বদলে যাচ্ছে তালেবানদের লড়াইয়ের কৌশল

আফগানিস্তানে ইদানীংকার তালেবান হামলার কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে তারা লড়াইয়ের কৌশল পাল্টিয়েছে। আশ্রয় নিয়েছে নতুন স্ট্র্যাটেজির। কাবুলে ন্যাটো সদর দফতর, পার্লামেন্ট ভবন, মার্কিন ও অন্যান্য দূতাবাস, বিদেশীরা থাকে এমন সব হোটেল ও বহুতল ভবনে হামলা তারই স্বাক্ষর বহন করে।


বলাবাহুল্য এই স্থাপনাগুলো অতি সুরক্ষিত। এসব জায়গায় হামলা হতে পারে তা কল্পনাতীত। কিন্তু তারপরও হামলা হচ্ছে এবং সাফল্যের সঙ্গে হচ্ছে। এর জন্য দায়ী তালেবানদের নতুন রণকৌশল।
কি সেই রণকৌশল? এর বৈশিষ্ট্যই বা কি? এই রণকৌশলের একটা বড় দিক হলো আক্রমণের ক্ষেত্র হচ্ছে শহরাঞ্চল। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতার স্থাপনায় চালানো হচ্ছে সুইসাইড হামলা। দ্বিতীয়ত এসব হামলার পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের পেছনে নিয়োগ করা হচ্ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, কম্পিউটার ও আইটি জ্ঞান এবং এগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত একঝাঁক শহুরে তরুণ, যারা ব্যবহার করছে ডিজিটাল ক্যামেরা, ওয়েরক্যাম, ইন্টারনেট, জিপিএস সরঞ্জাম ইত্যাদি। এরা বদলে দিচ্ছে লড়াইয়ের চেহারা ও ধরন। শহরাঞ্চলে, বিশেষত রাজধানীতে এসব হামলার সুবিধা আলাদা ও বিশাল। এতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রচার হয় বেশি, যোদ্ধাও লাগে কম এবং তালেবানদের মনোবল বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
শহরাঞ্চলে যুদ্ধের এই সর্বশেষ স্ট্র্যাটেজি তালেবান শাসক পরিষদ ‘কোয়েটা সুরা’র হাত দিয়ে প্রণীত। তবে গত বেশ কয়েক মাসে রাজধানী কাবুলে যেসব চাঞ্চল্যকর হামলা হয়েছে সেগুলোর নির্দেশনায় ছিলেন হাজী লালা। এই নামটি আসলে হাজী হায়াতুল্লাহর ছদ্মনাম। ইনি কাবুলে কোয়েটা সুরার ছায়া গবর্নর এবং পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রন্টে তালেবান কার্যক্রমের প্রধান। ইনি লজিস্টিক বিশেষজ্ঞ। কাবুলে তালেবানদের অর্থ, অস্ত্র ও বিস্ফোরকের নিরবচ্ছিন্ন যোগান বজায় রাখেন তিনি। গত বছর কারজাইয়ের শান্তি পরিষদের চেয়ারম্যান সাবেক প্রেসিডেন্ট বুরহানউদ্দিন রব্বানী এবং গত ১৩ মে শান্তি পরিষদের আরেক সদস্য যিনি ২০০১ সালে তালেবান সরকারের পতনের আগে শিক্ষা উপমন্ত্রী ছিলেন, সেই আরসালা রাহমানির হত্যাকা-ের পেছনে হাজী লালার হাত আছ বলে শোনা যায়।
এই হাজী লালার নেতৃত্বে তালেবানদের মার্কিনবিরোধী যুদ্ধে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়েছে। এজন্য প্রযুক্তির দিক দিয়ে অত্যাধুনিক জ্ঞান ও কৌশলের অধিকারী বেশ কিছু তরুণকে নিয়োগ করা হয়েছে যারা মাদ্রাসায় নয় বরং লেখাপড়া করেছে শহরের উন্নতমানের কলেজগুলোতে। কম্পিউটার, ওয়েবক্যাম ও অন্যান্য আইটি ও জিপিএস সরঞ্জাম কাজে লাগিয়ে তারা টার্গেট এলাকার নিখুঁত চিত্র সংগ্রহ করে সেগুলো গেরিলাযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেয়। এই তরুণরা তাদের বিশেষ আইটি জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে গোয়েন্দা