শ্রদ্ধাঞ্জলি-কর্নেল জামান আমাদের পথপ্রদর্শক by শাহরিয়ার কবির

২০০৭ সালে রণাঙ্গনের সহযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডাররা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে যখন তাকে ডাকলেন, অসুস্থ শরীরেও তিনি তাতে যোগ দিয়েছেন। কর্নেল জামান সূচিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন আজ বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।


আমাদের দুর্ভাগ্য তিনি বিজয় দেখে যেতে পারেননি। তবে তিনি বিজয়ীর মৃত্যু বরণ করেছেন


একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনের পুরোগামী নেতা, মুক্তিযুদ্ধে ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) কাজী নূরুজ্জামান পরিণত বয়সে মৃত্যুবরণ করলেও তার মৃত্যু আমাদের আন্দোলনে যে শূন্যতা সৃষ্টি করেছে, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
তাকে আমি প্রথম দেখি মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। জহির রায়হান তার কালজয়ী প্রামাণ্যচিত্র 'স্টপ জেনোসাইড' ও 'লিবারেশন ফাইটার্স' নির্মাণকালে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের দৃশ্য ধারণ করার জন্য তার রণাঙ্গনই বেছে নিয়েছিলেন, যুদ্ধের সময় কিছুকাল আমি যেখানে ছিলাম। জহির রায়হান বাম রাজনীতির অনুসারী ছিলেন। কর্নেল জামান পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকা সত্ত্বেও বাম রাজনীতির প্রতি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, সেই সময় যা ছিল অকল্পনীয়।
১৯৭৩ সাল থেকে তাকে কাছ থেকে জানার সুযোগ হয়েছিল রাজনীতির কারণেই। তখন তিনি থাকতেন সিদ্ধেশ্বরীর আমিনাবাদ কলোনিতে। আত্মগোপনকারী বাম নেতাদের ঢাকায় আশ্রয় ও যোগাযোগের প্রধান ঠিকানা ছিল তার চার কামরার সেই ছোট অ্যাপার্টমেন্ট। মাও সে তুঙের চিন্তাধারার অনুসারী হয়েও তিনি যেমন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, রণাঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, একইভাবে যেসব নেতার সঙ্গে তার দলীয় কোনো সম্পর্ক ছিল না, তারাও নিদ্বর্িধায় তার আতিথ্য গ্রহণ করতেন। ব্যক্তি ও দলের চেয়ে তার কাছে বড় ছিল আদর্শ, যে আদর্শ হচ্ছে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের সার্বিক মুক্তি।
একসময় বাঙালিত্বের চেতনার প্রতি কমিউনিস্ট নেতাদের এক ধরনের উন্নাসিকতা ছিল। অনেকে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে সুকান্তকে বড় কবি ভাবতেন, বুর্জোয়া বলে সমালোচনা করতেন রবীন্দ্রনাথের। চীনপন্থি কমিউনিস্টদের ভারতবিদ্বেষ ছিল মজ্জাগত। কর্নেল জামান ছিলেন তাদের ভেতর এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তার আগ্রহ ও অনুরাগ ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর। একদিকে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার শিক্ষা, অপরদিকে চীনপন্থি কমিউনিজমের প্রতি তার দুর্বলতার মাঝখানে তিনি অতি অনায়াসে স্থান দিতে পেরেছিলেন বাঙালি ও উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিকে। তার জ্যেষ্ঠ কন্যা নায়লা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছেন, কনিষ্ঠ লুবনা শিখেছেন ভরতনাট্যম। কর্নেল জামান আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সমন্বয়ের যে ধারা সৃষ্টি করেছিলেন, পরবর্তীকালে বাম আন্দোলনে সেই ধারা বিকশিত হয়েছে। কমিউনিস্টরা এখন রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া বলে সমালোচনা করেন না। এ বছর রবীন্দ্র সার্ধশতবর্ষে চীনা সরকার রবীন্দ্রনাথের রচনাসমগ্র চীনা ভাষায় প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে চীনপন্থি কমিউনিস্টদের কাছে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি অস্পৃশ্য ছিল না। তাদের কেউ কেউ 'রুশ-ভারতের দালাল' আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতার জন্য জামায়াত ও সমগোত্রীয় পাকিস্তানপন্থি মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে স্বাভাবিক মিত্র মনে করতেন। এ ক্ষেত্রে কর্নেল জামান ছিলেন এক অনন্যসাধারণ ব্যতিক্রম। জিয়াউর রহমানের জমানায় যখন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের অপরাপর দলগুলোকে রাজনীতি করার লাইসেন্স দেওয়া হয়, যখন যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে বাংলাদেশে আসার ভিসা দিয়ে থাকতে দেওয়া হয়_ সবার আগে প্রতিবাদ করেছিলেন কর্নেল জামান।
