জনবসতির আশপাশে থাকতেই বেশি পছন্দ,এখন দেখা মেলে না হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির শালিক by আবু জাফর সাবু

গ্রাম বাংলার নানা প্রজাতির চিরচেনা শালিক পাখিরাও পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। পাখিদের মধ্যে শালিকরা জনবসতির আশপাশে থাকতেই বেশি ভালবাসত। সেই শালিক পাখির অনেক প্রজাতির এখন আর গ্রামগঞ্জে সহজে নজরে পড়ে না।


তবে, ভাত শালিক এবং গোবরে শালিকের দেখা মিললেও এই দুটি প্রজাতির সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। বিরল প্রজাতির শালিকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বামন শালিক, চিতা শালিক, ঝুঁটি শালিক, গাং শালিক, ভাত শালিক, গোবরে শালিক, ময়না আর কাঠ শালিক। বামন শালিক ॥ এই প্রজাতির শালিককে কোথাও কোথাও শংখ শালিক নামেও ডাকা হয়। এরা সর্বোচ্চ ২৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এদের চোখ দুটো গোলাকার। ঠোঁট থেকে শুরু করে বুকের পালকের রং উজ্জ্বল গোলাপী এবং হলুদ মিশেল। ঠোঁট, পা হলুদ এবং লেজের নিচের অংশের পালক ধূসর। এর মাথার ওপর ডানা ও লেজের অংশের পালকের রং তেল চিকচিকে নীল। এদের প্রধান খাদ্য ফল, ফুলের মধু এবং গাছগালির পোকা মাকড়। এদের ইংরেজী নাম হচ্ছে ইৎধযসরহু ঝঃধৎষরহম, আর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে ঞবসহঁপযঁং চধমড়ফধৎঁস.
চিত্রা শালিক ॥ অতি বিরল প্রজাতির শালিক গোত্রের চিত্রা শালিক পরিযায়ী পাখি। শীতকালে দেশের পাহাড়ী বনাঞ্চল ও সুন্দরবনে এদের দেখা যায়। সর্বোচ্চ ২৩ সেন্টিমিটার লম্বা আকৃতির এই পাখির পালকের রং সাদা গোলাকার ফুটকিযুক্ত খয়েরি। ঠোঁট লম্বা এবং ধারালো। এরা গাছের পোকা মাকড় আর ফুল খেয়ে থাকে। গাছে দলবদ্ধ হয়ে থাকতেই বেশি ভালবাসে। এদের ইংরেজী নাম হচ্ছে ঈড়সসড়হ ঝঃধৎষরহম, আর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে ঝঃঁৎসঁং ঠঁষমধৎরং খরহহধবঁং.ঝুঁটি শালিক ॥ স্থানীয় প্রজাতির এই শালিক এখনও গ্রামেগঞ্জে দেখতে পাওয়া যায়, তবে খুব বেশি নয়। এরা লম্বায় সর্বোচ্চ ২৩ সেন্টিমিটার এবং এদের ইংরেজী নাম হচ্ছে ঔঁহমষব গুহধ, আর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে অপৎরফড়ঃযবৎবং ঋঁংপঁং. এদের ঠোঁট লাল টকটকে, চোখ দুটো গোলাকার উজ্জ্বল এবং এদের চোখের পাশে গাং শালিক বা ভাত শালিকের মতো লাল হলুদ আভা নেই। পাগুলো লালচে এবং পিঠ ও মুখের পালক কিছুটা কালচে। এছাড়া বুকের পালক ধূসর ও পাটকিলে মিশেল রঙের। ঠোঁটের ওপর এদের ছোট ঝুঁটি থাকে গাং শালিকের মতো। এরা ফল, ফুলের মধু, পোকা মাকড় খেয়ে থাকে।
গাং শালিক ॥ স্থিতু প্রজাতির এই শালিক মূলত বড় নদী, বিলের উঁচু পাড়ে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায়। এরা সর্বভুক। প্রয়োজনে ছোট মাছও এদের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ভাত শালিক আর ঝুঁটি শালিকের মতো দেখতে হলেও কিছুটা ঠোঁট মোটা উজ্জ্বল হলুদ রংয়ের। ঠোঁটের ওপর উঁচু পালকের ঝুঁটি এবং দু’চোখের পাশে লম্বা লাল আভায় এদের আলাদা করে চেনা যায়। এদের বুকের পালক ধূসর এবং পিঠ ও মাথার পালক পাটকিলে রঙের। সর্বোচ্চ ২৩ সেন্টিমিটার লম্বা। গাং শালিকের ইংরেজী নাম ইধহশ গুহধ আর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে অপৎরফড়ঃযবৎবং এরহমরহরধহঁং.
