খালেদাসহ সিনিয়র নেতাদের বক্তব্য রাজনৈতিক কৌশল- ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের কর্মপরিকল্পনা নেই বিএনপির by শরীফুল ইসলাম

আসন্ন ঈদের পর সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলনের ব্যাপারে কোন কর্মপরিকল্পনা নেই বিএনপির। তবে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতারা ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের পক্ষে যে বক্তব্য রাখছেন তা শুধুই রাজনৈতিক কৌশল।


এর মাধ্যমে একদিকে সরকারকে চাপে রাখা ও অন্যদিকে দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখার কৌশল নিয়েছে দলটি।
সূত্র জানায়, এখনও বিএনপি ঠিকমতো নিজের ঘরই গোছাতে পারেনি। ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে অন্তত ২০ জেলায় কমিটি নেই। ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে অধিকাংশই চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে। কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে ঝুলছে একাধিক মামলা। এ ছাড়া কেন্দ্র থেকে শুরু করে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনেও জোরালো কোন পদক্ষেপ নেই। এ কারণে দলের সর্বস্তরে চলছে স্থবিরতা। তাই এ পরিস্থিতিতে সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলন করার মতো শক্তি ও সামর্থ্য কতটুকু আছে তা-ই এখন বিবেচ্য বিষয়। মুখে কঠোর আন্দোলনের কথা বলা হলেও বাস্তবে ঈদের পরই তা শুরু হচ্ছে না। তবে ঈদের পর দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বিভিন্ন জেলায় সাংগঠনিক সফরে গিয়ে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির কৌশল নেবেন।
মহাজোট সরকারের আমলে বিএনপি ১০ দফা হরতাল পালন করেছে। কিন্তু সাংগঠনিক দুর্বলতা ও সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে কোন হরতালই কার্যত সফলভাবে পালন করতে পারেনি বিএনপি। সর্বপ্রথম ২০১০ সালের ২৭ জুন সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে বিএনপি। এরপর সে বছর ১৪ নবেম্বর দ্বিতীয়, ৩০ নবেম্বর তৃতীয় , গতবছর ৭ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ, পঞ্চম হরতাল ৫ ও ৬ জুন টানা ৩০ ঘণ্টাব্যাপী, ষষ্ঠ হরতাল ৬ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৮ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত টানা ৪৮ ঘণ্টাব্যাপী, ৭ম হরতাল ২২ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। গত বছর ৩ ডিসেম্বর ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দুইভাগ করার প্রতিবাদে শুধুমাত্র ঢাকায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। নবম দফায় দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার প্রতিবাদে গত ২২, ২৩ ও ২৪ এপ্রিল সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে বিএনপি। একই দাবিতে সর্বশেষ ২৯ ও ৩০ এপ্রিল হরতাল করেছে বিএনপি। পরবর্তী কঠোর আন্দোলনের ব্যাপারে দলের হাইকমান্ড আগের কর্মসূচী পালনের কথা অবশ্যই স্মরণ করবেন বলে দলের নেতাকর্মীরা মনে করছেন।
উল্লেখ্য, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ দলের নেতারা ইদানীং কথায় কথায় ঈদের পর সরকার পতনের কঠোর কর্মসূচী দেয়া হবে বলে জোর গলায় বক্তব্য দিচ্ছেন। ২৯ জুলাই গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে এলডিপি আয়োজিত ইফতার পার্টিতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ঈদের পর সরকার পতনের আন্দোলন কর্মসূচী দেয়া হবে। এ কর্মসূচী সফল করতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। দেশের গণতন্ত্র রক্ষা ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতেই এ আন্দোলন করা হবে। ২৮ জুলাই যুবদলের সদ্যকারামুক্ত নেতাদের নিয়ে জিয়ার মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি না মানলে ঈদের পর নতুন মাত্রায় কঠোর আন্দোলনে যাবে বিএনপি। যে আন্দোলন ঠেকানোর ক্ষমতা সরকারের থাকবে না। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই এ সরকারের পতন ঘটিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে।
গত বছর ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর বিএনপি তাদের সমমনা দলগুলোকে নিয়ে রাজপথে দুর্বার আন্দোলন করে সরকার পতনের হুঙ্কার দিতে থাকে। কিন্তু বেশ ক‘টি হরতালসহ বছরব্যাপী আন্দোলন কর্মসূচীর কোনটিই কার্যত সাধারণ মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলতে পারেনি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট আয়োজিত ১১ জুনের গণসমাবেশ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচী দেয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বাস্তবতার আলোকে খালেদা জিয়া গতানুগতিক ৫ দিনের বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল কর্মসূচী ঘোষণা করে আগামী ঈদের পর হরতাল, অবরোধ ও অবস্থান কর্মসূচীসহ আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচী দেয়ার কথা জানান। কিন্তু এটাও খালেদা জিয়ার একটি কৌশল ছিল বলে জানা যায়। কারণ, কঠোর আন্দোলন দিয়ে তা সফল করতে না পারলে নাজুক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে এমন আশঙ্কা থেকেই তিনি কৌশলে তা এড়িয়ে গিয়ে স্বাভাবিক আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করেন।
এদিকে কঠোর আন্দোলন করার ব্যাপারে ১৮ দলীয় জোটে বিএনপির শরিক অন্য দলগুলোর কাছ থেকেই তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না বলে সূত্র জানিয়েছে। তবে এসব দলের সিনিয়র নেতারা যখন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে কোন বৈঠকে মিলিত হন তখন সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলনে শরিক হওয়ার মৌখিক আশ্বাস ঠিকই দিয়ে থাকেন। কিন্তু বিগত কয়েকটি আন্দোলনের আগে শরিক দলগুলো এমন আশ্বাস দিয়েও শেষ পর্যন্ত মাঠে না নামায় বিএনপি শীর্ষনেতারা ক্ষ্ব্ধু হয়েছেন। তাই ভবিষ্যতের কোন আন্দোলনে সেই শরিক দলগুলোর আশ্বাসের ওপর বিএনপি আস্থা রাখতে পারছে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, ঈদের পর সরকারবিরোধী কি আন্দোলন কর্মসূচী দেয়া হবে তা নিয়ে এখনও কোন আলোচনা হয়নি। এ নিয়ে আমরা এখনও বসিনি। তবে কোন সময় কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তার ওপর আন্দোলন কর্মসূচী নির্ভর করবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, ঈদের পর আমাদের আন্দোলন কর্মসূচী কি হবে তা সরকারের মনোভাবের ওপর নির্ভর করবে। সরকার যদি সংলাপের আয়োজন না করে এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা না করে তখনই চূড়ান্ত আন্দোলন হবে। আর এ দেশে কঠোর আন্দোলন বলতে যা বুঝায় তাই অর্থাৎ হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভসহ বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচী দেয়া হতে পারে। তবে আন্দোলন কর্মসূচী এখনও ঠিক করা হয়নি। ঈদের পর দলীয় ফোরামে আলোচনা করে আন্দোলন কর্মসূচী ঠিক করা হবে।
বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, ঈদের পর সরকারবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচী নিয়ে দলীয় ফোরামে এখনও কোন কথা হয়নি। তবে যখন আন্দোলন কর্মসূচী দেয়া হবে তখন সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে জানানো হবে।

No comments

Powered by Blogger.