শিক্ষামন্ত্রী আজ বৈঠক ডেকেছেন-আমন্ত্রিত বুয়েটের ডিন, বিভাগ প্রধান ও সাবেক ভিসিরা

বুয়েট সংকট নিরসনে সকল ডিন, বিভাগীয় প্রধান, সাবেক উপাচার্যদের নিয়ে আজ দুপুর ১২টায় জরুরী সভায় বসছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কোন আলোচনা নয় শিক্ষক নেতাদের এমন অবস্থানের কারণে শিক্ষক সমিতিকে সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।


সমিতির একগুয়েমী আচরণে শিক্ষামন্ত্রী হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, সমিতির একের পর এক দাবি পূরণ করা হচ্ছে। নতুন নতুন দাবি তুলছেন। বুয়েট সিন্ডিকেট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনেরও প্রস্তাব করেছে, অথচ তাও মানতে নারাজ শিক্ষক নেতারা। এদিকে শনিবার শিক্ষক সমিতির অবস্থানের পক্ষে-বিপক্ষে পাল্টা পাল্টি মিছিল সমাবেশ করেছেন শিক্ষক নেতারা এবং প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নিজেরা প্রতিবেদন তৈরি করে তা গোয়েন্দা সংস্থার নামে প্রচার করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে সমিতির বিরুদ্ধে। শিক্ষক নেতাদের আন্দোলন ক্রমেই রাজনৈতিক রূপ পাচ্ছে। বিএনপি নেতা ও ঢাবির বিএনপিপন্থী সাদা দলের পর এবার যোগ দিয়েছেন চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ড. মাহমুদুর রহমান ও ছাত্রদলের নেতারা।
এদিকে অচলাবস্থা নিরসনের আহ্বান জানিয়ে বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ পাঁচ জনকে জাস্টিস ডিমান্ড নোটিস (আইনগত বিজ্ঞপ্তি) দেয়া হয়েছে। নোটিসে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে চলমান আন্দোলন কর্মসূচী স্থগিত এবং অবিলম্বে অনির্ধারিত ছুটি বাতিল করে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান কার্যক্রম শুরুর দাবি জানানো হয়েছে। বুয়েটের বিদ্যমান পরিস্থিতির জন্য শিক্ষক সমিতিকে দায়ী করে রেজিস্ট্রি ডাকযোগে পাঠানো নোটিসে বলা হয়, লাগাতার অবস্থান কর্মসূচী ও গণপদত্যাগের ঘোষণাসহ নানা কর্মসূচী পালনের মাধ্যমে বুয়েটকে অচল করে কারিগরি শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠকে ধ্বংসের সুগভীর চক্রান্তের পাশাপাশি ১০ সহস্রাধিক কোমলমতি শিক্ষার্থীর উজ্জ্বল ভবিষ্যত নস্যাতের পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে। অনলাইন বার্তা সংস্থা পিটিবি নিউজ ডটকম এর প্রধান সম্পাদক এবং নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ও পরিবেশকর্মী আশীষ কুমার দের পক্ষে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী মোঃ এনামুল হক মোল্লা জনস্বার্থে এই নোটিস পাঠান। রবিবার সকালে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে আচার্য ও রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষক সমিতি ও শিক্ষার্থীরা। সকালে দীর্ঘমিছিল নিয়ে বঙ্গভবনের দিকে রওয়ানা হয় তারা। মিছিলটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে বঙ্গবভনের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। সেখান থেকে শিক্ষকেদের একটি প্রতিনিধি দল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিতে যায়। রাষ্ট্রপতির পক্ষে স্মারকলিপি গ্রহণ করেন তাঁর উপ-প্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদ। বেলা পৌনে ১টার দিকে দোয়েল চত্বর থেকে আবার ক্যাম্পাসে ফিরে যায় আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ আতাউর রহমান বলেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে। প্রয়োজনে শিক্ষকরা গণপদত্যাগ করবেন। এদিকে দুপুরে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসেন ইউজসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী ও শিক্ষা সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। সিদ্ধান্ত হয় আজ সোমবার বুয়েট সংকট নিরসনে সকল ডিন, বিভাগীয় প্রধান, সাবেক উপাচার্যদের নিয়ে সভায় বসবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গতকাল রবিবার বিকেলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত শিক্ষা প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী জানান, সভায় বুয়েটের সব ডিন ও বিভাগীয় প্রধান ছাড়াও আইবির ও রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল হুদা, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল মতিন পাটোয়ারী, অধ্যাপক ড. এমএইচ খান, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাদ চৌধুরী, ড. মীর মোবাশ্বের হোসেন উপস্থিত থাকবেন। আন্দোলনরত শিক্ষক সমিতির নেতাদের সভায় আমন্ত্রণ না জানানোর বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘সমিতি হলো একটি সংগঠন। এটি প্রশাসনিক কোন কিছু নয়। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকদের আলোচনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এতে কখনও তারা এসেছেন, কখনও আসেননি, আবার কখনো আমাকে সেলফোনে জানিয়েছেন, তারা আলোচনায় বসবেন না।