১৯৭৩ সাল থেকে আমি ছিলাম তার ছায়াসঙ্গী। তার রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা, একই রাজনীতির অনুসারী কমরেডদের সঙ্গে তার মতপার্থক্য, নিজের বিশ্বাসের অবস্থানে অবিচল থাকা এবং অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়া প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করেছিল আমাদের। বয়সে তিনি ছিলেন আমার পিতৃতুল্য, অথচ কথা বলতেন সমবয়সী বন্ধুর মতো। তার সন্তানদের বন্ধুরাও ছিল তার বন্ধুতুল্য।
অসুস্থ মাকে দেখার কথা বলে তিন মাসের ভিসা নিয়ে জামায়াতপ্রধান গোলাম আযম যখন অবৈধভাবে বাংলাদেশে থেকে গেলেন, এর প্রতিবাদে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। কর্নেল জামান তখন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান। 'নয়া পদধ্বনি' নামে একটি পত্রিকা বের করেছিলেন, যেখানে আমরা নিয়মিত লিখতাম। 'নয়া পদধ্বনি'র নিয়মিত লেখকদের তালিকায় ছিলেন আহমদ শরীফ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বদরুদ্দীন উমর, বিনোদ দাসগুপ্ত, সাঈফ-উদ দাহারের মতো প্রগতিবাদী লেখকরা। কর্নেল জামানের লেখালেখির সূচনা এই পত্রিকার প্রয়োজনে। সেই সময় তার দুটি প্রবন্ধ গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলাম আমাদের ডানা প্রকাশনী থেকে। 'নয়া পদধ্বনি' ছিল আমাদের মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রগতির আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার।
১৯৯২ সালে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি' গঠন করে আমরা গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার করেছিলাম। গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের কথা প্রথম বলেছিলেন কর্নেল জামান। এ বিষয়ে 'গণআদালতের পটভূমি' গ্রন্থে আমি লিখেছিলাম, নির্মূল কমিটি গঠনের প্রায় ১১ বছর আগে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের কথা বলেছিল। ১৯৮১ সালের ২১ মার্চ কর্নেল জামান সর্বপ্রথম গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের ঘোষণা প্রদান করেন। তখনকার পত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
'১লা মে থেকে রাজাকার-আলবদর প্রতিরোধ সপ্তাহ' শিরোনামের এক খবরে বলা হয়েছে_ বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আগামী ১লা মে থেকে দেশব্যাপী রাজাকার আলবদর প্রতিরোধ সপ্তাহ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। গত ২১শে মার্চ বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) কাজী নূরুজ্জামান (বীরউত্তম) এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা ঘোষণা করেন। তিনি অভিযোগ করেন, অধ্যাপক গোলাম আযম পাকিস্তানের চর হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করছে। তিনি অধ্যাপক গোলাম আযমসহ সব দেশদ্রোহীর বিচার দাবি করেন।
তিনি বলেন, 'সরকার যদি বিচার করতে ব্যর্থ হয় তাহলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গণআদালত গঠন করে অধ্যাপক গোলাম আযমসহ সকল রাজাকার-আলবদরের বিচার করবে।...' (সাপ্তাহিক জাগরণ, লন্ডন, ৫ এপ্রিল, ১৯৮১)
১৯৮১ সালের ২৬ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সাত দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। এর প্রথম দুটি দফায় ছিল_
'এক. জামায়াতে ইসলামী ও তার সমস্ত প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অঙ্গসংগঠনসমূহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো এবং এই সকল প্রতিষ্ঠানের সকল প্রকার তৎপরতা প্রতিহত ও বানচাল করার জন্য জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে।
দুই. জাতির জানি দুশমন গোলাম আযমসহ সকল চিহ্নিত রাজাকার-আলবদর ও স্বাধীনতার শত্রু, প্রশাসনের অভ্যন্তরে বা বাইরে যেখানেই অবস্থান করুক না কেন_ দেশদ্রোহিতার অপরাধে শাস্তি প্রদান করতে হবে। অন্যথায় তাদেরকে গণআদালতে বিচারের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।'