ভাত শালিক ॥ এই প্রজাতির শালিক এখনও সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায়। তবে সংখ্যা আগের চাইতে অনেক কমে গেছে। তবে এরা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারছে বলে এরা বিরূপ অবস্থাতেও সর্বত্র টিকে আছে। ভাত শালিক সবকিছুই খায়। এরা মানুষের বসতবাড়ির আশপাশে থাকতেই ভালবাসে। কেননা মানুষের আহার্য্য ভাত, তরকারি, চাল, চিড়া, মুড়ি খেতেও এরা অভ্যস্ত। এমনকি সুযোগ পেলে জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে খাবার খেয়ে পালিয়ে যায়। ২৩ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যরে ভাত শালিকের সঙ্গে গাং শালিকের যথেষ্ট মিল থাকলেও এদের ঝুঁটি নেই আর ঠোঁট ছোট এবং দুচোখের পাশে লম্বা টানা হলুদ রং। আর লেজের নিচের অংশের পালক সাদা আর উপরে কালচে। এছাড়া গায়ের পালক উজ্জ্বল পাটকিলে এবং ঠোঁট থেকে গলা পর্যন্ত পালকের রং কালো। পায়ের রং হাল্কা হলুদ। এরা যত্রতত্র চিকন ডালপালা ও আঁশ দিয়ে গোলাকার বাসা বানায়। এদের ইংরেজী নাম হচ্ছে ঈড়সসড়হ গুহধ আর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে অপৎরফড়ঃযবৎবং ঞৎরংঃরং.
গোবরে শালিক ॥ এই প্রজাতির শালিক সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়। এদের গো শালিক নামেও ডাকা হয় কোথাও কোথাও। সর্বোচ্চ ২৩ সেন্টিমিটার লম্বা এই প্রজাতির ইংরেজী নাম হচ্ছে অংরধহ চরবফ ঝঃধৎষরহম এবং বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে এৎধপঁঢ়রপধ ঈড়হঃৎধ খরহহধবঁং. এদের ঠোঁট লম্বা এবং হলুদ। কালো পুতির মতো দুটো চোখ এবং চোখের দু’পাশে, দু’ডানার পাশে লম্বা রেখার মতো সাদা পালক এদের আকর্ষণীয় করে তোলে। এদের বুকের পালক সাদা, লেজ গোটাটাই কালো রঙের। এছাড়া পিঠ, মাথা, গলার পালকের রং কালো। যে কোন গাছেই খড় দিয়ে বানানো এদের অগোছাল বাসা সবার চোখেই পড়বে। এরা মূলত পোকা মাকড় খেতেই বেশি ভালবাসে। এদের গোবরে শালিক নামকরণের অন্যতম কারণ এদের গরু, ঘোড়া অন্যান্য পশুর গোবর ঘেঁটে পোকা মাকড় খেতেই দেখা যায় বেশি।
ময়না ॥ পাখিদের মধ্যে শেখানো কথা বলতে পারদর্শিতার কারণে শালিক প্রজাতির ময়না অতি মূল্যবান একটি পাখি যা এখন বিলুপ্ত হতে চলেছে। এদের মূলত পাহাড়ী বনাঞ্চলেই দেখতে পাওয়া যায়। তবে এখন সংখ্যায় অনেক কম। ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা এই পাখির ইংরেজী নাম হচ্ছে ঐরষষ গুহধ আর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে এৎধপঁষধ জবষরমরড়ংধ খরহহধবঁং. এদের লম্বা হলুদ ঠোঁট এবং দু’চোখের পাশে হলুদ দাগ ছাড়া গোটা শরীরের পালক চকচকে নীল রঙের। এরা ফুল, ফল, মধু এবং পোকা মাকড় খেতে অভ্যস্ত। গাছের কোটরে বাসা বানায়। এক বাসায় জুটি বেঁধে থাকে অনেক দিন।
কাঠ শালিক ॥ এ দেশের গ্রামগঞ্জের শালিক গোত্রের অতিচেনা পাখিদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কাঠ শালিক। অবাধ বৃক্ষ নিধন এবং জমিতে বিষাক্ত কীটনাশক প্রয়োগ সুন্দর এই পাখিটির সংখ্যা বহুলাংশে হ্রাস করেছে। আগে সর্বত্র এদের দেখতে পাওয়া গেলেও এখন দুর্গম বনাঞ্চল ও পাহাড়ী এলাকায় এদের বেশি দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি ইদানিং গাইবান্ধাসহ মফস্বল শহরগুলোতেও এদের বিচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। লালচে, ধূসর, খয়েরি ও পিঙ্গল রংয়ের মিশেল এই পাখিটি আমাদের চেনা শালিকের চেয়ে কিছুটা ছোট। এরা ১৯ থেকে ২১ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে থাকে। ইংরেজী নাম এৎবু যবধফবফ গুহধ এবং এদের বৈজ্ঞানিক না হচ্ছে ঝঃঁৎহরধ গধষধনধৎরপধ. কাঠ শালিকের শরীরের নিচের অংশের বুক, পেট আর লম্বা লেজের পালকের রং উজ্জ্বল বাদামি, পা লালচে এবং উজ্জ্বল বড় চোখ। গলায় রয়েছে মালার মতো অতিরিক্ত ধূসর পালক।
এরা গাছের কোটরে গর্ত করে বাসা বানায় এবং বসন্ত থেকে বর্ষাকাল পর্যন্ত এদের প্রজনন মৌসুম। এ সময় বাসায় তিন থেকে চারটে ছোট লম্বাটে নীলচে রঙের ডিম পাড়ে। এদের খাদ্য তালিকা রয়েছে সব রকম পোকা মাকড় আর ফল। পরিবেশবান্ধব সুন্দর এই শালিক প্রজাতির পাখিদের সংরক্ষণ অতি জরুরী। নইলে এরা চিরতরে বিলুপ্ত হবে বলে পাখি বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন।

No comments

Powered by Blogger.