ভুট্টোকে ফাঁসি দেবেন না- কাবা’য় দাঁড়িয়ে জিয়াউল হক বলেছিলেন

সুপ্রীমকোর্টের রায় অনুযায়ী ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলানো হলে অফিসারদের প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে তা নিরূপণ করার জন্য জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে তাঁর কোর কমান্ডারদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমি তখন ওকারায় চতুর্দশ ডিভিশনের কমান্ডার ছিলাম।


মুলতানে অনুষ্ঠিত সেই বৈঠকটিতে যোগদানের জন্য আমাকে ডাকা হয়েছিল। ঐ বিষয়ে মতামত দিতে গিয়ে আমি বলি : ‘ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলানো অবিবেচনাপ্রসূত হবে। কারণ এতে করে অতি গুরুতর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে যা দূর করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাঁকে নির্বাসনে পাঠানোই বরং শ্রেয়। আমার সৈনিকদের প্রতিক্রিয়া কি হবে সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। কারণ হিংসাশ্রয়ী জনতার মোকাবেলা করাই হবে আমার কোম্পানি ও ব্যাটালিয়ন কমান্ডারদের দায়িত্ব এবং নিজেদের জ্ঞাতি গুষ্ঠির ওপর গুলি চালানো তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে যেমন হয়েছিল ১৯৭৭ সালে লাহোরে। আমার সৈনিকদের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার ট্রেনিং দেয়া হয়েছে, নিজ জনগণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নয়।’
কোর কমান্ডারের মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল। তিনি বৈঠকটা বাতিল করে দেন এবং তাঁর চীফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার (বর্তমানে জেনারেল) হামিদ গুলকে বলেন : ‘আমি আমার ফরমেশনে এই অলিসারকে চাই না। চীফের সঙ্গে টেলিফোনের সংযোগ করে দিন। আমি ওকে কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করব।’ ব্রিগেডিয়ার গুল অনুরোধের সুরে বলেন : ‘স্যার আপনি জেনারেল বেগের মতামত জানতে চেয়েছিলেন এবং তিনি তাঁর অকপট অভিমত দিয়েছেন। তাঁকে কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়া এ মুহূর্তে হয়ত ঠিক হবে না। আপনি চীফকে তাঁর এই অভিমতটা জানিয়ে দিতে পারেন এবং তিনিই যা করার ঠিক করুন।’ কোর কমান্ডার খানিকক্ষণ কি ভাবলেন। তারপর বললেন : ‘ঠিক আছে। রিপোর্ট তৈরি করুন।’
আমি ভাবছিলাম জেনারেল জিয়া যে পদক্ষেপটা বেশি ভাল হতো সেটা বেছে নেননি কেন অর্থাৎ জনগণের এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অনেকের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ভুট্টোকে নির্বাসনে পাঠাননি কেন। সেটা কি তাঁর সেই সাহস ছিল না বলে? নাকি সেটা সুবিধাবাদের বশবর্তী হয়ে কিংবা কিছু বাধ্যবাধকতার কারণে অমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? কারণ যাই থাক ব্যাপারটা আমার বোধগম্য ছিল না।
পরবর্তী পর্যায়ে ভুট্টোকে ফাঁসিতে জুলানো হয়েছিল। এরপর রাজনীতিতে একের পর এক টালমাটাল অধ্যায় যোগ হয় যা গণতন্ত্রের চেহারাকে কালিমালিপ্ত করে ফেলে। ভুট্টোকে মেরে ফেলা না হলে বেনজীর আজ বেঁচে থাকতেন এবং পাকিস্তানী জাতি আজ যে বিপথগামী উত্তরাধিকারের শিকার হয়েছে তা হতো না। তবে ২০০৯ সালে প্রবীণ কূটনীতিক ড. এসএম কোরেশীর একটা কলাম পড়ে আমার উদ্বেগ আরও গভীরতর রূপ পরিগ্রহ করে। ইনি লিখেছিলেন : ‘ভুট্টোকে ফাঁসি দেয়ার বছর দু’য়েক পর জেনারেল জিয়া ইয়াসির আরাফাতকে শান্ত করার জন্য আমাকে তাঁর কাছে পাঠান। কারণ ভুট্টোর ফাঁসি হওয়ায় তিনি অত্যন্ত রেগে গিয়েছিলেন। আমি আরাফাতের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে বলেন, জেনারেল জিয়া খানা-ই-কাবার ভিতরে বাদশাহ খালেদ ও আমাকে কথা দিয়েছিলেন যে তিনি ভুট্টোকে ফাঁসি দেবেন না। কিন্তু তিনি কথার বরখেলাপ করে ক্ষমার অযোগ্য পাপ করেছেন।’ নিঃসন্দেহে জেনারেল জিয়া আল্লাহকে অগ্রাহ্য করে অভিশাপ কুড়িয়েছেন। সুরা আল-আনামে বলা আছে : ‘এরূপে আমি প্রত্যেক জনপদে তথাকার অপরাধীদের প্রধানদের সেখানে চক্রান্ত করার অবকাশ দিয়েছি। কিন্তু তাহারা কেবল নিজেদের বিরুদ্ধেই চক্রান্ত করে, অথচ তাহারা উপলব্ধি করে না।’ (সুরা আল-আনাম ১২৩)
অবশ্য তিন দশকেরও বেশি সময় পর এই দূষিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার গভীর থেকে গণতন্ত্রের সংশোধিত প্রক্রিয়ার আবির্ভাব ঘটছে। দুই প্রধান রাজনৈতিক দল পিপিপি ও পিএমএলএন এখন গণতন্ত্র সনদের মর্মবাণী পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তারা নির্বাচন কমিশনের প্রধান হিসেবে একজন অবিতর্কিত ব্যক্তিকে নিয়োগদানে সফল হয়েছে। পরবর্তী সর্বোত্তম পদক্ষেপটি হবে সংবিধানের ১৮তম সংশোধনী অনুযায়ী একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা। উদীয়মান ঐকমত্যের সুফলগুলো নিতান্তই উৎসাহব্যঞ্জক।
সাধারণ নির্বাচন নির্ধারিত সময়ের আগে না হলেও যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে। আশা করা যায় যে আগামী দিনের বিপুল সংখ্যক নির্বাচিত প্রতিনিধি দেশ পরিচালনায় অধিকতর যোগ্যতার পরিচয় দেবেন। এভাবে ব্যবস্থাটি এক নতুন জীবন ও ধারাবাহিকতা লাভ করবে যা কিনা এক বলিষ্ঠ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আবির্ভারের জন্য অপরিহার্য। আমেরিকা, সেনাবাহিনী, বিচারবিভাগ ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের নিয়ে গড়ে ওঠা ‘অশুভ শক্তির জোট’ এর ফলে ব্যাকফুটে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ৫০ বছরে এই অশুভ শক্তি গণতন্ত্রের অনেক ক্ষতি করেছে। আমাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ নিঃশোষিত করে দিয়েছে। এখন অবশ্য এরা পিছু হটছে।
২০০৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী জেনারেল পারভেজ মোশারফের নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে গণতন্ত্রের ওপর তাদের পরিপূর্ণ বিশ্বাস ব্যক্ত করেছে। এবং এভাবে ‘জনগণের ইচ্ছার মূর্তপ্রতীক সংবিধানকে’ সমুন্নত রেখেছে। ২০০৯ সালের ৩১ জুলাই বিচার বিভাগ রায় দিয়েছে যে তারা আর কখনই সামরিক শাসন সমর্থন করবে না এবং বিপথগামীদের আঘাত থেকে নিজ স্বাধীনতা রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর থাকবে। আমেরিকানরা ‘সরকার পরিবর্তনের’ পুরনো খেলায় মেতে উঠতে অসহায়বোধ করছে। এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে সম্প্রীতি গড়ে উঠেছে তা সংবিধান সমুন্নত রাখার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে। গণতন্ত্রের দিক থেকে এটাই হলো সর্বোত্তম প্রতিশোধ।’
দুঃখ-বেদনা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার গভীরতা থেকে গণতন্ত্র ও এর আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া ধারণ করার এক নতুন ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটছে। এটাই হলো গণতন্ত্রের প্রতিশোধ এবং পাকিস্তানের নির্যাতিতদের জন্য এটাই হলো দিগন্তে আশার আলো।
অনুবাদ : এনামুল হক

No comments

Powered by Blogger.