১৯৮১ সালের মার্চের এই সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ঘরে বসে থাকেননি কর্নেল জামান। তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত যেখানেই জামায়াত সমাবেশ করতে চেয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তা প্রতিহত করেছে। কর্নেল জামানের জামায়াতবিরোধী এই লড়াইয়ে ছেদ পড়েছিল যখন জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এসে তাকে গ্রেফতার করেছিলেন। জিয়ার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মঞ্জুরকে দায়ী করে বিনা বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়_ এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন কর্নেল জামান। 'নয়া পদধ্বনি'তে তিনি লিখেছিলেন, জেনারেল জিয়াকে জেনারেল মঞ্জুর হত্যা করেননি, মুক্তিযুদ্ধের এই দুই অধিনায়ককে হত্যার নায়ক নেপথ্যে রয়েছেন। নাম উলেল্গখ না করে তিনি জিয়া ও মঞ্জুরকে হত্যার জন্য জেনারেল এরশাদকে দায়ী করেছিলেন। যে কারণে ক্ষমতা দখল করেই তাকে গ্রেফতার করেছিলেন এরশাদ। প্রায় তেরো মাস তাকে কারাগারে বন্দি থাকতে হয়েছিল।
তার অবর্তমানে 'নয়া পদধ্বনি' বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরশাদের অনুসারীরা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ দখল করে নিয়েছিলেন। আশির দশকের মাঝামাঝি 'নয়া পদধ্বনি'র দল নিয়ে কর্নেল জামান গঠন করেছিলেন 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র'। তিনি ছিলেন সভাপতি, আমি ছিলাম সাধারণ সম্পাদক। আমরা কয়েকটি বুলেটিনসহ চারটি বই প্রকাশ করেছিলাম, যার প্রধান উপজীব্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এর ভেতর সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল 'একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়'। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা প্রথমবারের মতো একাত্তরের শীর্ষস্থানীয় দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের দুষ্কর্মের বিবরণ প্রকাশ করেছিলাম। মাসের পর মাস এই বই ছিল বিক্রয় তালিকার শীর্ষে। ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এ বইটি, তিন দিনে প্রথম সংস্করণের ৫ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল, দ্বিতীয় মুদ্রণের ৫ হাজার বিক্রি হতে সময় লেগেছিল সাত দিন। এরপর আমরা বের করি 'যুদ্ধাপরাধী জামাতের অতীত ও বর্তমান'। এই বইগুলো পরবর্তীকালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনের ভিত রচনা করেছে।
১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বরে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা অনুযায়ী জামায়াত গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করে। গোলাম আযম তখনও পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী, অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন, প্রকাশ্যে আসতে পারতেন না লাঞ্ছিত হওয়ার আশঙ্কায়। কর্নেল জামান কীভাবে গোলাম আযম ও জামায়াতবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিলেন, যে আন্দোলন বাংলাদেশে নাগরিক আন্দোলনে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে আমার 'গণআদালতের পটভূমি' বইয়ে।
১৯৯২-এর ১ জানুয়ারি থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন তার বাড়িতে আমাদের মিটিং হয়েছে। যাদের আমরা চাই তাদের সবার সঙ্গে কথা বলে ১৮ জানুয়ারি 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি' গঠনের ঘোষণা পত্রিকায় পাঠানো হয়। ১৯ জানুয়ারি সব দৈনিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল দেশের ১০১ জন বিশিষ্ট নাগরিক কর্তৃক স্বাক্ষরিত নির্মূল কমিটির ঘোষণা, যার আহ্বায়ক নির্বাচন করা হয়েছিল শহীদজননী জাহানারা ইমামকে। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল, 'আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারীবৃন্দ এই মর্মে ঘোষণা করছি, বেআইনিভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে যদি অবিলম্বে দেশ থেকে বহিষ্কার করা না হয় তাহলে আগামী ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ২১তম বার্ষিকীর দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশিষ্ট নাগরিক ও আইনজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত প্রকাশ্য গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার হবে। যেহেতু গোলাম আযম অপরাধ করেছেন এ দেশের সমগ্র জনগণের কাছে সেহেতু গণআদালতই হবে এই ঘৃণিত ব্যক্তির বিচারের উপযুক্ত স্থান। এই গণআদালতেই পর্যায়ক্রমে বিচার করা হবে '৭১-এর সকল ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীর। একই সঙ্গে আমরা দাবি জানাচ্ছি, একাত্তরের ঘাতকদের দল যারা এখনও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও গণবিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে সেই জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মব্যবসায়ীদের সকল রাজনৈতিক দল অবিলম্বে নিষিদ্ধ করতে হবে। পৃথিবীর কোনো দেশে যুদ্ধাপরাধীদের, চিহ্নিত ঘাতকদের রাজনৈতিক অধিকার নেই। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর দোসরদের আজও খোঁজা হচ্ছে বিচারের জন্য, তাদের কোথাও ভোটাধিকার পর্যন্ত নেই। ঘাতকদের নির্মূল করার লক্ষ্যে আমরা শুরু করতে যাচ্ছি মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়। আমরা মনে করি স্বাধীনতার শত্রুরা যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের মাটিতে বিচরণ করবে, ততদিন পর্যন্ত একটি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে আমরা দাঁড়াতে পারব না। আমাদের কোনো উন্নয়ন কার্যক্রমই সফল হবে না। এ কারণেই স্বাধীনতার শত্রুদের নির্মূল করার লক্ষ্যে আমাদের মুক্তি সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। শুধু একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দল-মতনির্বিশেষে সকলকে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যারা মশালের মতো বহন করে এগিয়ে যাবে, বর্তমান প্রজন্মের সেই প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হবে উক্ত গণআদালত প্রস্তুতি কমিটি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলসমূহকে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি, পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বা সংসদে আলাপ-আলোচনা করে ফ্যাসিস্ট গোলাম আযম ও জামায়াতে ইসলামীকে কিছু করা যাবে না। যেভাবে স্বৈরাচারী এরশাদকে হটাবার জন্য আপনারা ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নেমেছিলেন, ঠিক একইভাবে আসুন আমরা সকলে মিলে স্বাধীনতাবিরোধী, ধর্মব্যবসায়ী, গণহত্যাকারী ও চক্রান্তকারীদের দল জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে সর্বত্র কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলি।'
এরপর ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক গণআদালত, যে আদালতের অন্যতম বিচারক ছিলেন কর্নেল জামান। গত ১৯ বছরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত আমাদের অতিক্রম করতে হয়েছে। কর্নেল জামানের সঙ্গে আন্দোলনের কৌশল নিয়ে দ্বিমত হয়েছে, একসময় তিনি নির্মূল কমিটির কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। এর পরও তারই অনুপ্রেরণায় আমরা এগিয়ে গেছি। ২০০৭ সালে রণাঙ্গনের সহযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডাররা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে যখন তাকে ডাকলেন, অসুস্থ শরীরেও তিনি তাতে যোগ দিয়েছেন।
কর্নেল জামান সূচিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন আজ বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য তিনি বিজয় দেখে যেতে পারেননি। তবে তিনি বিজয়ীর মৃত্যু বরণ করেছেন। শহীদ মিনারে তার মরদেহে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য শুধু সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম বা নির্মূল কমিটি নয়, সর্বস্তরের মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে শুরু করে জামায়াত ছাড়া সব দলের নেতাকর্মী এসে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
তার মৃত্যুতে জাতি হারিয়েছে এক অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা ও মহান দেশপ্রেমিককে, আমরা হারিয়েছি আমাদের সহযোদ্ধা ও পথপ্রদর্শককে। আমাদের কাছে তিনি ছিলেন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অন্ধকার সমুদ্রের তীরে বাতিঘরের মতো।

শাহরিয়ার কবির : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.