তারা কেবল প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। তাই শিক্ষক নেতাদের ওই সভায় আমন্ত্রণ দিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চাই না। তিনি বুয়েটকে দেশের একটি শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান আখ্যায়িত করে বলেন, কিছু দিন ধরে বুয়েটে যে পরিস্থিতি চলছে তা নিয়ে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন, দুঃখিত ও মর্মাহত। দেশের সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের অর্থে চলা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি কোনক্রমেই কাম্য নয়। শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষক সমিতির আন্দোলন প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রথমে শিক্ষক সমিতির দাবি ছিল তাদের চাকরির বয়স ৬৫ বছর করা। সেটা সরকার করেছে। পরে তারা দাবি জানান, এক কর্মকর্তার ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি বাতিল করতে। সেটাও আমরা করেছি। এরপর তাদের দাবি ছিল প্রো-ভিসিকে নিয়োগ কমিটির সভাপতির পদ থেকে সরানো। তাও করা হয়েছে। পরবর্তীতে তাদের দাবি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে আনা ১৬/১৭টি অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করা হয় এবং ওই কমিটি রিপোর্ট দেয়ার পর পরই তারা ফের আন্দোলনে নামে। সর্বশেষ অভিযোগ তদন্তে বুয়েট সিন্ডিকেট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনেরও প্রস্তাব করেছে। কিন্তু তাও মানতে নারাজ শিক্ষক নেতারা। বুয়েট আন্দোলনের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে কী না এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে এখনই কিছু বলবো না। বিকেলে কাফেটারিয়ার সামনে সমাবেশ থেকে সমিতির অবস্থানকে অযৌক্তিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিহিত করে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের দাবি জানিয়েছে প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আজ সোমবার সাড়ে তিনটায় একই স্থানে সমাবেশ করবেন তারা।
‘বুয়েট শিক্ষক ছাত্র কর্মকর্তা কর্মচারী ঐক্য ফোরামের ব্যানারে আয়োজিত সমাবেশ থেকে শিক্ষক আন্দোলনকে অযৌক্তিক অভিহিত করে আবারও দুই দফা দাবি ও চারটি প্রশ্ন তুলছেন তারা। অবিলম্বে শিক্ষক আন্দোলন প্রত্যাহার এবং বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের কাজে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেছেন, তদন্তের আগেই দ- কেন? বিচার বিভাগীয় তদন্তে আপত্তি কেন? শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা নয় কেন? সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় কেন? সমাবেশে বক্তব্য রাখেন শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মুনাজ আহমেদ নূর, অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার, ড. মিজানুর রহমান, শামীম আরা হাসান, সাবেক ছাত্র ও আইইবির সাধারণ সম্পাদক আবদুস সবুর, আইউবির ঢাকা সেন্টারের ভাইস চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন শেলী, ছাত্র আমিনুল হক পলক মিশু বিশ্বাস। শিক্ষক কর্মকর্তারা বলেন, শিক্ষক সমিতির আন্দোলন শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কতটা করা হচ্ছে? আন্দোলনকারীরা বলছেন, বুয়েটকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে এ আন্দোলন। কিন্তু আসলে তা নয়। তারা আরও বলেন, বিচার বিভাগীয় তদন্তে শিক্ষক সমিতির এত ভয় কেন? তাহলে সত্য বেরিয়ে আসবে। তাহলে তাদের আন্দোলনের আর যৌক্তিকতা থাকবে না? শিক্ষকরা কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বান মেনে নিয়ে শিক্ষক সমিতিকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান। সমাবেশ শেষে একটি র্যালি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়।
এদিকে নিজেরা প্রতিবেদন তৈরি করে তা গোয়েন্দা সংস্থার নামে প্রচার করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে সমিতির বিরুদ্ধে। অভিযোগ উঠেছে, শনিবার একটি কাগজে বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে গণপত্যাগকারী ২৪ জন শিক্ষকের নাম লিখে বলা হয়েছে এদের মধ্যে ১৭ জনই আওয়া লীগ। কেউ বিএনপি-জামায়াত পন্থী নন। এসব লিখে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষক নেতারা বলেছেন, এটা হলো গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট। এমনকি এটা ধরে কয়েকটি পত্রিকায় প্রতিবেদনও ছাপা হওয়ায় উদ্বিঘœ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে রবিবার মাঠে নেমেছে সরকারের দুটি গোয়েন্দা সংস্থা। কারা এটি সরবরাহ করেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জানা গেছে, ইতোমধ্যেই গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে যাদের আওয়ামী লীগপন্থী বলে প্রচার করা হয়েছে তাদের মধ্যে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, দেশের কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই তার কোন সম্পূক্ততা নেই। তথ্যকে ভিত্তিহীন উল্লেখ করে ড. রফিকুল ইসলাম বলেছেন, আমি আমার জীবনে কখনও কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না আর ছাত্র রাজনীতির তো প্রশ্নই ওঠে না।’ অন্যদিকে রবিবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষক সমিতির নেতারা বলেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে সোমবার (আজ) সভায় যাবেন বিভাগীয় প্রধানরা। সমিতিকে ডাকলে যাবেন কি না? এমন এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেছেন, যদি ডাকে তবে যাব।

No comments

Powered by Blogger.