উন্নয়ন-আত্মশক্তির উদ্বোধন চাই by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু চুক্তি বাতিল করেছে। দোষ দিয়েছে বাংলাদেশকে। দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, ‘Give a bad name before you kill a dog’ অর্থাৎ একটা কুকুরকে মারতে হলেও মারার আগে ওকে বদনাম দাও। যেমন ‘কুকুরটা বড্ড ঘেউ ঘেউ করে’ অথবা ‘কুকুরটা কামড়াতেও তো পারে’।


বিশ্বব্যাংকও চুক্তিটি হত্যা করার আগে বদনাম দিয়ে বলেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। আসলে ঘটনাটা কী? অনুসন্ধানী চোখ দিয়ে খুঁজে দেখা যাক।
ঘটনার বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেছি। বিশ্লেষণ করেছি। তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। একজন নাগরিক হিসেবে নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় হওয়া প্রয়োজন। বিষয়টি জনগুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টির সঙ্গে জাতীয় স্বার্থ জড়িত। দেশের কিছু ব্যক্তি দেশের সম্মান নষ্ট হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। আমি তেমনটা মনে করি না। আমি মনে করি, দেশের আত্মাভিমানে আঘাত হানা হয়েছে। প্রত্যাঘাত করার আত্মশক্তি আমাদের রয়েছে। তাই আজ আত্মশক্তির উদ্বোধন চাই।
ফিরে যাই ঘটনায়। ঘটনার পেছনের ঘটনায়। দেখে নিই কী ঘটেছিল। সন্দেহাতীতভাবে সৎ ও বিজ্ঞ প্রযুক্তিবিদ ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে নিয়ে একটি মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল যাচাই-বাছাই করে যোগ্য একটি উপদেষ্টা কোম্পানির নাম সুপারিশ করার জন্য। আবেদনকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি ছিল ‘চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি’ বা সংক্ষেপে সিআরসিসি। বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ জোর সুপারিশ করেছিল, মূল্যায়ন কমিটি যেন ওই চীনা কোম্পানির পক্ষে সুপারিশ রাখে। মূল্যায়ন কমিটির কাছে এ ধরনের তদবির করাটাই অনৈতিক। তার পরেও মূল্যায়ন কমিটি যথাযথ গুরুত্ব সহকারে চীনা কোম্পানির প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করেছে। যদিও কমিটির প্রাথমিক মূল্যায়নে কোম্পানিটি বাদ পড়েছিল, তথাপি বিশ্বব্যাংকের তদবিরের পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যায়ন কমিটি প্রস্তাবটি অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছে। দেখা গেছে, চীনা কোম্পানিটির প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা নেই। এ ছাড়া কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হয়ে এসেছে। কোম্পানিটি মূল্যায়ন কমিটির কাছে যেসব কাগজপত্র-দলিল জমা দিয়েছে, তার অনেকগুলোই ভুয়া এবং প্রতারণাপূর্ণ। অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে কোম্পানিটি যেসব সেতু নির্মাণের কথা উল্লেখ করেছে, আদতে এর অনেকগুলোই তারা নির্মাণ করেনি। অর্থাৎ মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করেছে। আরও মারাত্মক প্রতারণার আশ্রয় কোম্পানিটি নিয়েছিল। স্টিল-ব্রিজ নির্মাণ করেছে এমন দাবির সমর্থনে তারা একটি ব্রিজের ফটো দাখিল করে। মূল্যায়নকারী কমিটি তদন্ত