যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধান রোপণের যুগে দেশ-১৫০ একর জমিতে চাষে সাফল্য by কাওসার রহমান

যান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমন ধানের চারা উৎপাদন ও রোপণের মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা নতুন যুগে প্রবেশ করল। এ বছর পরীক্ষামূলকভাবে ১৫০ একর জমিতে যন্ত্রের মাধ্যমে আমন ধানের চারা রোপণের কাজ শুরু হয়েছে। সুইস পদ্ধতি ‘টেগরা’র মাধ্যমে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে বীজ বপন থেকে শুরু করে চারা উৎপাদন ও কৃষকের জমিতে চারা রোপণ করা হচ্ছে।


উত্তরবঙ্গে তীব্র শ্রমিক সঙ্কটের মাঝে কৃষির এই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি কৃষকদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। থাইল্যা- ও ভিয়েতনাম এ প্রযুক্তিতে ধান আবাদের মাধ্যমে তাদের উৎপাদন ২০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। সীমিত জমি ও বিপুল জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে এ প্রযুক্তিতে কৃষি আবাদ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। বোরো ও আমন মৌসুমে এ পদ্ধতিতে অন্তত অর্ধেক জমিও আবাদ করতে পারলে দেশে অতিরিক্ত প্রায় ৬০ লাখ টন চাল উৎপাদন করা সম্ভব হবে। থাইল্যান্ড এই যান্ত্রিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে চাষাবাদ করে বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় খাদ্যশস্য রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কৃষি সংস্থা সিনজেনটা বাংলাদেশে এই আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে এসেছে। এ পদ্ধতিতে এ বছর আমন মৌসুমে বগুড়ার নন্দিগ্রাম ও শাহজাহানপুর উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে ১৫০ একর জমিতে ধান চাষ করা হচ্ছে। রবিবার সরেজমিনে বগুড়ার নন্দিগ্রাম উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, বিশেষভাবে ট্রেতে উৎপাদিত আমন ধানের চারা প্রচলিত শ্রমিকের পরিবর্তে যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষেতে রোপণ করা হচ্ছে। একটি মেশিনের মাধ্যমে দুই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে সারিবদ্ধভাবে এক বিঘা জমিতে ধান চারা রোপণের কাজ শেষ হয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রের মাধ্যমে লাগানো ধান চারাগুলো সুস্থ ও সবল থাকার কারণে লাগানোর দু’দিনের মধ্যেই চারাগুলো সবুজে পরিণত হচ্ছে। আর দিনমজুরদের দিয়ে লাগানো চারাগুলো সবুজে পরিণত হতে ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগছে। কারণ দিনমজুরদের দিয়ে ধানের চারা রোপণ করা হলে চারাগুলো ‘ইনজুরিতে’ পড়ে। ইনজুরি কাটিয়ে সেই চারা সোজা হয়ে দাঁড়াতে ১০-১৫ দিন সময় লেগে যায়। অন্যদিকে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে লগানো চারা থেকে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে ১০-১৫ দিন আগেই ধান কাটা যায়।
কৃষকরা জানান, কৃষি কাজের জন্য এখন প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে দিনমজুরের সঙ্কট। ধান আবাদ ও কাটার মৌসুমে এই সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে। তখন কৃষি শ্রমিকের মজুরি দ্বিগুণ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, দ্বিগুণ মজুরি দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যায় না। ফলে সময় মতো চারা রোপণ করা যায় না। এতে চারার বয়স বেড়ে যায়। ফলে ধানের ফলন কমে যায়।
এ প্রসঙ্গে নন্দিগ্রামের কৃষক হাজী শমশের আলী বলেন, মেশিনে রোপণ করলে বিঘায় ১৫শ’ টাকা খরচ পড়ে। একরে খরচ পড়ে সাড়ে চার হাজার টাকা। এ টাকায় বীজ, ধানের চারা ও রোপণ ও আগাছানাশক ওষুধ প্রদান করা হয়। পাশাপাশি ধান আবাদের পুরো মৌসুমে অর্থাৎ ধান কাটার পূর্ব পর্যন্ত কৃষিতাত্ত্বিক সেবা পাওয়া যায়। দিনমজুর নিয়ে ধান আবাদ করলেও প্রায় ১২-১৩শ’ টাকা বিঘাপ্রতি খরচ পড়ে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আবাদকালীন কৃষিতাত্ত্বিক সেবা পাওয়া যায় না। সবচেয়ে বড় কথা হলো এ ‘টেগরা’ পদ্ধতি গ্রহণ করলে ১৬-১৭ দিন বয়সী সুস্থ ও সবল চারা পাওয়া যায়। যা থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি ফলন পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, সাধারণ সময়ে দিনমজুরদের দৈনিক মজুরি ২০০ টাকা হলেও বর্তমানে মজুরি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০০ টাকা। সেই সঙ্গে তিন বেলা খাবার দিতে হবে। সমস্যা হলো এই মজুরি দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যায় না। অথচ ধানের চারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রোপণ করতে হয়। অন্যথায় চারার বয়স বেশি হয়ে গেলে ফলন ভাল হয় না।
