নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু তৈরিতে ৫ বিষয়ে গুরুত্ব সরকারের-০ সারচার্জ আরোপ ০ প্রবাসীদের জন্য বন্ড ০ ডিবেঞ্চার ও বন্ড বিক্রি ০ রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ০ ব্যক্তিগত অনুদান by এম শাহজাহান

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে ৫টি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এগুলো হচ্ছে সারচার্জ আরোপ, প্রবাসীদের জন্য বন্ড ইস্যু, ডিবেঞ্চার ও বন্ড বিক্রি, রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনুদান গ্রহণ। তবে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ও মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে রিজার্ভের ওপর আপাতত হাত দেয়া হবে না।


ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্পের প্রবৃদ্ধি ঠিক রাখতে অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং খাত থেকেও অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ করার ইচ্ছা নেই সরকারের। এ ছাড়া নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে সার্বভৌম বা সভরিন বন্ড বিক্রি ও পুঁজিবাজারে শেয়ার বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করা হতে পারে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে আরও কিছু অপশন সামনে রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, আগামী বছরের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করতে চায় সরকার। আর এ জন্য প্রয়োজন প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক সরে গেলেও জাইকা এবং আইডিবিসহ দাতা সংস্থাগুলো এ প্রকল্পে ঋণ বিতরণে প্রস্তুত রয়েছে। ফলে নিজস্ব অর্থায়ন ও দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিয়েই পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর জনগণের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনেকেই তাঁকে ফোন করে সাহস জোগাচ্ছেন। স্কুলছাত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ফোন করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের রূপরেখা তুলে ধরেন। ৭৫০ মিলিয়ন ডলারের বন্ড ছাড়ার পরিকল্পনার কথাও তিনি বলেন। সারচার্জ আরোপ করে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করারও আভাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠন, বেসরকারী ব্যাংক এবং বীমা কোম্পানি ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে।
তবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে টাকা সংগ্রহ করে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প নির্মাণ করা কঠিন হবে বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্বব্যাংককে বাইরে রেখে সরকার যে কোন মূল্যে টাকা সংগ্রহ করতে পারবে। কিন্তু সেই টাকা কিভাবে কোত্থেকে আসবে সেটা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মার্কেটে বন্ড ছাড়া হলে সেটার সুদ হার ৭-৮ শতাংশ হবে এবং পাঁচ থেকে ছয় বছরের মধ্যে তা পরিশোধ করতে হবে।
অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ মার্কেটে ডিবেঞ্চার বা বন্ড ছেড়ে টাকা তোলা হলে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সঙ্কট বাড়বে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, সারচার্জ আরোপ করা হলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে হয়ত সরকার ২৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করতে পারবে। কিন্তু টেকনিক্যাল সাপোর্ট ও ব্রিজ নির্মাণের জন্য কাঁচামাল কিনতে ডলার প্রয়োজন হবে। তিনি বলেন, শুধু আবেগ দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব নয়।
এদিকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে পদ্মা সেতু সারচার্জ আরোপ করার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে এ প্রকল্পে অনুদানের টাকা গ্রহণ করতে পদ্মা সেতু তহবিল নামে আরেকটি বিশেষ হিসাব খোলার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটের প্রাক্কলিত কর রাজস্বের ওপর ১০ শতাংশ সারচার্জ আরাপ করা হলে সরকারের অতিরিক্ত ১১ হাজার ২২৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা আয় হবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে সরকার এই টাকা ব্যয় করতে পারবে। রাজস্ব আয় বাড়াতে ইতোমধ্যে ভ্যাট আইন সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর সারচার্জ আরোপ করার কথা বলা হচ্ছে। স্পীকার আব্দুল হামিদ জাতীয় সংসদে পদ্মা সেতুর অর্থায়নে মোবাইল ফোনের উপর ০.২৫ পয়সা সারচার্জ আরোপের কথা বলেছেন।
তবে জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ডিসিরা পদ্মা সেতুর অর্থায়নে ০.১০ পয়সা সারচার্জ আরোপ করার দাবি করেন। জেলা প্রশাসক সম্মেলন শেষে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সমিতির বার্ষিক নৈশভোজে বাংলাদেশ এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে আমরা সরকারী কর্মকর্তারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে আমরা জনগণের দুয়ারে দুয়ারে যেতে প্রস্তুত। আমাদের সন্তানরাও ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত।
অন্যদিকে ২ কোটি টাকার সম্পত্তির অধিকারীদের উপর প্রদেয় করের ১০ শতাংশ সারচার্জ হিসেবে আদায় করছে সরকার। বিদায়ী অর্থবছরে এ ধরনের সারচার্জ আদায়ে ৫০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণে এ ধরনের সারচার্জ আরও বেশি আদায়ে সরকার নজর দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। এ প্রসঙ্গে এনবিআরের আয়কর নীতি বিভাগের প্রথম সচিব একেএম বদিউল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষ চার্জ আরোপ করতে পারে। এক্ষেত্রে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে হলে অবশ্যই সরকারের আয় বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিল, টেলিফোন বিল, গ্যাস বিল ও কেনাকাটার ক্ষেত্রে ভ্যাটে কমনলি ১০ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করা যেতে পারে। এ ছাড়া রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে পদ্মা সেতুর অর্থায়নে সে লক্ষ্যমাত্রা আরও ৩ বা ৫ হাজার কোটি টাকা বাড়াতে পারে সরকার।
এদিকে বাংলাদেশ ইন্সুরেন্স এ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য সরকার বন্ড বা ডিবেঞ্চার ইস্যুর মতো কোন উদ্যোগ গ্রহণ করলে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড তাতে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বেসরকারী খাত ডিবেঞ্চার ও বন্ড কিনে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করতে চায়। এদিকে পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রবাসীরা অর্থায়নেরও আগ্রহ দেখিয়েছেন। সেতু নির্মাণের জন্য বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহেরও পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ। পদ্মা সেতু নির্মাণে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে অনুদান প্রদান করে সেতু নির্মাণে অবদান রাখতে ইচ্ছাপোষণ করা হচ্ছে। প্রবাসীরা ফোনে প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, তারা যে পরিমাণ অর্থ বিদেশ থেকে দেশে পাঠায়, তার পরিমাণও তারা সাধ্যমতো বাড়ানোর চেষ্টা করবেন।
এ ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ প্রকল্পে অর্থ সহায়তা দিতে চেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের কিছু ছাত্র তাদের হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে উপাচার্যের কাছে ছয় হাজার টাকা দিয়েছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন পদ্মা সেতুতে অর্থ প্রদানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের এক দিনের বেতন এই সেতুর জন্য দেয়ার কথা বলেছেন।

No comments

Powered by Blogger.