তথ্যও সংগ্রহ করে এবং ইলেকট্রনিক নিরাপত্তা বজায় রাখে। শহরাঞ্চলে গোয়েন্দাবৃত্তি পরিচালনায় তাদের জুড়ি মেলা ভার। শহরের অভিজ্ঞ বাসিন্দা হিসেবে তারা জানে কোথায় মানুষের মাঝে মিশে গিয়ে সম্ভাবনাময় টার্গেট, এ্যামবুশের স্থান, পালিয়ে যাবার পথ ইত্যাদির সন্ধান করতে হয় অথচ কারোর নজরে পড়ার ঝুঁকি থাকে না। গুগল ম্যাপ, জিপিএস ও ভিডিওর মতো অত্যাধুনিক উপকরণ কাজে লাগিয়ে রাস্তাঘাট ও ভবনের নিখুঁত ও অনুপুঙ্খ চিত্র কিভাবে সংগ্রহ করতে হয় এদের তা ভালমতো জানা যা পুরনো ধারার তালেবানরা কখনও কল্পনাও করতে পারে না।
তালেবানদের এই শহুরে গোয়েন্দা দলগুলো এখন কাবুল, কান্দাহার ও মাজার শরীফসহ বেশকিছু বড় শহরের রাজপথে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। কাকপক্ষীও টের পায় না এমনভাবে তারা ছবি তুলছে, ম্যাপ বানাচ্ছে, তথ্য সংগ্রহ করছে। বিদেশীরা থাকে এমন সব হোটেল, গেস্ট হাউস ও দূতাবাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিদিন পরীক্ষা করে দেখছে। কেউ কেউ ড্যাশবোর্ডে ওয়েবক্যাম লাগানো গাড়ি চালিয়ে স্পর্শকাতর স্থান, সরকারী ভবন, সামরিক স্থাপনার ছবি তুলে অন্যদের কাছে ট্রান্সমিট করছে। এর ফলে তালেবান কমান্ডারদের পক্ষে এমন সব স্থানে হামলার পরিকল্পনা করা সম্ভব হচ্ছে যা আগে কখনও সম্ভব হয়নি। এভাবে তথ্যপ্রযুক্তি মুজাহিদদের হামলার কাজটা সহজ করে দিচ্ছে। এরা ই-মেইল এমনকি ইন্টারনেট চ্যাট রুম কাজে লাগিয়ে যেখানে প্রয়োজন সেখানে গোয়েন্দা তথ্য পাঠাচ্ছে। ইন্টারনেট তালেবানদের ট্রেনিং ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। ওয়েবক্যামের সাহায্যে শত শত মাইল দূরের কাদামাটির তৈরি গ্রামের বাড়িতে কিংবা বিভিন্ন জায়গায় বসা একজনকে কিংবা একটি গ্রুপকে অথবা কয়েকটি গ্রুপকে একই সঙ্গে বোমা তৈরির কলাকৌশল শেখানো হচ্ছে।
অবশ্য তালেবানদের এসব কারসাজি ও কলাকৌশল ধরার উপায় আমেরিকায় একেবারেই নেই তা ঠিক নয়। যেমন নতুন কিছু প্রযুক্তি হলো এ্যারোস্ট্যান্ট। এগুলো আসলে গোয়েন্দা বেলুন। গোয়েন্দা ক্যামেরা ও আড়িপাতার ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বসানো শতাধিক ফুট লম্বা এই বেলুন তথা এয়ারশিপ বিভিন্ন শহর, মার্কিন ঘাঁটি ও স্ট্র্যাটেজিক মহাসড়কের ওপর ভাসছে। এদের ইলেকট্রনিক চোখ-কানকে ফাঁকি দেয়া অত্যন্ত কঠিন। অনেক সময় এসব বেলুনের সহায়তায় আমেরিকানরা তালেবান ঘাঁটির হদিস বের করতে সক্ষম হয়েছে।
ইন্টারনেটে কাজ করার সময় জঙ্গী তালেবানরা স্পর্শকাতার ও বিপজ্জনক তথ্যাবলী পশতু কবিতা, পশতু নৃত্য, জোকসÑএসব নির্দোষ নাম দিয়ে ডিজিটাল ফোল্ডার ও ফাইলে লুকিয়ে রাখে যাতে তারা কেউ গ্রেফতার হলে বা তাদের কম্পিউটার আটক করা হলে সহজে এসব তথ্য শত্রুর হাতে না যায়।
শহরাঞ্চলে এসব অভিযান চালানো এবং এর পেছনে বিপুল অর্থ ও অন্যান্য সম্পদ বিনিয়োগকে কেন্দ্র করে তালেবানদের নিজেদের মধ্যে গুরুতর মতবিরোধ রয়েছে। তথাপি এই কৌশল শেষপর্যন্ত আমেরিকা ও কাবুল সরকারকে দুর্বল করে কি না কিংবা আফগানদের কাছে জনপ্রিয়তা পায় কি না ভবিষ্যতই তা বলতে পারে।
সূত্র : নিউজ উইক

No comments

Powered by Blogger.