশে। বিনাপয়সায় তাদের স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন তিনি।
এছাড়াও জেলা শহরের কয়েকজন গুণী মানুষও তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বলে জানান তারা। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ওবায়দুর রহমান প্রতিবন্ধীদের প্রশংসা করে বলেন, ‘তারা সামাজিকভাবে শুধু বেঁচে থাকা নয়, উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছেন। আমিও তাদের পাশে আছি!’

No comments

Powered by Blogger.