গুলশানের ভেতর-বাহির-১-বাণিজ্যের চাপে চিঁড়েচ্যাপ্টা 'আদর্শ আবাসিক এলাকা' by আপেল মাহমুদ

গুলশান-২ নম্বর গোল চত্বর। চারপাশে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সারি সারি স্কাইস্ক্র্যাপার (সুউচ্চ ইমারত)। মুহূর্তের ভ্রম হতে পারে, কোনো বিদেশি ব্যস্ততম বাণিজ্যিক নগরীর প্রাণকেন্দ্র নয় তো! বাস্তবে ফিরলেই দেখা যাবে এটা বাংলাদেশের রাজধানীর সেই অভিজাত আবাসিক এলাকা, যা ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে গেছে রমরমা বাণিজ্যিক কেন্দ্রে।


গুলশান-২ নম্বর চত্বরের একদিকে ১৫ তলা ল্যান্ডমার্ক বিপণিবিতান, অন্যদিকে ১৮ তলা ল্যান্ডভিউ ভবন, এর পাশেই পাঁচতারা ওয়েস্টিন হোটেল। চত্বরের পশ্চিম পাশে নির্মাণাধীন ৩০ তলা ডরীন টাওয়ার। এসব ভবনের ধার ঘেঁষে একটি-দুটি নয়, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে এমন আরো অনেক চোখ ধাঁধানো বহুতল ভবন। একটি ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকা ছাড়া এটিকে অন্য কিছু ভাবার উপায় নেই। অথচ একসময় এই স্থানটিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল রাজধানীতে একটি শান্ত, স্নিগ্ধ, অভিজাত ও আদর্শ আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে। সেসব আজ অতীতের কথা। গুলশান রাতদিন ব্যস্ত থাকে নানা বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের আনাগোনায় দুঃসহ যানজট লেগে থাকে এই এলাকায়। প্রায়ই দীর্ঘ সময় ধরে আটকা পড়ে থাকে অসংখ্য যানবাহন। এমনকি গভীর রাতেও তা থেকে পরিত্রাণ নেই মানুষের।
এভাবে কূটনীতিকপাড়া হিসেবে খ্যাত গুলশান তার আবাসিক চরিত্র হারিয়ে রমরমা বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত হয়েছে। একসময় রাজধানীর ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা, অফিস-আদালতের মূল কেন্দ্র ছিল মতিঝিল-দিলকুশা এলাকা। নামিদামি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগেরই প্রধান কার্যালয় ছিল সেখানে। কিন্তু সেই দৃশ্যপটে বদল ঘটেছে কয়েক বছর ধরে। এর স্থান দখল করে নিয়েছে গুলশানের মতো আরো কয়েকটি আবাসিক এলাকা। এমনকি বিদেশিরাও এখন গুলশানকে বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে গণ্য করছেন। অনেক দিন থেকেই দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী, এনজিও মালিক, সংস্থাপ্রধানদের করপোরেট অফিসের এক নম্বর পছন্দের জায়গা গুলশান।
অধিকাংশ বিদেশি দূতাবাস গুলশানে গড়ে ওঠার কারণে বিদেশিদের কাছে এই এলাকার গুরুত্ব অনেক বেশি। একই সঙ্গে বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেল, গেস্ট হাউস, গার্মেন্ট, বায়িং হাউস, বিদেশি বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান, ট্রাভেল এজেন্সি, জনশক্তি রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠান, বিপণিবিতান, রেস্তোরাঁ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, হাসপাতালসহ আরো বহু প্রতিষ্ঠান মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেছে এখানে। কিছু আবাসিক ভবন এখনো আছে 'কোণঠাসা' অবস্থায়। গুলশানের ৫৫ নম্বর সড়কের বাসিন্দা শেখ হবিবুর রহমান বলেন, বাণিজ্যিকীকরণের চাপে দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। আবাসিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে গুলশানের বহু পুরনো বাসিন্দা এখন অন্যত্র বসবাস করছেন।
গুলশানের মূল সড়ক হলো গুলশান এভিনিউ। উত্তর-দক্ষিণমুখী এই এভিনিউয়ের ১ নম্বর সড়ক থেকে ১৪০ নম্বর সড়ক পর্যন্ত যেসব ভবন রয়েছে তার শতকরা ৯৯ ভাগই বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ রাজউক কিংবা ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) খাতাপত্রে কেবল ১ থেকে ২ নম্বর গোল চত্বর পর্যন্ত এভিনিউ এলাকাকে অনাবাসিক ঘোষণা করা হয়েছে। কাগজে-কলমে গুলশানের ১ নম্বর সড়ক থেকে ১ নম্বর গোল চত্বর এবং ২ নম্বর গোল চত্বর থেকে ইউনাইটেড হাসপাতাল পর্যন্ত এখনো আবাসিক এলাকা। কিন্তু বাস্তবে পুরো এলাকাই বর্তমানে বাণিজ্যিকীকরণের কবলে। এটাকে দুর্ভাগ্যজনক আখ্যা দিয়ে গুলশান এলাকার সাবেক এমপি (বর্তমানে ঢাকা-১০ আসনের এমপি) এ কে এম রহমত উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, পাকিস্তান আমলে তৎকালীন ডিআইটির চেয়ারম্যান জি এ মাদানী গুলশানে অভিজাত ব্যক্তিদের জন্য একটি আদর্শ উপশহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন যেখানে গাছপালা ঘেরা শুধু বাংলো টাইপের দোতলা ভবন থাকবে। সে লক্ষ্যেই প্লট বরাদ্দ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু স্বপ্নের সেই গুলশানের দেখা কখনো মেলেনি।
ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গুলশানের দোতলা পুরনো বাড়িগুলো ভেঙে বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। সেগুলোতে অসংখ্য গাড়ি আনাগোনা করলেও পার্কিং জোনে রাখা যায় মাত্র ৮-১০টি। বাকি সব গাড়ি রাস্তায় পার্কিং করা হয়। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের গাড়ি হওয়ায় এগুলোর বিরুদ্ধে সহজে ব্যবস্থা নিতে পারে না দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ। গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার (ট্রাফিক) রুহুল আমিন বলেন, বড় বড় মার্কেট, অ্যাপার্টমেন্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা গাড়ি যত্রতত্র পার্কিং করার কারণে গুলশানে এ নিয়ে ব্যাপক সমস্যা সৃষ্টি হয়।
গুলশানে বসবাসরতদের সবচেয়ে বড় সংগঠন হলো গুলশান সোসাইটি। তারা এলাকার বিভিন্ন সমস্যা নিরসন ও উন্নয়নের ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়ে থাকে। তারা রাজউক ও ডিসিসিকে চিঠি দিয়ে বিভিন্ন সমস্যার কথা অবহিত করে। এর আগে সোসাইটির পক্ষ থেকে গুলশান এলাকাকে ছয়টি জোনে ভাগ করে সেখানে অবৈধ ভবন, বাণিজ্যিক স্থাপনা, পার্কিং ছাড়া নির্মিত বাড়ি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার একটি তালিকা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া হয়। তাতে কোনো কাজ হয়নি বলে সোসাইটির একাধিক সদস্য ক্ষোভের সঙ্গে জানান।
জেলা প্রশাসন ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের নিবন্ধন শাখা সূত্রে জানা যায়, গুলশান এলাকার কোনো গেস্ট হাউস কর্তৃপক্ষই তাদের কাছ থেকে নিবন্ধন নেয়নি। স্থানীয় থানা-পুলিশের সঙ্গে একটি অলিখিত চুক্তির মাধ্যমে এগুলো পরিচালনা করা হয়।
এ অভিযোগ অস্বীকার করে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, গুলশানে তাঁর যোগদানের আগে থেকেই গেস্ট হাউসগুলো গড়ে উঠেছে। এসব গেস্ট হাউসের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এসব গেস্ট হাউসে অধিকাংশ সময়ই বিদেশি অতিথি থাকেন।
তিনি বলেন, গুলশানের কোনো গেস্ট হাউসেরই বৈধ কাগজপত্র নেই। তবে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড দেখার দায়িত্ব শুধু থানা-পুলিশের নয়; পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ, ডিসিসি, রাজউক ও পরিবেশ অধিদপ্তরেরও রয়েছে।
গুলশানবাসীর সবচেয়ে বড় অভিযোগ কয়েকটি বিদেশি দূতাবাসের বিরুদ্ধে। শতাধিক দেশের দূতাবাস রয়েছে এ এলাকায়, যার জন্য গুলশানকে কূটনৈতিকপাড়া বলা হয়। বিশাল এলাকাজুড়ে দূতাবাসগুলো নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার নামে ফুটপাতের ওপর গার্ডরুম থেকে শুরু করে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ এবং বড় বড় ফুলের টব বসানোর ফলে পথচারীরা সে ফুটপাত ব্যবহার করতে পারছে না।
৮৩ নম্বর সড়কে অবস্থিত একটি দূতাবাসের সামনে ফুটপাত শুধু দখলই হয়নি, সেখানে অসংখ্য বিদেশি গাছের সঙ্গে বটগাছ পর্যন্ত লাগানো হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা আবু জুনায়েদ আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ফুটপাত দখলের কারণে এলাকাবাসীকে রাস্তার মাঝ দিয়ে হাঁটতে হয়। তা ছাড়া প্রতিদিন শত শত মানুষ এখানকার দূতাবাসে বিভিন্ন কাজে আসেন। তাঁদের গাড়িগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কের ওপর পার্কিং করা থাকে। ফলে এলাকায় যানজট লেগেই থাকে। বিদেশি দূতাবাস হওয়ায় এলাকাবাসী কোনো প্রতিবাদও করতে পারে না। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে দূতাবাসের নিরাপত্তার কথা বলে হয়রানি করা হয় বলেও জানান অনেকে।
৯ নম্বর সড়কের বাসিন্দা এরফান গাজী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই গুলশানকে আবাসিক এলাকা হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে। কোনো কাজ হয়নি। সর্বোচ্চ আদালতে একাধিকবার রিট করেও ফল পাননি বলে তিনি জানান।

No comments

Powered by Blogger.