মাছ রপ্তানি বন্ধ হলো

নদীতে ইলিশের আকাল চলছিল। অল্প যা কিছু ধরা পড়ছিল তাও চলে যাচ্ছিল পাশের দেশ ভারতে। ফলে ঢাকার বাজারে বড় ইলিশের কেজিপ্রতি দাম উঠেছিল দেড় হাজার টাকা। ইলিশের পাশাপাশি মিঠাপানির অন্যান্য মাছও রপ্তানি হয়ে যাচ্ছে ভারতসহ ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। ফলে দেশের বাজারে মাছের দাম আকাশে উঠে গেছে।


অবশেষে মাছের দাম দেশের মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে সাড়া দিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গতকাল ইলিশসহ সব ধরনের কাঁচা মাছ রপ্তানি বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় এর আগে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেলের পক্ষ থেকে রমজান উপলক্ষে মাছ রপ্তানি বন্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়। গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে মাছ রপ্তানি বন্ধের কথা জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, 'পবিত্র রমজান মাসে বাজারে চাহিদা মোতাবেক মাছের সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকার পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত চিংড়ি ব্যতীত ইলিশসহ সব প্রকার কাঁচা মাছ রপ্তানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।' তবে জানা গেছে, রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত কেবল মিঠা পানির মাছের ক্ষেত্রে কার্যকর হবে। সামুদ্রিক মাছ আগের মতই রপ্তানি করা যাবে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মিঠা পানির প্রায় সব প্রজাতির মাছ রপ্তানি হয়। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে এসব মাছ রপ্তানি হয় প্রক্রিয়াজাত করে। কিন্তু ভারতে রপ্তানি হচ্ছে সরাসরি কাঁচা মাছ। বেশি উৎপাদনকারী এলাকা খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, জামালপুর, ময়মনসিংহ থেকে ভারতে মাছ চলে যাচ্ছে বৈধ ও অবৈধ পথে। ভারতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ায় মাছ রপ্তানি আরো বেড়ে গেছে। সরবরাহ কম থাকার মধ্যেও রপ্তানির কারণে দেশের বাজারে মাছের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। জলাশয়ের কোনো মাছই এখন ৪০০ টাকা কেজির নিচে পাওয়া যাচ্ছে না।
মাছ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে এফবিসিসিআইয়ের দ্রব্যমূল্য মনিটরিং কমিটির আহ্বায়ক হেলাল উদ্দিন বলেন, 'বেগুন ও কাঁচা মরিচ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তের মতো এ সিদ্ধান্তও বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। রমজানের বাকি দিনগুলোতে মানুষ কম দামে মাছ কিনতে পারবে।'
কারওয়ান বাজার পাঁচতারা মৎস্য আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, 'এখন মাছ সরবরাহ খুব কম। ইলিশ তেমন মিলছে না। রপ্তানি বন্ধ হলে বাজারে সরবরাহ আগের চেয়ে বাড়বে। এতে দামও কমার সম্ভাবনা আছে।'
আমাদের বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, গতকাল দুপুর থেকে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। বেনাপোল বন্দরে মৎস্য মান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের ইন্সপেক্টর আমিনুর রহমান জানান, রমজানে বাজার সহনীয় রাখার জন্য সরকার এক প্রজ্ঞাপনে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ভারতে রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। ফলে আজ দুপুর থেকে এ বন্দর দিয়ে ভারতে মাছ রপ্তানি হচ্ছে না। তিনি জানান, রপ্তানিমুখী ইলিশ ও সাদা মাছবোঝাই অর্ধ শতাধিক ট্রাক ফেরত পাঠানো হয়েছে বন্দর থেকে।
প্রতিশোধ নিতে পারে পশ্চিমবঙ্গ
আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি জানান, ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করার প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গ থেকে রুই-কাতলা-রূপচাঁদা মাছ রপ্তানি বন্ধ করার চিন্তাভাবনা করেছে রাজ্যের ফিশ ইমপোর্টার অ্যান্ড এঙ্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশন। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তগুলোতে বাংলাদেশ সরকারের নিষেধাজ্ঞার কপি এসে পৌঁছায়। এরপর সীমান্তের ওপারে থাকা অপেক্ষমাণ ইলিশভর্তি ট্রাকগুলো উল্টো পথে রওনা দেয়। কোটি টাকার চালান নষ্ট হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের মাছ ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ। বাংলাদেশ সরকারের ইলিশসহ সব মাছ রমজান মাসে রপ্তানি না করার সিদ্ধান্তের খবর সংবাদমাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গেও ছড়িয়ে পড়ে। এরপর মাছ ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু করেন এবং আগামী দু-এক দিনের মধ্যে জরুরি বৈঠকে বসারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
ফিশ ইমপোর্টার অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অতুল চন্দ্র দাস গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে জানান, রমজান মাসে বাংলাদেশে এমনিতে মাছ কম চলে। ফলে চাহিদার কথা বলে আদতে একটি মহল পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। সরকারের সিদ্ধান্ত এরই ফল।
অতুল প্রায় হুমকি দিয়েই বলেন, 'ইলিশ বাঙালির সেন্টিমেন্ট। তা যদি না আসে তবে আমরাও রুই-কাতলা-রূপচাঁদা মাছ বাংলাদেশে রপ্তানি করব কি না, সেটি এখন ভাবতে হবে আমাদের।'
বাংলাদেশের বাজার ফাঁকা হলেও গতকাল মঙ্গলবার ৪৮ টন ইলিশ ঢুকেছে পশ্চিমবঙ্গে। সকালে পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে ১২টি ট্রাকে করে আসে এ ইলিশ। স্থানীয় আমদানিকারকরা জানান, প্রতিটি ইলিশ আকারে ৬০০ থেকে এক কেজি ওজনের। কলকাতার বাজারে প্রতি কেজি ইলিশ মিলছে ৫০০ টাকায়। কলকাতার ইলিশ আমদানিকারকদের হিসাব অনুযায়ী গত কয়েক দিনে পদ্মা ও মেঘনার প্রায় ১০০ টন ইলিশ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বাজারে ঢুকেছে।

No comments

Powered by Blogger.