তৌফিক-ই-ইলাহীর সৃষ্ট বোঝা জনগণ বইবে কেন by প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক

এ বছর পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের লোকসান হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। আর গত বছর এ লোকসানের পরিমাণ ছিল আট হাজার কোটি টাকা। এ লোকসানের কারণ কী? এ লোকসানের অর্থ গেল কোথায়? পেট্রোলিয়াম করপোরেশন তেলে সাবসিডি দিয়েছে কুইক রেন্টাল কম্পানিগুলোকে। আবার বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে অতি উচ্চমূল্যে।


অত্যন্ত অসংগতিপূর্ণ একটি বিষয় হলো, আমাদের সচল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রাখা হয়েছে এই ব্যাখ্যায় যে তেলের দাম বেশি। তাহলে এই অতি উচ্চমূল্যের অব্যবস্থাপনা কেন? সরকার এখন বুঝতে পেরেছে যে কুইক রেন্টাল ব্যবস্থায় গিয়ে ভুল করেছে। তারা ঘোষণা দিয়েছে আর এ ব্যবস্থায় যাবে না। কিন্তু এভাবে যাঁরা দেশের মানুষের ওপর বিদ্যুতের নামে খরচের বোঝা চাপিয়ে দিলেন তাঁদের কোনো বিচার হবে না? প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী পাস করিয়ে নিয়েছেন যে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করা যাবে না। কিন্তু এই যে দুর্গতি ডেকে আনা হলো, এ নিয়ে কেউ কিছু বলতেও পারবে না।
আমি আরেকটু বিস্তারিত তথ্যের ভিত্তিতে বলছি। বাংলাদেশ সরকারের এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন এবার বিদ্যুতের দাম ৫০ থেকে ৫৭ শতাংশ বৃদ্ধি করতে চাইছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মতে, বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ৫.৭০ টাকা/কিলোওয়াট-ঘণ্টা (ইউনিট), যেখানে বিগত মার্চ মাস থেকে ৪.৫৩-৪.৫৭ টাকা/ইউনিট (বাল্ব) দরে বিদ্যুৎ বিতরণকারী কম্পানিদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুতের বাল্ব দর ছিল ২.৭৫-২.৭৮ টাকা, পিডিবি এখন বাল্ব দর ৬.০৩ টাকা/ ইউনিট করতে চাইছে (ডেইলি স্টার, জুন ২৬, ২০১২)।
পিডিবির গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় ১.৩০-১.৫০ টাকা/ইউনিট হলেও ফার্নেস তেলচালিত রেন্টাল কেন্দ্র থেকে ৭.৬৬ টাকা/ইউনিট এবং ডিজেলচালিত কেন্দ্র থেকে ১৩.৬৬ টাকা/ইউনিট দরে বিদ্যুৎ কিনতে হয় (নিউ এজ, ১৬ মে, ২০১০)। পিডিবির লোকসানের আরো বড় কারণ বেশ কিছু কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনের চুক্তি, যে চুক্তির কারণে বিদ্যুতের দাম ১৪.৫০-১৬.৫০ টাকা/ইউনিট করে পড়ছে।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ২০১০-১১ সালে আট হাজার কোটি টাকা লোকসান দেয়, কিন্তু ২০১১-১২ সালে এর লোকসান ছিল ২৬ হাজার কোটি টাকা। আবারও বলছি, এই লোকসানের পেছনে প্রধান কারণ কিন্তু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল নামে অতি উচ্চদরের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন। সরকার এর দায় জনগণের ওপর চাপিয়ে ২০১১ সালে চার দফা তেলের দাম বাড়িয়েছে। ফলে উৎপাদন ও সেবায় বিপুল পরিমাণে মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। সরকার ব্যাংক নোট ছাপিয়ে বাজারে মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চায়। কিন্তু অতিরিক্ত মুদ্রা সাধারণ মানুষের কাছে না গিয়ে যায় ধনীদের কাছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ার সঙ্গে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি না করায় মূল্যস্ফীতিতে ধনীরাই লাভবান হয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমান বিদ্যুৎ চাহিদার পরিমাণ কমবেশি ছয় হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, যেখানে পাবলিক সেক্টরে চার হাজার ৩৫৫ মেগাওয়াট ও প্রাইভেট সেক্টরে তিন হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট, সর্বমোট আট হাজার ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত আছে এবং এতে সাত হাজার ৫৫১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। যদিও বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে গড়ে পাঁচ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, ২২ মার্চ ২০১২ উৎপাদন ছয় হাজার ৬৬ মেগাওয়াটে ওঠে। ওই ঘটনাটি রহস্যজনক। অভিযোগ আছে, পাবলিক সেক্টরের অনেক সচল বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে প্রাইভেট সেক্টর থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনার জন্য একটি চক্র কাজ করছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্থাপন ও পরিচালনায় দুর্নীতি, সিস্টেম লস ইত্যাদির নামে সর্বক্ষেত্রে যে দুর্নীতি বিরাজ করছে, সরকার সেটা না কমিয়ে উল্টো জনগণের ওপর মূল্যবৃদ্ধির বোঝা চাপাচ্ছে। আমরা তাই সরকারের অপরিণামদর্শী ব্যবস্থাপনা, সীমাহীন দুর্নীতি ও চুরির খেসারত দেওয়ার জন্য বিদ্যুতের প্রস্তাবিত মূল্য বৃদ্ধিকে সমর্থন করি না।
(অনুলিখন)
লেখক : চেয়ারম্যান, দেশপ্রেমিক জনগণের মঞ্চ

No comments

Powered by Blogger.