মানবতাবিরোধী বিচার আইনে আপীলের বিধান বাতিলের জন্য বলা হবে-সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের আলোচনায় একে খন্দকার

পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার বলেছেন, মানবতাবিরোধী বিচার আইনে আপীলের বিধান বাতিলের জন্য সরকারকে অনুরোধ করা হবে। তিনি বলেন, বিশ্বের কোথাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়েব বিরুদ্ধে আপীল করার সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা কেন আপীলের সুযোগ রাখলাম তা বুঝতে পারি না।


শনিবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অগ্রগতি ও সমস্যা শীর্ষক জাতীয় গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতির বক্তব্য রাখেন তিনি। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল আলোচনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মানবতাবিরোধী বিচারের চীফ প্রসিকিউশন গোলাম আরিফ টিপু, তদন্ত কর্মকর্তা সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান, সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী, বিটিভির মহাপরিচালক মুক্তিযোদ্ধা ম হামিদ, এ্যাডভোকেট মঞ্জিল মোর্শেদ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ড. সারওয়ার আলী প্রমুখ।
পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ গতি পেলেও এর চেয়ে বোধহয় আরও বেশি গতিতে বিচার কাজ এগোনোর প্রয়োজন ছিল। বর্তমান সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে না পারলে শুধু আমাদের নয়, পুরো জাতির ওপর দুর্যোগ নেমে আসবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। একই সঙ্গে বিচার কাজ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। আর যদি কখনও দুর্যোগ নেমে আসে বর্তমান সময়ের মতো তখনও এ প্রশ্নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার পরামর্শ দেন তিনি। একে খন্দকার বলেন, বিচার কাজের বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে যেখানে সেক্টর কমা-ার্স ফোরাম গেছে সেখানে সকল রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিকে জানানো হতো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কোন দলের না করে জাতীয় করার জন্য তাঁরা ওই প্রচেষ্টা করেন।
মানবতাবিরোধী বিচারের চীফ প্রসিকিউশন গোলাম আরিফ টিপু বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যতটুকু হয়েছে বেশ হয়েছে। তিনি বলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস চলতি বছরের মধ্যে তিন/চারজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ হবে। বিচার কাজে নিজেদের আন্তরিকতার অভাব নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, জান, প্রাণের বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা রেখে তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন।
তদন্ত কর্মকর্তা সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান বলেন, এ বিচার নিয়ে আপনাদের মতো আমারও আবেগ, উদ্বেগ এবং আশঙ্কা আছে। ট্রাইব্যুনালের কিছু দুর্বল দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, আসামিরা অনেক ক্ষমতা ও বিত্তবান। আর সাক্ষীরা খেতে পায় না। এমন সাক্ষীদের সাক্ষ্য দেয়ার সময় ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। তিনি বলেন, দালাল শনাক্ত করতে সমস্যা হচ্ছে। কারণ এ পর্যন্ত দালাল নিয়ে কোন গবেষণা হয়নি। এছাড়া ৪০ বছর অনেক সময় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ দীর্ঘ সময়ে অনেকে বিয়েসাদির মাধ্যমে আত্মীয় হয়ে গেছে। তিনি বলেন, এ অবস্থ্যায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তি আসামিদের পক্ষে এসে সাক্ষ্য দিলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের ঈস্যুকে রাজনৈতিক না করে জাতীয় করা দরকার ছিল। হান্নান খান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী কোন সংগঠনের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করিনি। কারণ আমাদের সেই ক্ষমতা দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, এ বিচার নিয়ে অন্যদের মতো আমিও মাঝে মধ্যে ভয় পাই। তবে চলতি বছরের মধ্যে দুয়েকজনের বিচার হবে না এমনটি ধারণা করা ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিচার কাজের অগ্রগতির জন্য ট্রাইব্যুনালের জনবল বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি একটি অর্গানোগ্রাম জামা দিয়েছেন জানিয়ে বলেন, ওই অর্গানোগ্রাম অনুমোদন হলে কার্যক্রমের অগ্রগতি দ্রুত দৃশ্যমান হবে। এ সময় তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিষয়টি টেনে বলেন, জিয়াউর রহমানকে কেন ওই মামলা থেকে বাদ দেয়া হলো তা বোধগম্য নয়।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তি হচ্ছে না। এ জন্য দায়ী করেন প্রশাসনে লুকিয়ে থাকা জামায়াত শিবিরকে। তাদের চিহ্নিত করে বের করে দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। বিচার প্রশ্নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আন্তরিকতার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, লিমনের মতো নিরপরাধ ছেলের বিরুদ্ধে সময় নষ্ট করে তারা। অপরদিকে বাচ্চু রাজাকার পালিয়ে যায়, সে দিকে খেয়াল রাখে না। তিনি বলেন, এতদিনে সাক্ষী সুরক্ষা আইন কেন করা হলো না সেটা প্রশ্নের সম্মুখীন। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বিদেশে যে সব লবিস্ট কাজ করছে তাদের কাউন্টার লবিস্ট রাখার পরামর্শ দেন তিনি। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হতে বলেন ড. মিজান।