করে জানতে পারে যে ফটোগ্রাফকৃত সেতুটি আমেরিকায় অবস্থিত এবং ওই সেতুটি নির্মাণে চীনা কোম্পানিটির কোনো সম্পৃক্ততাই নেই। সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য দিয়ে চীনা কোম্পানিটি প্রতারণা করেছিল। এমন প্রতারক কোম্পানিকে সুপারিশ করার অবকাশ ছিল না। মূল্যায়ন কমিটি করেনি। তার পরও বিশ্বব্যাংক চাপ সৃষ্টি করেছিল ওই কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার জন্য। বিশ্বব্যাংক ভেবেছিল, বাংলাদেশের মতো ‘দুর্বল’ দেশ তাদের শক্তিমত্তার সামনে ‘ঔদ্ধত্য’ দেখাতে পারবে না। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ঔদ্ধত্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মূল্যায়ন কমিটি নিষ্ঠার সঙ্গে চীনা কোম্পানিকে বাদ দিয়েছিল। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে অভিনন্দন, অপশক্তির কাছে মাথানত না করার জন্য।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, বিশ্বব্যাংক জেনেশুনে ওই প্রতারক কোম্পানিকে কাজ দিতে চেয়েছিল কেন? হয়তো ‘টেন পার্সেন্ট’-এর ব্যাপার ছিল। অর্থাৎ দুর্নীতিতে বিশ্বব্যাংকের কর্তৃপক্ষই জড়িয়েছিল, বাংলাদেশ নয়। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি প্রতিহত করার সাহস দেখিয়েছিল। এটাই বাংলাদেশের ‘অন্যায়’।
মূল্যায়ন কমিটি যখন ‘লাভালিন কোম্পানি’কে যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচন করতে যাচ্ছিল, তখন ক্ষুব্ধ বিশ্বব্যাংক বাদ সাধল। সাম্প্রতিক সময়ে লাভালিন বিশ্বের একটি শ্রেষ্ঠ কোম্পানি হিসেবে বিবেচিত। এ বছরও (এত বদনামের পরও) লাভালিন বিশ্বের প্রথম কয়েকটি সমজাতীয় কোম্পানির অন্যতম বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। এতদসত্ত্বেও বিশ্বব্যাংকের আপত্তি জানানোর সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানিটি সরে দাঁড়ায়। মূল্যায়ন কমিটিও কোম্পানিটিকে বাদ দেয়। এই স্বচ্ছতা কি সচরাচর দেখা যায়?
এখন আসা যাক বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের বিষয়ে। বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করেছে, সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির সঙ্গে ‘জড়িত’ কয়েকজনের নামধামও তারা জানিয়েছে। মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো, ‘দুর্নীতিটি কেমন করে হলো?’ যেখানে দাতা সংস্থার একটি পয়সাও ছাড় করেনি, সেখানে দুর্নীতিটা হলো কেমন করে? দুর্নীতির অর্থ হলো অবৈধ অর্থ গ্রহণ করা। টাকাই যেখানে নেই, ব্যয়ও হয়নি, সেখানে দুর্নীতি ঘটার তো সুযোগই সৃষ্টি হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের যুক্তি হলো, দুর্নীতি না হয়ে থাকলেও ভবিষ্যতে হতো! বাহ্! কী চমৎকার যুক্তি! তুই করিসনি, তাতে কী হলো। করতে তো পারতিস! এরপর আসে নাম দেওয়ার কথা। বিশ্বব্যাংক কিছু নাম দিয়েছে। অপরাধ সংঘটিত না হলে অপরাধীর নাম কী করে এল? বিশ্বব্যাংক বুঝি বাংলাদেশি পুলিশকে গুরু মেনেছে। একটা কিছু হাঙ্গামা ঘটলে পুলিশ বিরোধী দলের কয়েকজনকে আসামি করে মামলা ঠুকে দেয়। কোনো কোনো ‘আসামি’ হয়তো ঘটনার সময়ে ঢাকার বাইরে ছিলেন। কেউ বা বিদেশে। তাতে কী আসে-যায়। পুলিশ তো তাঁকে আসামি বলেছে!