শমশের আলী বলেন, ‘এই এলাকায় কৃষি কাজ করার জন্য শ্রমিক পাওয়া যায় না। গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারীর শ্রমিক না এলে আমাদের জমিগুলো পতিত পড়ে থাকে। পাকা ধান নিয়ে বসে থাকতে হয়, ধান কাটা যায় না।’
মনিনাগ গ্রামের কৃষক হাজী খলিলুর রহামন এবার দেড় একর জমিতে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেছেন। ১০ দিন আগে তাঁর জমিতে মেশিনের মাধ্যমে ধানের চারা রোপণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তাঁর ধান গাছগুলো গাঢ় সবুজ হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, নতুন প্রযুক্তি সকলকেই মেনে নিতে হবে। দিন দিনে যেভাবে কৃষি শ্রমিকের সঙ্কট দেখা দিচ্ছে তাতে আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ ছাড়া উপায় নেই। মেশিনের মাধ্যমে লাগানো ধান এবার থেকে মেশিনের মাধ্যমেই কাটা হবে বলে তিনি জানান। এতে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা পুরোপুরি যান্ত্রিক যুগে প্রবেশ করবে।
তিনি জানান, তাঁর ৫০ বিঘা জমি আছে। এর মধ্যে এ বছর আমন মৌসুমে পরীক্ষামূলকভাবে সোয়া চার বিঘা জমি যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেছেন। এ পদ্ধতিতে ফলন ভাল পেলে তিনি আগামী বোরো মৌসুমে আরও অধিক জমি যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষ করবেন বলে জানান।
এ প্রসঙ্গে সিনজেনটা বাংলাদেশের হেড অব টেগরা ড. এবিএম জিয়াউর রহমান বলেন, টেগরা হচ্ছে একটি ব্রান্ডের নাম। যা চাষীদের পরিপূর্ণ কৃষি সমাধান প্রদান করে। এ পদ্ধতিতে ধানের মৌসুমের শুরুতে কৃষক তাদের পছন্দমতো ধানের জাত ও চারা রোপণের তারিখ উল্লেখ করে বুকিং দেয়। সিনজেনটা সেই বুকিং অনুযায়ী যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ট্রেতে ধানের চারা উৎপাদন করে এবং নির্ধারিত তারিখে মেশিন দিয়ে চারা রোপণ করে দেয়। সেই সঙ্গে কৃষকের জমিতে আগাছানাশক প্রদান করা হয়, যাতে জমিতে কোন আগাছা না জন্মে। এ ছাড়া ধান কাটার পূর্ব পর্যন্ত কৃষকদের কৃষিতাত্ত্বিক নানা সেবা প্রদান করা হবে। যাতে কৃষকের কোন সমস্যা না হয়।
তিনি বলেন, ‘এ পদ্ধতি প্রয়োগে অন্যান্য দেশে দেখা গেছে, গতানুগতিক পদ্ধতির তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি ফলন পাওয়া যায়।’
রবিবার সরেজমিনে পরিদর্শনকালে দেখা যায়, প্রথমে কৃষকের বুকিং অনুযায়ী বিশেষ ‘রেসিপিতে’ ধানের চারা উৎপাদন করা হয়। সিনজেনটার সেন্ট্রাল ট্রে প্রিপারেশনে (সিটিপি) প্রথমে বিশেষ ধরনের ট্রেতে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে বীজ বপন করা হয়। এখানে নিম্ন গতিতে প্রতি ঘণ্টায় ছয় শ’ ট্রেতে এবং উচ্চ গতিতে ঘণ্টায় এক হাজার ট্রেতে বীজ বপন করা যায়। এক একর জমিতে ধান চাষ করতে ৮০টি ট্রের চারার প্রয়োজন হয়।
সেই বপন করা বীজ সংবলিত ট্রে নিয়ে যাওয়া হয় নার্সারিতে। ওখানে দু’দিনেই চারা গজিয়ে যায় এবং ১৬ থেকে ১৮ দিনের মধ্যে চারা রোপণের অবস্থায় চলে আসে। ভাল ফলনের জন্য ‘একটি কুঁড়ি তিনটি পাতার’ চারা হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম। ১৬-১৭ দিনের মধ্যেই ধানের চারা একটি কুঁড়ি ও তিনটি পাতায় পরিণত হয়। এরই মধ্যে কৃষক তার জমি তৈরি করে ফেলে। ফলে কৃষকের দেয়া তারিখ অনুযায়ী ওই চারা মেশিনের মাধ্যমে ক্ষেতে রোপণ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ওয়াসিম উদ্দিন তালুকদার বলেন, যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ দেশের কৃষি খাতে একটি নতুন বিপ্লব। এ প্রযুক্তিতে কৃষক দ্রুত তার জমি আবাদ করতে পারছে। দিন দিন যেভাবে কৃষি শ্রমিক সঙ্কট তীব্র হচ্ছে তাতে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে চাষাবাদের কোন বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, এ আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণের ব্যাপারে আমরা কৃষকদের উৎসাহিত করছি। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধানের চারা লাগানোর ২/৩ দিনের মধ্যেই চারাগুলো খুব সজীব সতেজ হয়ে ওঠে। ফলে চাষীদের মন ভরে যায়।

No comments

Powered by Blogger.