তাছাড়া আসামিপক্ষের প্রতি আদালতে আন্তরিকতার বিষয়টি তুলে ধরে মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, তাদের বিষয়ে আদালতের এত বদন্যতা কেন? যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে জনমনে সৃষ্ট প্রশ্নের উত্তর সংবলিত একটি পুস্তিকা ইতোমধ্যে মানবাধিকার কমিশন প্রকাশ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ওই পুস্তিকাটি দেশের বাইরে দূতাবাসগুলোতে প্রেরণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জনবল স্বল্পতার কারণে মানবাধিকার কমিশন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে আশানুরূপ সহায়তা করতে পারছে না বলে জানান তিনি।
সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধে সব ধরনের মানবতাবিরোধী কাজ করেছে পাকিস্তানী ও তাদের দোসররা। সেই মানবতাবিরোধীদের বিচার বিষয়ে যারা প্রশ্ন তুলছে তাদের আসল উদ্দেশ্য কি? তিনি বলেন, দেশে হাজার হাজার যুদ্ধাপরাধী রয়েছে, তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এজন্য রাজধানীতে ১০টি আর প্রত্যেক জেলায় একটি করে ট্র্যাইব্যুনাল গঠন করার দাবি করেন তিনি।
এ্যাডভোকেট মঞ্জিল মোর্শেদ বলেন, মানবতাবিরোধীদের বিচার করতে ২০ থেকে ২০০ সাক্ষীর দরকার নেই। বিশ্বাসযোগ্য দুইজন সাক্ষী যথেষ্ট। এ বিষয়ে উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ড. আনিসুজ্জামান এবং অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের মতো দুইজন সাক্ষী যথেষ্ট। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে আনা গেলে ভাল হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন কোন কারণে এ সরকার না থাকলেও বিচার কাজ বন্ধ করতে পারবে না। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের আইন রক্ষায় আন্দোলন থেকে আমরা পিছপা হব না।
প্রবীণ রাজনীতিক হায়দার আকবর খান রনো বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে জাতীয় ঐক্য না হওয়া দুঃখজনক। তিনি বলেন, অন্যান্য সাধারণ অপরাধের মতো এ বিচার করলে দেড় বছরে বিচার কাজ শেষ করা যাবে না।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে আরও ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ড. সারওয়ার আলী। তিনি বলেন, আসামিপক্ষ বিভিন্ন অজুহাতে বিচার কাজে দীর্ঘ সূত্রতার ষড়যন্ত্র করছে।
লিখিত বক্তব্যে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ’৭১-এর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হারুন হাবিব বিচারের অগ্রগতি, বিভিন্ন সমস্যা এবং কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করেন। অগ্রগতির মধ্যে রয়েছে আগের যে কোন সময়ের তুলনায় তদন্ত ও প্রসিকিউশন টিমের মধ্য সমন্বয় সন্তোষজনক। অভিযুক্ত, আটক প্রায় প্রত্যেকের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন মামলার শুনানিতে তারা সন্তুষ্ট। অধিকাংশ সাক্ষীর সাক্ষ্যপ্রদান এবং দুই নম্বর ট্রাইব্যুনাল বিচারের বিষয়ে মানুষের মনে আগের চেয়ে অনেকখানি আশা সৃষ্টি করেছে।
সমস্যার মধ্যে আছে মামলার দীর্ঘসূত্রতা, প্রসিকিউশন বেশ কিছু নির্ধারিত সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অভিযুক্তদের সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের পর্যাপ্ত সতর্কতার অভাব লক্ষ্য করার মতো। সাক্ষী ও তাদের পরিবার পরিজনদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়নি। এর ফলে আসামিপক্ষ নানাভাবে হুমকি, এমনকি হত্যার হুমকি দিচ্ছে। এতে করে মামলাগুলো দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীরা, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সরাসরি স্বাধীনতাবিরোধী এবং চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ অবলম্বন করেছে। তারা ঐতিহাসিক এ বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত বা ভ-ুল করার লক্ষ্যে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে।
এমন অবস্থায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় আরও কয়েকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং প্রতিটি চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেফতার করে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনার প্রস্তাব করে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ’৭১। বর্তমান মামলাগুলোর কার্যক্রম আরও দক্ষতা ও দ্রুততার সঙ্গে পরিচালিত করা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো সকল অসাম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দল গোষ্ঠীগুলোর সম্মিলিত মোর্চা গঠন করতে হবে। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে লবিস্ট নিয়োগ করে বিদেশে যে অপপ্রচার চালাচ্ছে তা প্রতিহত করতে অবিলম্বে বিদেশী দূতাবাসকে সক্রিয় করার পাশাপাশি বিচার প্রত্যাশী প্রবাসী বাঙালীদের প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.