বিশ্বব্যাংকের এমনতর আচরণের কারণ কী? ঘটনা বর্ণনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, বিশ্বব্যাংকের আঁতে ঘা লেগেছে। চীনা কোম্পানির কাছ থেকে ‘প্রাপ্তি’ আটকে গেল। শক্তিধর বিশ্বব্যাংকের অন্যায় তদবির না শোনার ‘ঔদ্ধত্য’ দেখাল খাতক বাংলাদেশ। এ তো অসহ্য। তাই বিশ্বব্যাংক নিজের ‘দুর্নীতির মুখোশ’টি বাংলাদেশের ওপর ছুড়ে মারল।
তবে হ্যাঁ, কথা যখন উঠেছে, অপবাদ যখন দেওয়া হয়েছে, তখন কথিত দুর্নীতির স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও যথাযোগ্য তদন্ত করতে হবে। বলা হচ্ছে, লাভালিনের দুই কর্মকর্তাকে কানাডায় দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগ হলো, তাঁরা কাজ পেলে ১০ শতাংশ ঘুষ প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছেন। ও দেশের আইনে ঘুষ প্রদানের প্রস্তাব করা অপরাধ। সে হিসেবে তাঁরা অপরাধী হতেও পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের কেউ সে প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন এবং প্রস্তাবিত ঘুষের বিনিময়ে কাজ প্রদান করেছেন, এমনটা ঘটেনি। মূল্যায়ন কমিটি তো লাভালিনকে বাদই দিয়েছে। ঘুষ খাওয়ার ইচ্ছা থাকলে বাদ দেবে কেন? কাজেই এসব অভিযোগ ধোপে টেকে না। তবু জোর দাবি জানাব, স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে দুদক তদন্ত সম্পন্ন করুক। সত্য প্রকাশ করুক। দুর্নীতির এতটুকু ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী স্ব উদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। নাগরিকেরা শুধু সমর্থন নয়, সেই সঙ্গে ইস্পাতকঠিন একাত্মতা পোষণ করবেন বলে আশা করি। আমাদের ভূখণ্ডটি ছোট। কিন্তু জনবল বৃহৎ। আমরা ভ্রুকুটি সহ্য করতে নারাজ। একাত্তরে শক্তিমত্ত পাকিস্তান আমাদের পদানত করতে চেয়েছিল। তাদের বাংলাদেশি দোসরেরা বলেছিল, দক্ষ পাকিস্তানি বাহিনীর বিপরীতে শেখ মুজিবের লাঠি নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালিরা কিছুই করতে পারবে না। আত্মশক্তিতে জেগে ওঠা বাঙালি সেদিন ভ্রুকুটি, অত্যাচার ছিন্ন করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। আজ আবার আত্মশক্তির উদ্বোধন চাই। আমাদের পদ্মা সেতু আমরাই করব। বাঙালি ‘মাথা নোয়াবার নয়’।
শুধু আবেগ দিয়ে হবে না। আবেগের সঙ্গে পরিকল্পনার প্রয়োজন। পরিকল্পনার প্রাথমিক রূপরেখা উপস্থাপন করছি। প্রকল্প ব্যয় ২২ হাজার কোটি টাকা। ধরে নিচ্ছি, শেষতক ২৪ হাজার কোটি টাকায় ঠেকবে। এর বড় অংশ ব্যয় হবে বিদেশি মুদ্রায়। বাকি অংশ টাকায়। এখন থেকে প্রতিবছর আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট ৫৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে থাকবে। ওখানে কাটছাঁট করে বছরে তিন-চার হাজার কোটি টাকা পদ্মা সেতুর জন্য বরাদ্দ করা সম্ভব। ভর্তুকি দেওয়া হয় কৃষিতে ছয় হাজার কোটি টাকা, বিদ্যুতে নয় হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাতে আরও অনেক টাকা। এখান থেকেও কিছু সাশ্রয় হতে পারে। সর্বোপরি, বন্ড ছেড়ে এবং ‘পদ্মা সেতু সারচার্জ’ ধার্য করে কিছু সংগ্রহ হতে পারে। এসব মিলে চার বছরে ‘টাকা’ অঙ্কের ব্যয় মেটানো সম্ভব। ‘ডলার’ অঙ্কের ব্যয় মেটানোর জন্য (ক) এনআরবি বন্ড ইস্যু করে বছরে ন্যূনপক্ষে দু-তিন হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ডলার সংগ্রহ করা সম্ভব (খ) দেশের স্বাভাবিক ডলার সঞ্চিতি থেকে বছরে দুই হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ জোগান দেওয়া সম্ভব এবং (গ) আইডিবি, এডিবি, জাইকাসহ উন্নয়ন সহযোগীরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ঋণ দেবে বলে মনে করি।
একাত্তরে খালি হাতে জীবন দিয়ে নিজেরা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার পর আমাদের আত্মশক্তিতে অভিভূত হয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ভারত, রাশিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বিরোধিতা করলেও পাশে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ। শুরুটা নিজেদের করতে হয়। আজও আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে আমরা যদি পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করি, আমি আশাবাদী জাইকা, আইডিবি এবং এডিবি আমাদের পাশে দাঁড়াবে। আরও অনেকে শেষমেশ এগিয়ে আসবে আত্মশক্তিকে সম্মান জানানোর জন্য।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক।

No comments

Powered by Blogger.